রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে কোরবানির পশুর হাটে কেনাবেচা জমতে শুরু করেছে। ঈদুল আজহার কোরবানির হাটগুলোতে দেশি গরুতে ছেয়ে গেছে। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের কোরবানির ঈদের হাটে দেশি গরুর চেয়ে ভারতীয় গরুর আধিক্য দেখা যেত। এখন সে চিত্র পাল্টে গেছে। প্রত্যোকটি হাট এখন দেশি গরুতে ভরপুর। ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদী সরকার হঠাৎ করে ভারতীয় গরু বাংলাদেশে প্রবেশের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ায় এখন দেশের কৃষক ও ছোট বড় খামারিদের গরুই ঈদের কোরবানির চাহিদা মেটাচ্ছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানায়, এবার পবিত্র ঈদুল আজহায় কোরবানির জন্য ৮ বিভাগের ৬ লাখ ৮১ হাজার ৫৩২টি খামারে পশু প্রতিপালন করা হয়েছে। এছাড়াও পদ্মা, তিস্তা, ব্রক্ষèপুত্র, যমুনার শত শত চরাঞ্চলে কোরবানির ঈদের জন্য গরু প্রতিপালন হয়েছে। জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মনজুর মোহাম্মদ শাহাজাদা বলেন, চলতি বছর কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে ১ কোটি ২১ লাখের বেশি। এই সংখ্যা চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত। গত বছর প্রায় ৯১ লাখ গবাদি পশু কোরবানি হয়েছে। এবার হয়তো তার চেয়ে বেশিই হবে। সেটা মাথায় রেখে পশু প্রতিপালন করা হয়েছে।
গত শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘পদ্মা সেতুর সম্ভাবনা: দেশীয় পশুতে কোরবানি, খামারিদের সমস্যা ও করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে জানানো হয়, ২০২১ দেশে কোরবানী যোগ্য গরু, ছাগল, মহিষসহ অন্যান্য পশু প্রস্তুত ছিল এক কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি। কোরবানী হয়েছিল ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি। ২৮ হাজারেরও বেশি কোরবানীর পশু অবিক্রিতই থেকে যায়। এবার কোরবানির পশুর চাহিদা ধরা হয়েছে ৯৭ লাখ ৭৫ হাজার ২৩৫টি। চাহিদার বিপরীতে দেশের ৮ বিভাগে মোট এক কোটি ২১ লাখ ৩৮৯টি কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু মজুদ আছে। এ বছরও প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ গবাদিপশু অবিক্রীতই থেকে যাবে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। আরো জানানো হয়, দেশে কোরবানী যোগ্য গবাদিপশুর অভাব নেই। তবে অঞ্চলভেদে কোরবানির পশুর প্রাপ্যতা ও চাহিদার মধ্যে ফারাক রয়েছে। অতিরিক্ত মজুদ থাকা অঞ্চল থেকে ঘাটতিতে থাকা অঞ্চলের হাটে গবাদিপশু নিয়ে যাওয়া সহজ করা হয়েছে।
রাজধানী ঢাকার একাধিক গরুর হাট ঘুরে এবং বিভিন্ন জেলার কয়েকটি কোরবানির গরুর হাটের চিত্র জানিয়ে স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, এবার প্রতিটি হাটে দেশি গরু। এমনকি সীমান্ত জেলা হিসেবে পরিচিত লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম, চাপাইনবাবগঞ্জ, যশোর জেলার পশুর হাটগুলোতে ভারতীয় সাদা গরু তেমন চোখে পড়ছে না। প্রতিটি হাটে হয় খামারিদের গরু নয়তো গ্রামের কৃষকদের ঘরে প্রতিপালন করা গরু।
এছাড়াও রাজধানী ঢাকার আশপাশে শতাধিক বড় খামারে গরু বিক্রি হচ্ছে অনলাইনের মধ্যেমে। অনলাইনে কোরবানির পশুর হাটে পশু বিক্রি করছে বিক্রয় ডটকম, বেঙ্গল মিট, ডিজিটাল হাট, দারাজ গরুর হাট, প্রিয়শপ, দেশি গরু, মাদল, হেক্সা ট্রেডিং, ই-বাজার, অথবা ডটকম, আজকের ডিলসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। ক্রেতারা অনলাইনে গরু দেখে ক্রয় করছেন; কেউ বা খামারে গিয়ে গরু দেখে পছন্দ করে ক্রয় করছেন। ঈদের আগে সবার ক্রয় করা গরু পৌঁছে দেবে খামারিরা।
শুক্রবার এক সেমিনারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, ‘কোরবানির জন্য পর্যাপ্ত পশু মজুত আছে, তাই এ বছরও কোরবানিতে বাইরে (ভারত) থেকে একটি পশু আসবে না। আমাদের যে পরিমাণ পশু উৎপাদন হচ্ছে সেটি চাহিদা মিটিয়েও উদ্বৃত্ত থাকে। গত বছর কোরবানিতে উৎপাদিত গরুর এক-দশমাংশ বিক্রি হয়নি। এর সঙ্গে চলতি বছরের জন্য উপযুক্ত পশু মিলে অনেক পশু খামারিদের হাতে রয়েছে। দেশের খামারি এবং গৃহস্থের কাছে থাকা গবাদি পশু দিয়ে প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হবে। গত বছরের মতো খামারিদের গরু নিয়ে ফিরে যেতে হবে না। উপযুক্ত দামেই গরু বিক্রি করতে পারবেন। বর্ডার এরিয়ায় আরো কঠোর হতে বিভিন্ন সংস্থাকে নির্দেশনা দিচ্ছি, যাতে আমাদের দেশে বাইরের পশু না আসে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৫ সালে মোদী সরকার ভারতীয় গরুর বাংলাদেশে প্রবেশে কঠোর অবস্থান নেয়ায় বাংলাদেশে পশু প্রতিপালনে খামারের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এ ছাড়া ঈদুল আজহায় বেশি দাম পাওয়ায় দেশের প্রতিটি গ্রামে অধিকাংশ পরিবারে একটি থেকে ৫টি পর্যন্ত গরু প্রতিপালন করা হয় কোরবানির হাটে বিক্রির জন্য। এ ছাড়া চরাঞ্চলগুলোতে গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্র ক্ষুত্র গরুর বাতান। ওই সব বাতানের গরু ঈদের আগে বিক্রি করা হয়।
চোরাইপথে গরু আসা বন্ধ হওয়ার পর বৈধপথে ভারত থেকে গরু আমদানির সংখ্যাও কমে গেছে। বর্তমানে বৈধ পথে ভারত থেকে গরু আমদানির সংখ্যা কমে ৯২ হাজারে দাঁড়িয়েছে; যেখানে ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিলো ২৩ লাখ। বিগত বছরগুলোর হিসাব অনুযায়ী, কোরবানীর ঈদের আগে প্রতিবছর উত্তরাঞ্চলের ৭টিসহ মোট ২৩টি করিডর দিয়ে ভারত থেকে গরু আসতো। ভারত থেকে ২০১৪ সালে ২০ লাখ, ২০১৫ সালে ৮ লাখ, ২০১৬ সালে ১১ লাখ, ২০১৭ সালে ৯ লাখ, ২০১৮ সালে ৭ লাখ, ২০১৯ সালে ৯২ হাজার গরু ভারত থেকে বৈধ পথে বাংলাদেশে এসেছে। এ ছাড়াও চোরাই পথে গরু এসেছে লাখে লাখে। কিন্তু এখন দেশে গরু উৎপাদন বাড়ার ফলেই মূলত কোরবানির গরুর জন্য আর ভারতের ওপর নির্ভর করতে হয় না। বরং সীমান্ত দিয়ে যেন ভারত থেকে গরু প্রবেশ না করতে পারে সে বিষয়ে বিজিবিকে কঠোর নজরদারির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্র জানায়, দেশে শুধু ঈদুল আজহার বিক্রির জন্য গরু-ছাগল প্রতিপালন ব্যপকভাবে বেড়ে গেছে। বিভিন্নজাতের গরু এখন দেশের খামারে প্রতিপালন হচ্ছে। শুধু তাই নয় প্রতিবছর ব্যাক্তি পর্যায়ে গরু প্রতিপালন বৃদ্ধির পাশাপাশি বড় বড় ব্যবসায়ীরা খামারে গরু প্রতিপালন ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গরু প্রতিপালন করা হচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৮ সালে দেশে খামারের সংখ্যা ছিলো ৪ লাখ ৪২ হাজার ৯৯১টি। গত কয়েক বছরে সে সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে ৬ লাখ ৮১ হাজার ৫৩২টি খামারে পশু প্রতিপালন করা হয়েছে। এসব খামারে কোরবানিযোগ্য হৃষ্টপুষ্ট করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রামে বাণিজ্যিক খামারই বেশি। স্থানীয় ব্রিড রেড কাউ ব্যাপকহারে এখানে সফলতা দেখিয়েছে। গোশত ও দুধের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ায় গরু পালনে উৎসাহ বেড়েছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায়। এই বিভাগে অধিকাংশ এলাকা উঁচু হওয়ায় পর্যাপ্ত গো-খাদ্যও রয়েছে। এ ছাড়াও কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, রংপুর, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর, বগুড়া, রাজশাহী, জামালপুরসহ বিভিন্ন জেলায় গরুর খামার বেড়েছে। আর গরুর সংখ্যা সবচেয়ে কম রয়েছে সিলেট বিভাগে। এর কারণ হিসেবে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলেন, ওই বিভাগের অধিকাংশ এলাকা নিচু হওয়ায় এবং গো-খাদ্যের অভাব রয়েছে। তাই এই বিভাগে বাণিজ্যিক গরুর সংখ্যা কম। তারপরও সিলেট বিভাগের ৪ জেলায় ৫৫৯০টি খামারে পশু প্রতিপালন হয়েছে। তবে এবারের বন্যায় সিলেটসহ ১৫ জেলায় ৬ হাজার ৬৬২টি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এবার ঈদুল আজহায় দেশে কোরবানিযোগ্য মোট পশু আছে ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি। প্রশিক্ষিত খামারিদের কাছ থেকেই আসছে ৭৫ লাখ ৯০ হাজার ৪৪২টি। ৪৫ লাখ ৩৩ হাজার ৭৪৭টি কোরবানিযোগ্য উৎপাদিত পশু গৃহপালিত। কোরবানিযোগ্য পশুর মধ্যে গরু-মহিষের সংখ্যা ৪৬ লাখ ১১ হাজার ৩৮৩টি। আর ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৭৫ লাখ ১১ হাজার ৫৯৭। এছাড়া উট, দুম্বার সংখ্যা ১ হাজার ৪০৯টি।
এ বছর সবচেয়ে ভালো পশু উৎপাদন হয়েছে রাজশাহী বিভাগে। ১ লাখ ৬৪ হাজার ৬১৯ খামারির কাছ থেকে ঈদের হাটে উঠছে ২৭ লাখ ২৮ হাজার ৪৬০টি পশু। চট্টগ্রাম বিভাগের ৮৬ হাজার ৩৬ জন খামারির কাছ থেকে হাটে উঠছে ১৫ লাখ ৯২ হাজার ১১৪টি পশু। রংপুর বিভাগের ১ লাখ ৫৯ হাজার ৫৪০ খামারির কাছ থেকে আসবে ১০ লাখ ৩ হাজার ২৮১টি পশু। খুলনা থেকে আসবে ৮ লাখ ৭৯ হাজার ২৫১টি পশু। ঢাকা বিভাগ থেকে হাটে উঠছে ৬ লাখ ৩৭ হাজার ২৯৬টি পশু। বরিশাল বিভাগ থেকে হাটে উঠছে ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৫৪৩টি পশু। ময়মনসিংহ থেকে আসবে ২ লাখ ৯ হাজার ৩৪৪টি পশু এবং সিলেট থেকে আসবে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৩৫৩টি পশু।
এখন ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে গরু তেমন না আসায় দেশি ছোট-বড় ও হাইব্রিড জাতের গরু ভালো দামে বিক্রি হচ্ছে। ফলে রুগ্ন ডেইরি খাতও চাঙা হয়ে উঠছে। পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের খামারি ও চাষিরা ক্রসজাতের পাবনা ব্রিড, অস্ট্রেলিয়ান-ফ্রিজিয়ান, ইন্ডিয়ান হরিয়াণ, পাকিস্তানি সাহিয়াল ও দেশি জাতের গরু পালন করেন। সারা দেশে এ অঞ্চলের গরুর খ্যাতি ও চাহিদা রয়েছে। গোখামারি ও চাষিরা কোরবানির বাজার ধরার জন্য দেশের বিভিন্ন জেলায় দুই লক্ষাধিক গরু সরবরাহ করে এবং স্থানীয় পশুরহাটে বিক্রি করছেন। গরুর ব্যবসায়ীরা খামারি ও চাষিদের বাড়ি থেকে গরু কিনে বিক্রির জন্য ঢাকা, সিলেট, চিটাগাংসহ বিভিন্ন জেলার পশুরহাটে নিয়ে বিক্রি করছেন। গরু ব্যবসায়ীরা জানান, ভারত থেকে গরু দেশে যত কম আসবে খামারি ও চাষিরা তত বেশি লাভবান হবেন। দেশে গরু পালন বাড়বে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন