মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া রুখতে হবে

আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা | প্রকাশের সময় : ৫ জুলাই, ২০২২, ১২:০৩ এএম

জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে কার্বন ও মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ ঘটিয়ে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটানো হচ্ছে। দুনিয়ারপ্রাণ-প্রকৃতি আজ হুমকির মুখে। ব্যক্তিগত গাড়ি ও বিমানের ব্যবহার, কয়লা এবং তেলনির্ভর বিদ্যুৎসহ আরো নানা কারণে আমাদের পৃথিবী প্রতিনিয়ত উত্তপ্ত হচ্ছে। বিশেষ করে, জি-২০ দেশগুলোর লাগামহীন কার্বন নিঃসরণ এবং মাত্রাতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এই অবস্থার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। তারা জলবায়ুবিপর্যয় ঘটিয়ে মানুষের অস্তিত্ব বিলীন করতে চাচ্ছে। তথাকথিত উন্নয়নের নামেও বিনিয়োগের অজুহাতে এই বিপর্যয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের মতো প্রান্তিক দেশগুলো। যার কারণে বাংলাদেশের এক কোটি নব্বই লাখেরও বেশি শিশু সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব শিশুর এক-চতুর্থাংশের বয়স পাঁচ বছরের কম।


প্রাক-ইসলামী আরবকে অন্ধকারময় যুগ বলা হতো। বর্তমানে আমরা অন্ধকারময় পরিস্থিতিতে নেই কি? অতিমাত্রায় জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে আমরা এখন পুরো মানব সভ্যতা ও মানুষের অস্তিত্বকে ধ্বংস করতে অহমিকা দেখাচ্ছি। জাতিসংঘের তথ্য মতে, প্রকৃতি ধ্বংসের বর্তমান ধারা চলতে থাকলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০ লাখ প্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে। জলবায়ু বিপর্যয় যেভাবে ঘটানো হচ্ছে, তা যদি চলতে থাকে তাহলে ২০৭০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রতি তিনটির মধ্যে একটি প্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে। গত ৫০ বছরে গড়ে ৬০ শতাংশের বেশি বন্যপ্রাণী হ্রাস পেয়েছে। সে হিসেবে গত ১০ মিলিয়ন বছরের তুলনায় বর্তমানে প্রজাতি বিলুপ্তির গড় হার ১০ থেকে ১০০ গুণ বেশি। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ সামুদ্রিক প্রতিবেশ আজ পরিবেশগত হুমকির সম্মুখীন। ২০১০ হতে ২০১৫ সালের মধ্যে ৩২ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। আমরা যদি পরিবেশগত এ অবক্ষয় রোধ করতে না পারি, তাহলে ব্যাপকভাবে জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশ ধ্বংসের কারণে মানুষের খাদ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মারাত্মক নীতিবাচক প্রভাব পড়বে।

পৃথিবীর বেশির ভাগ অংশের জলবায়ু বিপর্যয়ের সাধারণ নীতিবাচক প্রভাব হলো লবনাক্ততা ও খরা। জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে আবহাওয়া আরো চরম হচ্ছে, যার বিরূপ প্রভাবের ফলে নানা ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে। এই বিপর্যয় সংক্রান্ত বিপদ ও ঝুঁকিগুলো হলো- বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, তাপদাহ, খরা, শৈত্যপ্রবাহ, লবণাক্ততা ও নদী ক্ষয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন জীবাশ্ম জ্বালানির মাত্রারিক্ত ব্যবহার আবহাওয়াকে উষ্ণ করে তুলছে, যার কারণে বিপর্যয় বাড়ছে এবং পরিবেশের উপর বিরুপ প্রভাব দেখা দিয়েছে। এর ফলে আরো বেশি সংখ্যক মানুষ অপ্রত্যাশিত বন্যা ও ঝড়ের কারণে ঘর ছাড়তে বাধ্য হবে। পাশাপাশি ফসলের ক্ষতি ও খরার মতো কারণও এই ধারাকে আরো প্রকট করে তুলছে। জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে খরার ঝুঁকিতে বাংলাদেশের ২২ জেলা, এসব তথ্য উঠে এসেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট অ্যান্ড ডিজাস্টার রিস্ক অ্যাটলাস’ শীর্ষক সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে। মূলত দীর্ঘ সময় ধরে চলা শুষ্ক আবহাওয়া, অপর্যাপ্ত বৃষ্টি, বৃষ্টিপাতের তুলনায় বাষ্পীভবন ও প্রস্বেদনের পরিমাণ বেশি হলে খরার সৃষ্টি হয়। এতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় দেখা দেয় পানির অভাব।

এছাড়াও বর্তমান অবস্থাতেই উপকূলীয় এলাকায় মাটিতে লবণের পরিমান বেড়ে কৃষি জমির উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে এবং লবনাক্ততার কারণে প্রয়োজনীয় সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে হিমালয়সহ উত্তর ও দক্ষিণ মেরুঅঞ্চলের বিপুল বরফ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের স্থল ভাগের প্রায় ২০ ভাগ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যাবে। আইপিসি এক প্রতিবেদনে আরও আশঙ্কা জানিয়েছে, বাংলাদেশের ১৯টি জেলার প্রায় ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এ কারণে গৃহহীন হবে প্রায় দুই কোটি মানুষ। জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে প্রতিবছর ঝড়ের পরিমাণ ও আকৃতি বাড়ছে। অবিলম্বে পৃথিবী ব্যাপী কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেনসহ প্রভৃতি গ্যাস নিঃসরণ বন্ধ না করলে আগামী ৮০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের বেশির ভাগ স্থলভূমি পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে।

জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রভাবে বাংলাদেশে তাপমাত্রা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে; বিশেষ করে সম্প্রতি রাজধানী ঢাকা ও রাজশাহীতে প্রায় মরুভূমির মতো তাপমাত্রা অনুভূত হচ্ছে, যা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। এছাড়াও বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চল জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে এবং মরুকরণ ত¦রাণিত হচ্ছে। এসবের ফলে দেশে খাদ্য উৎপাদন, সুপেয় পানির সংকট দেখা দেবে। ইতোমধ্যেই বাড়ছে নিত্যনতুন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অসুখ-বিসুখ। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঘরহারা মানুষের সংখ্যা। ফলাফল হিসেবে শহরাঞ্চলে বস্তিবাসীর সংখ্যাও বাড়ছে।

জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রভাব মোকাবেলায় এবং বিপর্যয় রোধে করনীয় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য কপ-২৬ অনুষ্ঠিত হলেও কার্বন নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে বিশ^নেতারা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে এবারও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। পৃথিবীব্যাপী প্রাণ-প্রকৃতির অস্তিত¦ যখন বিনাশের পথে এখনও জি-২০ দেশের নেতারা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন, যার কারণে বাংলাদেশের মত সমুদ্র উপকূলের দেশসমূহের জন্য এ বিপর্যয় ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

মানুষের অস্তিত্ব না থাকলে রাষ্ট্রের অস্তিত্বও বিলীন হয়ে যাবে। রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান উপাদান মানুষ। জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলে খাদ্য উৎপাদন ও সুপের পানির সংকটে জনস্বাস্থ্যকে হুমকিতে ফেলছে। মানুষের বাস্তুচ্যুত হচ্ছে জীবন ও জীবিকার তাগিদে। রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের কি কোনো প্রকার দায়িত্ব নেই? যদিও আগামী জলবায়ু বিপর্যয় বিষয় এ আন্তর্জাতিক সম্মেলন কপ-২৭ অনুষ্ঠিত হবে। উক্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রাণ-প্রকৃতির অস্তিত্ব রক্ষায় বাংলাদেশের প্রধান দাবী হওয়া উচিত ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে ক্ষতিপূরণ নয়, অতিমাত্রায় কার্বন নিসঃরণকারী দেশগুলোর জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার বন্ধ করা। ধনী দেশগুলোর রাজনীতিকরা সদিচ্ছা না থাকায় কার্বন নিঃসরণ কিছুতেই কমানো যাচ্ছে না।

রাষ্ট্রেগুলোকে প্রাণ-প্রকৃতির কথা বিবেচনা করে উন্নয়নকে কীভাবে পরিবেশসম্মত বা পরিবেশবান্ধব করা যায় সে ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা সময় এসেছে। পৃথিবীতে মানুষ ও প্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষা করতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরন ৪৫% কমিয়ে আনতে হবে। প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার বন্ধ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির এই ব্যবহার বন্ধ করতে প্রয়োজন নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা; যেমন: যাতায়াতের ক্ষেত্রে অযান্ত্রিক যানবাহন ব্যবহার করে জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার বন্ধ করতে বা কমাতে পারি। একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে পারি। সর্বোপরি পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণে সবুজ কর প্রণোদনা বিবেচনায় নিয়ে পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক জলবায়ু বিপর্যয় রোধে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে পরিবেশ আইনের কঠোর প্রয়োগের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে পারি। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব যান-বাহন, যন্ত্রপাতি ও সম্পদ আহরণের জন্য বিনিয়োগ কর ছাড় এবং সবুজসেবা প্রদানকারীদের আয়কর মওকুফের বিষয়টি বিবেচনা করতে পারি। এভাবে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি; সবুজ প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সম্পদ সংগ্রহে শিল্প-প্রতিষ্ঠানসমূহকে উৎসাহ প্রদান; সবুজ প্রযুক্তি সেবা প্রদানকারীদের প্রসার এবং দূষণ সৃষ্টিকারী কার্যক্রম নিরুৎসাহি ইত্যাদির মাধ্যমে পরিবেশের উন্নতি সাধন করতে পারি।

লেখক: আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন