শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ ইসলাম

প্রসঙ্গ : কুরবানির গোশত বিতরণ-২

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ৯ জুলাই, ২০২২, ১২:০০ এএম

ইবাদতে বিনয়-নম্রতা কাম্য। মন থাকবে আল্লাহ অভিমুখী, তাঁর ভয়ে কম্পিত, তাঁর ইশক ও মহব্বতে তাড়িত এবং তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা-ভক্তিতে আপ্লুত। মনের এ ভাবাবেগ অব্যাহত থাকা বাঞ্ছনীয় ইবাদতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটা সময়। তবে আমরা দুর্বল। আমাদের আছে নফসের নানারকম উৎপাত। আছে শয়তানের উপর্যুপরি প্ররোচনা। এ অবস্থায় ইবাদতের সঙ্গে মনের গভীর সংযোগ বজায় রাখা আমাদের পক্ষে একটু কঠিনই। অসীম দয়াময় আল্লাহ আমাদের এ দুর্বলতাকে ওজর হিসেবে দেখবেন বলে আমরা আশা করতেই পারি।

কিন্তু আমাদের বাহ্যিক ধরন-ধারণও যদি ইবাদতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হয়, উপরন্তু আমাদের কর্মপন্থা দ্বারা যদি ইবাদতের মহিমা ক্ষুণ্ন হয় আর এ অবস্থায় প্রকাশ্য কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন করে যাই, তবে সত্যিকার অর্থে তা ইবাদত হবে কতটুকু? আমাদের দ্বীন কি এরকম ইবাদতেরই আদেশ আমাদের করেছে? না ইবাদতের নামে এমন সব আচার-অনুষ্ঠান পালন করা বাঞ্ছনীয়?

গত আলোচনায় কুরবানির গোশত বিতরণের যে দৃশ্যের কথা বলা হলো, কুরবাানর মহান ইবাদতের সঙ্গে তা আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কেননা গোশত বিতরণের প্রচলিত পদ্ধতি বিনয়নিষ্ঠ নয়। এর মধ্যে আছে অহমিকার আভাস। লোকজন আমার বাড়ির দুয়ারে ছুটে এসেছে। আমার হাত থেকে গোশত নেয়ার জন্য হাত পেতে রেখেছে। আমি বিরক্তির সাথে দুই-এক টুকরা গোশত সেসব হাতে বিলিয়ে যাচ্ছি কিংবা সাগ্রহে বিতরণ করে দুর্বলের প্রতি করুণা করার অহমবোধে আপ্লুত হচ্ছি। এ ভাবধারা আর যাই হোক, মহান ইবাদতের সাথে খাপ খায় না। ইবাদতকালে মনের ভাব কেমন হবে সে সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে : আর যারা যা দেয়ার তা দেয় ভীত-কম্পিত হৃদয়ে এজন্য যে, তাদের নিজ প্রতিপালকের কাছে ফিরে যেতে হবে। (সূরা মু’মিনূন : ৬০)।

আল্লাহর উদ্দেশ্যে যেকোনো ইবাদত ও যেকোনো দান-বিতরণ এরকম ভীত-কম্পিত মনে হওয়াই উচিত। এটাই ইবাদতের প্রাণশক্তি। হ্যাঁ, ইবাদতের প্রাণশক্তি হচ্ছে তাকওয়া ও আল্লাহভীতি। নামায, রোযাসহ প্রতিটি ইবাদতের মধ্যে এ প্রাণশক্তি থাকা অপরিহার্য। মূলত এসব ইবাদতের মধ্য দিয়ে আল্লাহ তাআলা বান্দার কাছে যা চান তা কেবল তাকওয়াই। কুরবানি সম্পর্কেও আল্লাহ তাআলা বলেছেন : আল্লাহর কাছে তাদের (কুরবানির পশুর) গোশত পৌঁছে না আর তাদের রক্তও না, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া ও আল্লাহভীতিই। (সূরা হজ : ৩৭)।

যার অন্তরে আল্লাহর ভয় আছে, সে তার কাছে আল্লাহর বান্দাদের হাত পাতায় খুশি হতে পারে না। হাদিসে প্রকৃত মুমিন তাকেই বলা হয়েছে, যে নিজের জন্য যা পছন্দ করে, অন্য মুমিনের জন্যও তাই পছন্দ করে থাকে আর নিজের জন্য যা অপছন্দ করে, অন্যের জন্যও তা অপছন্দ করে। কোনো আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মুমিন অন্যের কাছে হাত পাতা ও অন্যের দুয়ারে ধরনা দেয়া পছন্দ করে কি? তাহলে সে অন্যের জন্য কেন তা পছন্দ করবে? কেন সে এতে খুশি হবে যে, কুরবানির গোশতের জন্য তার মুমিন ভাই-বোনেরা তার দুয়ারে এসে ধরনা দেবে?
এতে খুশি হওয়া তখনই সম্ভব, যখন সে নিজেকে তাদের তুলনায় বড় মনে করবে। ইবাদত শিক্ষা দেয় নিজেকে সব মুমিন অপেক্ষা ক্ষুদ্র ভাবতে। বিশেষত কুরবানি তো আত্মত্যাগেরই উদ্বোধক। আমিত্ব ত্যাগ ও অহমিকা বিসর্জনের মাধ্যমে নিজেকে আল্লাহ তা‘আলার সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র বান্দারূপে দেখতে না পেলে কুরবানি দ্বারা বিশেষ কী অর্জিত হলো? যদি প্রকাশ্যে পশু জবাই হয় অপরদিকে অন্তরস্থ পাশবিকতা হয় আরো পরিপুষ্ট, তবে সে কুরবানি কেবলই অনুষ্ঠানসর্বস্বতা।

ইসলাম মানুষকে আনুষ্ঠানিক বানাতে আসেনি। তার উদ্দেশ্য আপন শিক্ষায় মানুষের দেহমন বিকশিত করে তোলা। অহমিকা বিলোপ ছাড়া সে বিকাশ কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। বস্তুত কুরবানির গোশত বিতরণের বর্তমান রেওয়াজ অহমিকার বিলোপ নয়; বরং তার বাড়-বাড়ন্তেই ভূমিকা রাখে। সে কারণে এ রেওয়াজ বিলুপ্ত হওয়া উচিত। তা হবে তখনই, যখন কুরবানিদাতা তার কুরবানির গোশত মানুষের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দেবে।

কুরবানির গোশত নিয়ে মুসলিম ভাই-বোনদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়ানো বিনয়-নম্রতার পরিচায়ক। এটা অহমিকা নিরাময়ের এক কার্যকরী ওষুধও বটে। আপন সামর্থ্য অনুযায়ী এক পোটলা গোশত নিয়ে নিজে মুসলিম ভাইয়ের বাড়িতে পৌঁছে যাওয়া আর গোশতের আশায় কুরবানিদাতার দুয়ারে সে ভাইয়ের হাজির হওয়া কিছুতেই এক কথা নয়। প্রথম পন্থায় গোশত বিতরণ ইবাদতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এর দ্বারা আল্লাহর বান্দার ইজ্জত-সম্মান রক্ষা করা হয়, তার সামনে নিজ বিনয়-নম্রতা প্রকাশ করা হয় এবং তার প্রতি ভ্রাতৃত্ব ও মমত্বের আচরণ করা হয়। এসবই তাকওয়া ও আল্লাহভীরুতাপূর্ণ কাজ, যা কি না ইবাদতের সারবস্তু।

কুরবানি যখন এক ইবাদত, তখন তার গোশত এভাবেই বিতরণ করা বাঞ্ছনীয়। এর দ্বারা এ কথা বোঝানো উদ্দেশ্য নয় যে, যারা দুয়ারে দুয়ারে হাত পেতে বেড়ায় তাদের কুরবানির গোশত দেয়া যাবে না বা দেয়া জায়েজ হবে না। তাদের কুরবানির গোশত দেয়া জায়েজ হবে বৈ কি, কিন্তু ইসলাম যে বিনয়, সৌন্দর্য এবং ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধের তা‘লীম দেয়, তার যথার্থ অনুশীলনের জন্য মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বিতরণই বাঞ্ছনীয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন