চামড়া শিল্প দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। পোশাক শিল্পের পরই দেশে চামড়া শিল্পের স্থান। এ শিল্পের ওপর ভর করে বর্তমানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় নয় লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। বর্তমানে দেশে ট্যানারির সংখ্যা ২৩০-এর বেশি, যার অধিকাংশ ঢাকায় অবস্থিত। চামড়া আমাদের দেশের অন্যতম দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি খাত হওয়া সত্বেও বিগত কয়েক বছর যাবৎ কোরবানির চামড়া নিয়ে চামড়া সিন্ডিকেটের যেসব তেলেসমাতি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তা দুঃখজনক। দেশে সারাবছর যে পশু পরিমাণ চামড়া সংগৃহিত হয়ে থাকে তার অর্ধেকেরও বেশি চামড়া সংগৃহিত হয় কোরবানির পশু থেকে।
কোরবানির পশু চামড়ার অর্থের হকদার হলো দেশের এতিম, গরিব, মিসকিন এবং অসহায় মানুষরা। অথচ সেই অসহায়-দুস্থ এতিম মানুষের হকের ওপরেও একশ্রেনীর অসাধু চামড়া ব্যবসায়ী
লোভাতুর দৃষ্টি দেয়া থেকে মুক্ত থাকতে পারেনা। গত কয়েক বছর চামড়া পঁচে যাওয়া, বিক্রি না হওয়া, ফেলে দেওয়া, পানির দামে চামড়া বিক্রি হতে আমরা দেখেছি। এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর দেখতে চাইনা। এবার কোরবানির চামড়ার দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। গরুর চামড়া ৭ টাকা এবং খাসির চামড়ার দর ৩ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এবার ঢাকায় লবণযুক্ত চামড়া কিনতে হবে প্রতি বর্গফুট ৪৭ থেকে ৫২ টাকা দরে। আর ঢাকার বাইরে কিনতে হবে ৪০ থেকে ৪৪ টাকা দরে। এ ছাড়া সারা দেশে লবণযুক্ত খাসির চামড়ার দাম ৩ টাকা বাড়িয়ে প্রতি বর্গফুটের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ থেকে ২০ টাকা। তবে বকরির চামড়ার দাম পুর্বের ১২ থেকে ১৪ টাকাই থাকছে। চামড়া ক্রয়ে ব্যাংকগুলো টাকা বরাদ্দ করেছে, তবে টাকা নিয়ে চামড়া ব্যবসায়ীরা যেন চামড়া কেনার পরিবর্তে পূর্বের ঋণ পুনঃতফসিল না করতে পারে সেটি নিশ্চিত করা জরুরি। টাকা দিয়ে যেন চামড়া কেনাবেচা করা হয় সেটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে কঠোরভাবে দেখভাল করতে হবে। এছাড়া সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কেনাবেচা হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিতে কার্যকরি মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। আর তা যদি করা না যায় তাহলে সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্প এক ভয়াবহ সংকটে পরিণত হবে। চামড়া ব্যবসার সাথে জড়িতদের সবাই যে সংকটমুক্ত থাকেন সেটাও কিন্তু বলা যাবেনা। ২০১৭ সালে ট্যানারিশিল্প হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তর করা হয়েছে সত্য কিন্তু সেটি এখনও আন্তর্জাতিক মানের হয়ে উঠতে পারেনি নানা সীমাবদ্ধতার কারণে। বাংলাদেশের চামড়ার গুনগতমান পার্শ্ববর্তী অন্যান্য যেকোনো দেশের চেয়ে অনেক ভালো। চামড়া শিল্প ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বিশ্ববাজারে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে সে দিক থেকে চামড়ার মূল্য কমার কোনো যৌক্তিক কারণ আছে বলে মনে করার কোন কারন নেই।
বিগত বছরের মতো চামড়া শিল্প নিয়ে যেন এতিম গরীব অসহায় মানুষের মধ্যে হাহাকার নেমে না আসে সে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেখভাল করা খুবই জরুরি। না হলে সম্ভাবনাময় এই শিল্পটিকে হয়তো আর বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যাবে না। বিদেশে চামড়া রপ্তানি না করে যদি দেশেই চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনের কারখানা নির্মাণ করা যায় তাহলে একদিকে যেমন দেশে বহু মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে অন্যদিকে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে অধিকহারে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যাবে। তবে তা করতে হলে সরকাবি ও বেসরকারি সহযোগিতায় আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত আন্তর্জাতিক মানের চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তুলতে হবে। দেশে আন্তর্জাতিক মানের চামড়াজাত পণ্য তৈরি করা গেলে একদিকে যেমন দেশের চামড়া দেশেই ব্যবহার করে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যাবে এবং রপ্তানি আয়ও বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।
তবে সার্বিকভাবে দেশের চামড়া শিল্পের সাথে জড়িতরা মোটেই স্বস্তিতে নেই।
হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারের ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে স্থানান্তরের ফলে কারখানাগুলো পুনরায় পুরোদমে উৎপাদনে যেতে দীর্ঘ সময় লেগে যাওয়া এবং সেকেলে গদবাধা পদ্ধতিতে চামড়া সংরক্ষণ করতে না পাড়ায় দেশীয় চামড়া রফতানিযোগ্য মান অর্জন করতে না পারার পাশাপাশি সিনথেটিক ও ফেব্রিক দিয়ে উৎপাদিত জুতা, ব্যাগ, মানিব্যাগ, বেল্ট, জ্যাকেটের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে দেশের চামড়া শিল্প।
অন্যদিকে চামড়াশিল্প দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী গুরুত্বপূর্ণ খাত হওয়া সত্ত্বেও পোশাক শিল্পের তুলনায় কম সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় এই খাত থেকে কাঙ্ক্ষিত রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া ঈদুল আজহায় এক শ্রেণির ব্যবসায়ী চামড়া যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করে নিজেদের কাছে অতিরিক্ত সময় রেখে দেন। ফলে চামড়ার গুণগত মান নষ্ট হয় এবং আন্তর্জাতিক রফতানি মান হ্রাস পায়। এগুলোও চামড়া খাতের সঙ্কট অনেকাংশে বাড়িয়েছে।
প্রফেসর ড. মোহাঃ হাছানাত আলী
আইবিএ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন