বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

‘মানুষ পেটানো’ এমপিদের কর্মকাণ্ডে বিব্রত আ.লীগ

ইয়াছিন রানা | প্রকাশের সময় : ১৮ জুলাই, ২০২২, ১২:০১ এএম

মানুষের উপর হাত উঠানো, চরথাপ্পড় দেয়া কিছু জনপ্রতিনিধির কাছে স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গেছে। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এমপিদের হাতে সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে দলীয় নেতাকর্মী এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিরাও লাঞ্ছিত হয়েছেন। কারণে অকারণে ক্ষমতার দৌর্দান্ত প্রতাপে ‘মানুষ পেটানো’ এমপিদের নিয়ে বিবৃতকর অবস্থায় পড়ে গেছে আওয়ামী লীগ। দ্বাদশ নির্বাচনের দেড় বছর বাকি থাকলেও নির্বাচনী আবহাওয়া দরজায় কড়া নাড়ছে। বিশেষ করে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রভাবশালী দেশগুলো বাংলাদেশে জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। এ অবস্থায় দলের কিছু এমপি মারমুখি অবস্থা দলকে বেশ বিবৃতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। কারণ ওই সব ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ব্যপক প্রচারণা চলছে।

এমপিরা যেন নিজ নির্বাচনী এলাকার সবকিছু নিজেদের কব্জায় রাখতে বদ্ধপরিকর। একটু ব্যত্যয় ঘটলেই প্রতিপক্ষকে চরথাপ্পর দিয়ে শাসন করেন। কলেজের অধ্যক্ষ, স্কুলের শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, এমনকি দলীয় নেতা-কর্মী থেকে সাধারণ মানুষ পিটিয়ে বারবার বিতর্কে জড়িয়েছেন বেশ কয়েকজন এমপি। গত একবছরে অর্ধডজন এমপি মানুষ পিটিয়ে নিজেদের পেশীশক্তি জানান দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, কয়েকজন এমপির এমন কর্মকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দল। ভিন্ন বার্তা যাচ্ছে মানুষের কাছে। এমপিদের ব্যক্তিগত কর্মকান্ডের দায় দল না নিলেও সামগ্রিকভাবে এসব কাজের দায়ভার দলের উপরেই পড়ে। কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কথাও বলছেন সরকারি দলের নেতারা। তবে এসবের পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না, অথবা প্রকৃত সত্য আড়াল হয়ে যাচ্ছে কি না সেসব খতিয়ে দেখা উচিৎ বলেও মনে করেন দলটির সিনিয়র এই নেতা।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, এমপিদের বিতর্কিত আচরণে দলের ভাবমূর্তি যেমন ক্ষুন্ন হচ্ছে। সেই সঙ্গে নিজেরও ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনি বলেন, এ অভিযোগগুলো উঠে আসা খুবই বিব্রতকর। পেটানোর ঘটনাগুলো সত্যি হলে সেটা আরও বিব্রতকর।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে প্রকাশ্যে কিল ঘুষি মারার অভিযোগ ওঠে রাজশাহী-১ আসনের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে। ১৫ মিনিট ধরে পেটানো হয় শিক্ষককে। এ নিয়ে তোলপাড় চলছে রাজশাহীতে। এমপি এবং মার খাওয়া শিক্ষক প্রথমে অস্বীকার করেন। ১৪ জুলাই সংসদ সদস্যকে পাশে নিয়ে ওই অধ্যক্ষ দাবি করেন এমপি ওমর ফারুক তাকে পেটাননি, অধ্যক্ষ ফোরামের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে তারা নিজেরাই তর্কে জড়ান, একপর্যায়ে ধাক্কাধাক্কি হয়। সংসদ সদস্য তাদের নিবৃত্ত করেন। আর সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই অভিযোগ অস্বীকার করেন সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী। তিনি দাবি করেন, তাঁকে ঘিরে বারবার চক্রান্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাঁকে হেয় করতেই এ কাজ করিয়েছেন। তবে পরবর্তীতে এমপির সাথে শিক্ষকের ফাঁস হওয়া কথোপকথনে মারধরের বিষয়টি পরিষ্কার হয়।
এ বিতর্কের রেস কাটতে না কাটতেই কুমিল্লা-৪ আসনের সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের বিরুদ্ধে কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদকে মারধরের অভিযোগ ওঠে। ভুক্তভোগী বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। উপজেলা চেয়ারম্যানের দাবি, গত শনিবার জাতীয় সংসদের মেম্বারস ক্লাবে দেবিদ্বার উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সভায় ইউনিয়ন কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে এ হামলার ঘটনা ঘটে। কমিটি পছন্দ না হওয়ায় সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুল ক্ষিপ্ত হয়ে আবুল কালাম আজাদকে কিলঘুষি মারেন।

বরগুনা-২ আসনের এমপি শওকত হাচানুর রহমান রিমন ২১ মে বরগুনার পাথরঘাটার হরিণঘাটা বাজারসংলগ্ন স্লুইসঘাট এলাকায় সালিশি বৈঠক ডেকে এক মাছ ব্যবসায়ীকে চড়থাপ্পড় মারেন। ফোরকান মিয়া নামের ওই মাছ ব্যবসায়ী বাকিতে সিগারেট না পেয়ে মারধর করেছিলেন এক দোকানিকে। এ ঘটনায় নালিশ পেয়ে সালিশ ডাকেন এমপি রিমন। এরপর শাস্তি হিসেবে নিজেই চড়থাপ্পড় দেন অভিযুক্ত ফোরকানকে। ফোরকানের অভিযোগ, তিনি বরগুনার সংরক্ষিত (নারী) আসনের এমপি সুলতানা নাদিরার সমর্থক। নাদিরার সমর্থক হওয়ার কারণেই তাঁকে ইচ্ছাকৃতভাবে মেরেছেন এমপি রিমন। এমপি নাদিরার বাড়িও পাথরঘাটায়। এমপি রিমন মারধরের কথা স্বীকার করে সে সময় গণমাধ্যমকে বলেন, ‘একজন মসজিদের ইমামের শরীরে হাত দিয়ে ফোরকান গুরুতর অন্যায় করেছেন। মুসল্লিদের চাপের মুখে এ সালিশ করতে বাধ্য হয়েছি।’ এছাড়া ২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সংসদ সদস্যের মোটরসাইকেল বহরকে সাইড না দেওয়ায় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও মাছ ব্যবসায়ী মো. নজরুল ইসলামকে (৩৮) বেধড়ক মারধর করেন একই এমপি শওকত হাচানুর রহমান রিমন।

১৯ মে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ সরকারি মাহতাব উদ্দীন কলেজের দুই সহকারী অধ্যাপককে পেটানোর অভিযোগ ওঠে ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারের বিরুদ্ধে। লাঞ্ছিত দুই শিক্ষক হলেন পদার্থবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন ও গণিতের সহকারী অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেন। শিক্ষক পেটানোর ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় জেলাজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর ডেমরা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক ও স্ট্যাম্প-ভেন্ডার কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেনকে ঢাকা-৫ আসনের এমপি কাজী মনিরুল ইসলাম মনু মারধর করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, চেয়ার দিয়ে মারধর করার পাশাপাশি ভুক্তভোগীর মাথা লক্ষ্য করে পানির গ্লাস ছুড়ে মারেন সংসদ সদস্য। গালাগালের পাশাপাশি হত্যার হুমকিও দেন তিনি। সে সময় গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি ওই সংসদ সদস্য।

নানা আলোচনা-সমালোচনায় থাকা কক্সবাজার-৪ আসনের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি টেকনাফে দলের বর্ধিত সভায় তিন নেতাকে পিটিয়ে আলোচনায় আসেন। মারধরের শিকার নেতারা হলেন- টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. ইউছুফ মনো, পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্মসম্পাদক মো. ইউছুফ ভুট্টো ও উপজেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক অ্যাড মাহমুদুল হক। নেতাদের পেটানোর একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা গেছে, বদির সঙ্গে তার ভাই আবদুস শুক্কুর ও কয়েকজন নেতা মিলে তাদের পেটাচ্ছেন।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ইনকিলাবকে বলেন, দলীয় শৃঙ্খলার বাইরেও ব্যক্তি শৃঙ্খলা সবারই থাকা উচিত। ব্যক্তি কোন কর্মকান্ডের দায় দল কখনো নেবে না। তবে সামগ্রিকভাবে দলীয় এমপি বা নেতাদের বেপরোয়া কর্মকান্ডের দায় দলের উপরই পড়ে। তাই সবারই বিচার বিবেচনা করে কথা বলা, নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের সাথে আচরণ করা উচিত। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া উচিত না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন