নড়াইল ছোট্ট জেলা। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের কারণে নাড়াইল জেলার নামটি দেশের মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত। ওই জেলার সন্তান মাশরাফি বিন মুর্তজা জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ছিলেন। ক্রিকেটার হওয়ার সুবাদে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকারি দলের নমিনেশন পেয়ে তিনি নড়াইল-২ আসন থেকে এমপি হন। তার বক্তব্য ‘এই নড়াইলকে তো আমি চিনি না’ এবং ‘মানুষকে শান্তিতে থাকতে দিন, লড়াই আমার সাথে করুন’ ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইউটিউবে ব্যাপক বিতর্কের ঝড় তুলেছে। নেটিজেনদের কেউ হিন্দি ভাষায় লিখেছেন, ‘মাশরাফি হিরো বানগেয়া’। কেউ বলেছেন, ‘মাশরাফি বিন মুর্তোজা কী ডাবল মোদী হতে চান?’ সাবেক এই ক্রিকেটারকে নিয়ে নানান জনে নানান মন্তব্য করছেন। প্রশ্ন হলো খেলোয়াড়ি জীবনে অবসান ঘটিয়ে এমপি হয়ে মাশরাফি কার সাথে লড়াই করতে চান? ক্রিকেট খেলায় মাঠের ২২ গজের ভিতরের লড়াই কী তিনি এমপি হয়ে করতে চান? আর নড়াইলকে হঠাৎ চিনতে পারছেন না কেন? নাকি হঠাৎ করে হিরো হতে বা কাউকে খুশি করতে তার এই আবির্ভাব? মাশরাফির সেই বক্তব্য দেশের কিছু গণমাধ্যম ফলাও করে প্রচার করছে। এ নেপথ্যের কী রহস্য? এদিকে ঢাকায় অধ্যাপক রতন সিদ্দিকীর বক্তব্য কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে? ইসলাম ধর্ম ও মুসলমাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো কি প্রগতিশীলতা?
নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া এলাকার কলেজছাত্র আকাশ সাহা গত ১৫ জুলাই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে কট‚ক্তি করে তার ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। ঐদ্ধত্যপূর্ণ এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা দিঘলিয়া বাজারে হামলা করে। এ সময় একটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ একপর্যায়ে শটগান দিয়ে ফাঁকা গুলি করে। পরে খুলনা থেকে আকাশ সাহাকে গ্রেফতার করা হয় এবং বর্তমানে সে রিমান্ডে। এরপর ঢাকা থেকে এলাকায় গিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হিন্দু সম্প্রদায়কে সহায়তা করেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। সেখানে এবং ফেসবুকে তিনি নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন। ক্রিকেটার মাশরাফির এলাকা পরিদর্শন এবং তার সহায়াতার সচিত্র খবর ফলাও করে প্রচার করে কিছু গণমাধ্যম। অথচ মহানবী (সা.) কটূক্তি করার খবর দেয়নি।
প্রশ্ন হলো হঠাৎ করে নড়াইলে কী এমন ঘটনা ঘটেছে? স্থানীয় এমপি মাশরাফির কাছে নিজের জেলা অপরিচিত হয়ে গেল? এক মাস আগে গত ১৮ জুন নড়াইল সদর উপজেলার ইউনাইটেড কলেজের ছাত্র রাহুল দেব রায় মহানবী (সা.) কটাক্ষকারী ভারতের বিজেপি থেকে বহিস্কৃত নুপুর শর্মার বক্তব্য সমর্থন করে ফেসবুকে পোস্ট দেন। এ ঘটনার পর কলেজের ছাত্ররা প্রতিবাদ করেন এবং পোস্টটি মুছে ফেলার দাবি জানান। তিন দিন পোস্টটি মুছে না ফেলায় বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ওই রাহুল দেব বর্মণকে ধরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের কাছে নিয়ে যান বিচারের জন্য। অধ্যক্ষ নিজে ছাত্রকে শাসন না করে পুলিশ ডাকেন। তিনি নিজে ছাত্রকে দু’একটা চড়থাপ্পর দিয়ে সবার সামনে ভুল স্বীকার করে পোস্টটি মুছে ফেলে বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে পারতেন। তা না করে তিনি পুলিশ ডাকলেন কেন? এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক বিতর্ক। মূলত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস ‘মহানবী (সা.) অবমাননা’ ঘটনাকে বড় করে না দেখে হিন্দু ছাত্রের বাক-স্বাধীনতার রক্ষার প্রতি জোর দেন। বিক্ষুব্ধ মানুষ অপ্রীতিকর কাÐ ঘটায়। অধ্যক্ষের এই অমার্জনীয় নির্বুদ্ধিতার সুযোগ নিয়ে দেশের তথাকথিত প্রগতিশীল কিছু মানুষ ও কিছু গণমাধ্যম সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে ঘটনার খবর অধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে। দেশের ওই মিডিয়াগুলো ফলাও করে ওই খবর প্রচারের মাধ্যমে বিশ্ববাসী বিশেষ করে প্রতিবেশি ভারতকে জানান দেয় বাংলাদেশে হিন্দুরা নিরাপদ নয়। এটা কি সৎ সাংবাদিকতা?
দেশে শিক্ষক ও গুরুজনদের গায়ে হাত তোলার অসংখ্য অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষকদের চ্যাংদোলা করে পানিতে ফেলে দেয়া, রুমে আটকে রাখা, কান ধরো উঠবোস করানোর মতো আসংখ্য অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। অনাখাক্সিক্ষত এসব ঘটনার খবর ওই গণমাধ্যমগুলোকে তেমন গুরুত্ব পায়নি। দেশের কত মানুষের উপর প্রতিদিন জুলুম নির্যাতন চলছে; সেগুলো ঘটনাকে খবর হিসেবে গুরুত্ব দেয়া হয় না ওই গণমাধ্যমগুলোতে। তবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেই শিরোনাম হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে তার তিলকে তাল বানিয়ে ছাড়ে। প্রশ্ন হচ্ছে ওই সব গণমাধ্যম কার স্বার্থ রক্ষা করছেন? কাকে খুশির করতে এবং কার অনুকম্পা পেতে এমন সম্পাদকীয় নীতি গ্রহণ করছেন? অনেক হিন্দুধর্মাবলম্বী বাংলাদেশে চাকরি করে ভারতে বাড়ি করছেন। পি কে হালদারের মতো অসংখ্য মানুষ বাংলাদেশের টাকা ভারতে পাচার করে সেখানে স্থাপনা গড়ছেন, ব্যবসা করছেন। অন্যদিকে ভারতের প্রায়ই মুসলমানদের উপর জুলুম নির্যাতন করা হচ্ছে। হিন্দুত্ববাদী বিজেপির এক ধর্মের ‘রামরাজত্ব’ কায়েমের নীতি ও কৌশলে আসামে মুসলমানদের বসবাস করাই কঠিন হয়ে পড়ছে। এসব নিয়ে ওই গণমাধ্যমগুলোর কোনো খবর নেই। তারা দিল্লিকে বিশেষ করে কঠোর হিন্দুত্ববাদী মোদী সরকারকে খুশি করতে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে ফলাও করে প্রচারের মাধ্যমে হিন্দু নির্যাতিত দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছেন।
অথচ বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই। সাংবিধানিকভাবে সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষ এক এবং অভিন্ন। বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বদরবারে অহংকার করার মতো ইতিহাস হলো নানান ধর্ম ও জাতের মানুষের সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতিতে বসবাস। ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধসহ সব ধর্মের মানুষ এক সঙ্গে বসবাস করেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজায় মুসলমান বন্ধুরা যান; আবার মুসলমানদের ঈদ উৎসবে হিন্দু বন্ধুরা যান। শত শত বছর ধরে সব ধর্মের মানুষ এক সঙ্গে বসবাস করছেন; একই বাজারে কেনাকাটা করছেন; একই মার্কেটে ব্যবসা করছেন। ইসলাম বিদ্বেষী কিছু সংস্কৃতিসেবী, তথাকথিত প্রগতিশীলতার নামে কিছু গণমাধ্যম এবং কিছু ব্যাক্তি মুসলিম ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ভেদরেখা টেনে দেয়ার চেষ্টা করছেন। এতে তারা মোদী ও ভারতের আরএসএসের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিজেদের পকেট ভরাতে পারলেও বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সৌহার্দ্যরে চিড় ধরাতে পারেননি। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলে হিন্দু-মুসলিম ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে একে অপরের পাশে দাঁড়ান। একে অপরের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। প্রশ্ন হলো এক মাস আগে এতো বড় ঘটনা নড়াইলে ঘটে গেছে। ঘটনার পর এতো কাÐ-অপকাÐ ঘটেছে; তখন মাশরাফি বিন মুর্তজা কী ঘুমিয়ে ছিলেন? তখন কী তিনি নড়াইলকে চিনতে পেরেছেন? এখন হঠাৎ করে চিনতে পারছেন না?
এসব ঘটনা নিয়ে ফ্রান্সে বসবাসকারী প্রখ্যাত লেখক, গবেষক ডা. পিনাকি ভট্টাচার্য ইউটিউবে প্রচারিত তার একটি বিশ্লেষণধর্মী বক্তব্যে বলেছেন, মারশাফি বিন মুর্তজা আপনি কেমন নড়াইল চান? এর আগে নুপুর শর্মাকে সমর্থন করে যে পোস্ট দেয়া হয়েছিল তখন কি সমস্যার সমাধান করতে পেরেছেন? মহানবী (সা.) কে কটূক্তির কারণে বিজেপি থেকে নুপুরকে বহিস্কার করে মোদী ভারতেই পরাজিত হয়েছেন। আর আপনারা বোঝাতে চান ভারতে মোদী হারতে পারে বাংলাদেশে দেখিয়ে দিলাম! মাশরাফি বিন মুর্তজা কী ডাবল মোদী হতে চান?
এখানে প্রণিধানযোগ্য আরেকটি ঢাকার ঘটনা তুলে ধরছি। রাজধানী ঢাকার শুক্রবার জুম্মার নামাজের সময় মসজিদে জায়গা না হওয়ায় মুসল্লিদের অনেকেই সামনের রাস্তায় জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করেন। এটা বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। গত ১ জুলাই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী ঢাকার উত্তরার বাসায় ফেরার সময় নামাজ আদায়রত মুসল্লিরা তার গাড়ি যাওয়ার সাইড দেননি। পরে নাকি তার বাসায় হামলার ঘটনা ঘটে। এই খবরও কিছু ইংরেজি-বাংলা গণমাধ্যম ফলাও করে প্রচার করে। তারা অধ্যাপক রতন সিদ্দিকীর বক্তব্য ফলাও করে প্রচার করেন।
এ ঘটনার প্রতিবাদ সমাবেশের ভিডিও বক্তব্যসহ ইউটিউবে পোস্ট করেছেন পিনাকি ভট্টাচার্য। রামেন্দ্র মজুমদার, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, মুনতাসির মামুনসহ কিছু সাংস্কৃতি ব্যাক্তিত্বের উপস্থিতিতে ওই প্রতিবাদ সমাবেশে অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী বলেন, ‘আমার জন্ম মুসলমানের ঘরে। এই ৬০ বছর বয়সে এসেও মুসলমান হিসেবে পরিচয় দেই না। লজ্জা লাগে। আমাদের জীবন থেকে শুক্রবার হারিয়ে ফেলেছি। শুক্রবার বেহাত হয়ে গেছে। শুক্রবার আর আমাদের নেই’ (উল্লেখ শুক্রবার জুম্মাবার হওয়াকে বুঝিয়েছেন)। জুম্মাবারে মুসলমানরা মসজিদের জুম্মার নামাজা আদায় করেন এ জন্য অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী শুক্রবার হারিয়ে ফেলেছেন? প্রশ্ন হচ্ছে এই অধ্যাপক রতন সিদ্দিকীরা কাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন? ডা. পিনাকি ভট্টাচার্য বলেছেন, একজন মুসলমান যদি নিজেদের রামেন্দু মজুমদারের সামনে মুসলমান হিসেবে পরিচয় দেয় তাহলে কি রামেন্দ্র মজুমদার কষ্ট পাবেন? যতি তাই হয় তাহলে কেউ হিন্দু হয়ে নিজের পরিচায় দিলে তো মুসলমান কষ্ট পাবে। একে অপর ধর্মের নাম শুনে কষ্ট পায় এটা কেমন কথা? দেশকে তারা কোথায় নিতে চান?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন