রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই ভারতের মতো রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল ক্রয়ের প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। গত মঙ্গলবার একনেকের বৈঠক শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, রাশিয়ার কাছ থেকে সরাসরি জ্বালানি তেল কেনার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী উপায় খোঁজার নির্দেশনা দিয়েছেন। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন নির্দেশনা দেওয়ার পর কাজ শুরু করেছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয়। গতকাল বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি নিদের্শনা পাওয়ার পরে পরে জ্বালানি মন্ত্রণালয় এবং বিপিসি তেল আমদানীতে যাচ্ছে। তবে আপাতত ক্রুড অয়েল (অপরিশোধিত তেল) আমদানিতে যাচ্ছে সরকার। তা আগামী এক মাস আগে আমদানি করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কারণ দেশে মাত্র ৩০ দিনের ডিজেল এবং ১৮ দিনের অকটেন ও পেট্রল মজুত আছে। সে জ্বালানি তেল শেষ হওয়ার পথে বলে জানা গেছে। এদিকে জ্বালানি তেলের বাজার খুজতে আমেরিকা গেছেন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করর্পোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ।
রাশিয়া থেকে ভারতের তেল আমদানি প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ভারতের সক্ষমতা আছে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করার, সেই সক্ষমতা যদি আমরা করে নিতে পারি, তাহলে অবশ্যই আমরা আনতে পারব। তবে সেটি হয়তো সময়সাপেক্ষ।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের পরিচালক (অপারেশন্স ও পরিকল্পনা) ও অতিরিক্ত সচিব খালিদ আহম্মেদ ইনকিলাবকে বলেন, আমরা আপাতত ক্রুড অয়েল (অপরিশোধিত তেল) আমদানি করতে চাই। পরিশোধিত তেল আমদানিতে খরচ বেশি পড়ে। সেক্ষেত্রে ক্রুড অয়েল কিছুটা কম খরচে আমদানি করা যায়। দেশে আসা অপরিশোধিত তেল রিফাইনারীতে পরিশোধিত হয়ে বাজারজাত হয়। দেশে অবস্থিত ইস্টার্ণ রিফাইনারী লিমিটেডের (ইআরএল) তেল পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন। যা চাহিদার তুলনায় বেশ কম। তিনি বলেন, ইস্টার্ণ রিফাইনারীর সক্ষমতা বাড়তে কাজ চলছে। ইআরএলের দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে। এ ইউনিট নির্মিত হলে তেল পরিশোধনের সক্ষমতা গিয়ে দাঁড়াবে ৪৫ লাখ টনে। যা আমদানি খরচের চাপ অনেকটাই কমিয়ে দেবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের উচিৎ রাষ্ট্রীয় সংস্থার ওপর নির্ভর না করে ব্যক্তি খাতে জ্বালানি তেলের অনুমতি দেয়া। এতে প্রতিযোগিতা বাড়বে, পরিবর্তন আসবে জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতিতে। এলপিজি গ্যাসের ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতকে জড়িত করার পর নৈরাজ্য অনেকটাই কমে এসেছে। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন যে, বিপিসিকে লোকসানের হাত থেকে বাঁচাতে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, বিপিসির পিঠ এখন দেওয়ালে গিয়ে ঠেকায় পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। বিপিসি তেল আমদানি বন্ধ করতে প্রায় বাধ্যই হচ্ছিল। মূল্য সমন্বয় করা ছাড়া হাতে অন্য কোনো বিকল্প ছিল না।
সরকার চাইলেই জ্বালানি তেলের কর প্রত্যাহার বা কমিয়ে মূল্যবৃদ্ধি এড়ানো যেত বলে মনে করছে তারা। ভর্তুকি সম্পদের অপচয় করে। এছাড়া এটি ধনী-গরিব সবাই পায়। তাই ভর্তুকি তুলে দিতেই হবে। এটি আইএমএফের শর্তে হোক বা না হোক। এটি অবশ্য ধীরে ধীরে করা যেত। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দুর্নীতি-অপচয় বন্ধ করতে না পেরে জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্যবৃদ্ধি জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) লাভ-লোকসানের হিসাব জনগণের সামনে প্রকাশের দাবি জানিয়ে সিপিডি বলছে, গত ছয় বছরে বিপিসি ৪৬ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। সেখান থেকে সরকার নিয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৩৬ হাজার কোটি টাকা কোথায়? বলা হচ্ছে, ওই টাকার মধ্যে ৩৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু কোথায় সেই বিনিয়োগ হয়েছে সে তথ্য জনসম্মুখে আনা হোক। তাছাড়া তেল বিক্রি থেকে চলতি বছরও বিপিসি ১ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা লাভ করেছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে জানায় সিপিডি।
সিপিডির সিনিয়র গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন সূত্রে যে খতিয়ান দেখতে পাই, তাতে নিজস্ব অর্থায়নে ১১টি প্রকল্পের তথ্য পেয়েছি। সেখানে ব্যয় হবে ৮ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। এর মধ্যে মাত্র পাঁচটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। বাকিগুলো বন্ধ। তাহলে বিপিসির টাকা কোথায়? আমরা অবশ্য জানতে পেরেছি বিভিন্ন ব্যাংকে বিপিসির ২৫ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা জমা রয়েছে। তাহলে ওই টাকা কোন টাকা? এছাড়া বাকি টাকা কোথায়? আমার ধারণা বাকি টাকাও বিপিসির হিসাবেই রয়েছে। আর তাই যদি হয়, তাহলে কেন লোকসান দেখিয়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো? তিনি আরো বলেন, চলতি অর্থবছরেও ৫ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে বিপিসি। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, জনগণের মাথায় বোঝা চাপিয়ে বিপিসি কোথায় বিনিয়োগ করবে?
বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, ভর্তুকি প্রত্যাহার সমর্থন করি কিন্তু যেভাবে করা হয়েছে, এটাকে সমর্থন করি না। দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে খারাপ সময়ে সরকার জ্বালানি তেলের কর তুলে দিতেই পারে। বরং দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের ওপর পরোক্ষ কর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
এটা ভয়ঙ্কর বৈষম্যমূলক।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ছয় মাসে (ফেব্রুয়ারি-জুলাই) বিপিসির লোকসান ৮ হাজার কোটি টাকা। এ সময় দৈনিক লোকসান গুণতে হয়েছে ৯০ কোটি টাকা। লোকসান ঠেকাতে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও বিপিসির লোকসানের অঙ্ক দেখিয়ে বৃহস্পতিবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সরকার। ৯ মাসের বিরতিতে তেলের দাম গড়ে ৪৭ শতাংশ বাড়ানো হয়। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের ২২ মে পর্যন্ত প্রতি বিপিসি মুনাফায় ছিল। ২০২১-২০২২ অর্থবছরের মে (২০২২) পর্যন্ত বিপিসি মুনাফা করেছে ১ হাজার ২৬৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের তথ্য অনুসারে, নিয়মিত পরিচালন খরচ এবং অন্যান্য কর দেওয়ার পরও বিভিন্ন ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট হিসাবে বিপিসির রয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যমান আমানতের টাকা দিয়ে আরো ১৪ মাস তেল সরবরাহ করতে পারতো বিপিসি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব অফসাইট সুপারভিশনের তথ্যমতে বিপিসির তিনটি বিতরণকারী কোম্পানি Ñপদ্মা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড ও যমুনা অয়েল কোম্পানির ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যাংক আমানত রয়েছে বলে। এই আমানত দিয়ে আাগের দামে আরো পাঁচ মাস তেল বিক্রি করতে পারতো কোম্পানিগুলো।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন