শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুর রব সাদী

| প্রকাশের সময় : ৫ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুজিবুর রহমান মুজিব : বৃহত্তর সিলেটের কৃতিসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবসেক্টর কমান্ডার মাহবুবুর রব সাদী বীরপ্রতীক গত ১৬ অক্টোবর রাত আড়াইটায় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চুয়াত্তর বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। তার কৈশোর-যৌবনকাল- সেই ষাটের দশক থেকেই তার সঙ্গে পরিচয়। সম্পর্ক ও সখ্য আজীবন অটুট ছিল। তিনি আমার বয়ঃজ্যেষ্ঠ, অগ্রজ প্রতীম।
১৬ অক্টোবর সাত সকালেই দুঃসংবাদটি দিলেন সাদী ভাইর আত্মীয় বন্ধুবর সৈয়দ নাসিরুদ্দীন। বললেন, দোস্ত সাদী মামু আর নেই। সবাইকে জানাজার দাওয়াত দিও। সাদী ভাইয়ের আকস্মিক মৃত্যু সংবাদে মর্মাহত হলাম। পরিণত বয়সের মৃত্যু হলেও সকল মৃত্যুই পীড়াদায়ক। সাদী ভাইয়ের মৃত্যু একেবারে অসময় ও অবেলায় না হলেও ছিল আকস্মিক। পা ভেঙে আমি শয্যাশায়ী। জানাজায় যাবার উপায় নেই। ইতোপূর্বে নবীগঞ্জের দুই কৃতিসন্তান সাবেক মন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজী এবং নবিগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান প্রিয় সতীর্থ দেওয়ান গোলম সরোয়ার হাদী গাজীর নামাজে জানাজায় যোগ দিয়েছিলাম। সাদী ভাই ষাটের দশকে মৌলভীবাজার কলেজের ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন। হবিগঞ্জ আমাদের নিকট প্রতিবেশী জেলা। এই দুই জেলার জনগোষ্ঠীর মধ্যে আসা-যাওয়া, আত্মীয়তা-বন্ধুত্ব, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুসম্পর্ক বিদ্যমান। আমি শয্যাশায়ী থাকা অবস্থায়ও সাদী ভাইর মৃত্যু সংবাদ এবং নামাজে জানাজায় যোগদানের জন্য অনেককেই অনুরোধ করলাম। সামাজিক আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সংগটক এম এ রহিম সামাজিক যোগাযোগে খুবই পারঙ্গম। তিনি সাদী ভাইর নামাজে জানাজায় যোগ দিয়ে এসে জানালেন, নবীগঞ্জবাসী তাদের যোগ্য সন্তানকে যথার্থ সম্মান দিয়েছে। পেশা-দল-মত-বয়স নির্বিশেষে বিপুলসংখ্যক মানুষ জানাজায় উপস্থিত হন।
শুনেছি, একজন সাবেক সংসদ সদস্য হিসাবে সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় দ্বিতীয় দফা নামাজে জানাজা হয় মাহবুবুর রব সাদীর। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। তার মরদেহের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আব্দুল হামিদের পক্ষে তার সহকারী সামরিক সচিব, ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া, হুইপ শাহাব উদ্দিন প্রমুখ। জানাজা-পূর্ব আলোচনায় তার কর্ম ও জীবন দর্শনের উপর আলোচনা করেন মৌলভীবাজার-১ এর সাংসদ ও হুইপ শাহাব উদ্দিন আহমদ, মহিলা এমপি আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী, মৌলভীবাজার-২ এর সাবেক সদস্য কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ প্রমুখ। নামাজে জানাজায় উপস্থিত ছিলেন আব্দুল মতিন খসরু এমপি, উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ এমপি, মঈনুদ্দীন খান বাদল এমপি এবং নাজমুল হক প্রধান এমপি এবং সাবেক এমপি ও মন্ত্রী জেএসডি প্রধান আসম রব প্রমুখ।
মাহবুবুর রব সাদী সরকারদলীয় কোন প্রভাবশালী নেতা কিংবা আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী, মোসাহেব কিংবা চাটুকার ছিলেন না। শৌখিন সঙ্গীতশিল্পী হলেও তিনি কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন গাইতেন না। তিনি নিজেই গণসঙ্গীত লিখতেন, সুরারোপ করে নিজ ইচ্ছামত মনের সুখে গাইতেন। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বিনা পয়সার ডাক্তার মধু কবিরাজ মারা গেলে সাদী ভাই করুণ সুরে গাইতেন, ‘মারা গেছে আজ মধু কবিরাজ।’ কয়েক দশক পূর্বে সাদী ভাইয়ের গাওয়া এই করুণ গানের কথাও সুর আমার কানে বাজে। পতাকায় আচ্ছাদিত হলেও পতাকা শোভিত কোন মন্ত্রী-উপমন্ত্রী, শাসকদলের কোন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে এই অকুতভয় বীরের জানাজায় দেখা যায়নি। মাহবুবুর রব সাদী ছিলেন সাবসেক্টার কমান্ডার এবং একজন খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেক্টার কমান্ডার্স ফোরামের কোন কর্মকর্তা কিংবা কোন সেক্টর কিংবা সাবসেক্টর কমান্ডারকে দেখা যায়নি তার অসুখে খোঁজখবর নিতে।
১৯৪৫ সালের ১০ মে নবীগঞ্জ উপজেলাধীন বিখ্যাত বনগাঁও গ্রামে এক খান্দানী পরিবারে সাদীর জন্ম। তার বাবা দেওয়ান মামুন চৌধুরী ভূস্বামীও বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। বাল্যকাল থেকে সাদী যেমনি ডানপিঠে তেমনি মেধাবী ও বুদ্ধিমান ছিলেন। শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান সাদী ষাটের দশকের শুরুতে মৌলভীবাজার কলেজের ছাত্র ছিলেন। হবিগঞ্জের নিকট প্রতিবেশী মহকুমা মৌলভীবাজার কলেজের তৎকালেই খুব নামডাক ছিল। সেকাল থেকে একালে মৌলভীবাজার অঞ্চলে সাদী পরিবারের আত্মীয়তা ও বন্ধুত্বের বন্ধন বিদ্যমান ছিল। আছেও। বাষট্টি সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কুখ্যাত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। সে সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ একটি শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন ছিল। তিনি ছিলেন তার একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই আসামের লোহার বন্দ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সরাসরি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব প্রদান করেন মাহবুবুর রব সাদী। তার বীরত্ব ও কৃতিত্ব দেশ ও জাতি চিরকাল কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে। মুক্তিযুদ্ধের চার ও পাঁচ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন যথাক্রমে মেজর সিআর দত্ত (পরবর্তী পর্যায়ে মেজর জেনারেল। বীরউত্তম) এবং মেজর মীর শওকত আলী (পরবর্তী পর্যায়ে লেঃ জেনারেল। বীরউত্তম। মন্ত্রী। পরলোকে।) এই দুই সামরিক কর্মকর্তা এবং বৃহত্তর সিলেটের সকল এমএনএ এবং এমপি-এর সঙ্গে তার সম্পর্কের সুবাদে তার কাজ, যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও পারিচালনায় সুবিধা হয়েছে, কোন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়নি। কানাইঘাট থানা আক্রমণ এবং শত্রু সেনাদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে শত্রু নিধন, থানা দখল, ব্যাপক অঞ্চল শত্রু মুক্ত করা ও রাখা তার দুঃসাহস ও দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে সিভিলিয়ান ফ্রিডম ফাইটারদের মধ্যে এনামুল হক চৌধুরী (মরহুম), ইয়ামীন চৌধুরী (মরহুম) সহ যে কয়জন খেতাবপ্রাপ্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে তিনিও অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধের বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের খেতাব প্রদানের ক্ষেত্রে যথাযথ মূল্যায়ন না করার প্রতিবাদে আজীবন প্রতিবাদী ও নির্লোভ মাহবুবুর রব সাদী বীরপ্রতীক খেতাব প্রত্যাখ্যান করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্তগণ খেতাব অনুযায়ী ভাতা এবং সরকারি সযোগ-সুবিধা পান কিন্তু তিনি ছিলেন নির্লোভ ও নির্মোহ। তিনি পদ-পদবির ভাঙ্গিয়ে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের পক্ষপাতি ছিলেন না।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কঠিন সময় ও অস্থির রাজনীতির মাঝে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ জন্ম নিলে দলের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রভাবশালী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন আজীবন গণমুখী বীরযোদ্ধা আখতার আহমদ ও মাহবুবুর রব সাদী। মাহবুবুর রব সাদী নিজ নির্বাচনী এলাকা নবীগঞ্জ-বাহুবল থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য ও নির্বাচিত হন। পদ-পদবির প্রভাব খাটিয়ে প্লট-ফ্ল্যাট বাণিজ্য কিংবা দুর্বৃত্তায়ন করেননি। পরবর্তীকালে জাসদে-হটকারিতা, বিভ্রান্তি, বিভক্তি এলে মনের দুঃখে জাসদের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে গণতন্ত্রের চর্চা ও অনুশীলনের জন্য তিনি অরাজনৈতিক সংগঠন গণতন্ত্র অনুশীলন কেন্দ্র গঠন করেন।
গত দশকে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান আমার সঙ্গে হবিগঞ্জ বিএনপি পুনর্গঠন নিয়ে কথা বলেন এবং নবীগঞ্জ এলাকায় খ্যাতিমান কাউকে যোগদান করানো যায় কিনা সে চেষ্টা করতে বলেন। এলাকাটি আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা দেওয়ান ফরিদ গাজীর নির্বাচনী এলাকা। এই নির্বাচনী এলাকায় বিএনপির কোন শক্তিশালী প্রার্থী ছিলেন না। বর্তমানে হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং সাবেক সাংসদ শেখ সুজাত মিয়া তখনও বিএনপিতে যোগ দেননি। তার যোগদানের ফলে এলাকায় নেতৃত্ব সংকট দূরীভূত হয়েছে। এম সাইফুর রহমানকে আমি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে কোন পরামর্শ দিতাম না। তিনি ইচ্ছা করলে আমার কাছে যে কোন বিষয়ে মতামত চাইতেন। আমি মাহবুবুর রব সাদীর কথা বলি। তার সঙ্গে ব্যক্তিগত জানাশুনা ছিল না এম সাইফুর রহমানের। আমি এস বি চৌধুরীর ভাই বলতেই তিনি সানন্দে সম্মতি দিলেন। এম সাইফুর রহমান এস বি চৌধুরী সাহেবকে খুব ভালোভাবেই জানতেন। এম সাইফুর রহমানের পক্ষ থেকে পূর্ণ মন্ত্রীত্বের প্রস্তাব নিয়ে আমি সাদী ভাইয়ের অফিসে দেখা করি। প্রস্তাবটি শুনে সদা হাসি-খুশি সাদী ভাই গম্ভীর হয়ে যান। আমার দিকে প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে তাকান। আমি শুধু বলি। সাদী ভাই, আপনি দেশের জন্য কাজ করুন। দেশ ও জাতিকে আপনার অনেক কিছু দেবার আছে। যে পতাকার জন্য আপনি জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছেন, আপনার গাড়ি-বাড়িতে সেই পতাকা শোভিত হোক। সাদী ভাই আমার প্রস্তাবে নীতিগতভাবে ঐকমত্য পোষণ করে এম সাইফুর রহমানের চায়ের দাওয়াত গ্রহণ করতে সম্মতি প্রকাশ করেন।
কাজি নূরুন্নবীর সহায়তায় মাস কয়েক দূতিয়ালি করে আমি সাইফুর-সাদী-বৈঠকের ব্যবস্থা করি। সাদী ভাইকে প্রথম দেখে, তাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক কথা শুনে খুবই বিমুগ্ধ হন এম সাইফুর রহমান। সাদী ভাইর প্রশংসা করে আমার পছন্দের তারিফ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাইফুর-সাদী বৈঠক কোন ইতিবাচক ফল দেয়নি। সাদী ভাই পূর্ণ মন্ত্রীত্বের অফার লুফে নেননি। দলীয় গণতন্ত্র প্রসঙ্গে তিনি কিছু প্রস্তাবনা পেশ করেন যা তাৎক্ষণিকভাবে মেনে নেয়া এম সাইফুর রহমানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ সেটা ছিল দলীয় গঠনতান্ত্রিক বিধি-বিধান, যা কাউন্সিল ছাড়া পরিবর্তন সম্ভব নয়। সাদী ভাইয়ের বিএনপিতে যোগদান সম্ভব হয়নি, যদিও মুক্তিযোদ্ধা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধাবোধ ছিল। শেষ জীবনে মাহবুবুর রব সাদী অভিমানে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সিনিয়র এডভোকেট, হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব। সাংবাদিক, কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন