মানুষের মনুষ্যত্ব যেসব কারণে মৃত্যুবরণ করে তার অন্যতম হচ্ছে অহঙ্কার। অহঙ্কারীর মধ্যে আনুগত্য থাকে না, সত্যগ্রহণের যোগ্যতা থাকে না, অন্যের গুণ স্বীকার করার মতো উদারতা থাকে না। সর্বোপরি তার মধ্যে ন্যায় ও অন্যায়বোধ থাকে না। সে হয়ে ওঠে নির্মম-নির্দয়; দুর্বলকে দয়া করতে এবং অপরাধীকে ক্ষমা করতে জানে না। সে হয়ে ওঠে বন্য ও অসভ্য; সৌজন্য ও শালীনতা তার মধ্যে থাকে না।
সে হয়ে ওঠে চরম স্বার্থপর; ত্যাগ ও পরার্থপরতা তার মধ্যে থাকে না। এভাবে একে একে মনুষ্যত্বের গুণ ও বৈশিষ্ট্য হারিয়ে সে হয়ে ওঠে চরম হিংস্র ও স্বৈরাচারী দু’পেয়ে প্রাণী। চার পাশের সকলের জন্য সে হয়ে ওঠে মূর্তিমান আতঙ্ক। তার জিহবা মানুষকে বিদ্ধ করে, হাত মানুষকে পীড়িত করে, তার পায়ের তলায় লাঞ্ছিত হয় মানুষ ও মনুষ্যত্বের মর্যাদা। তাই অহঙ্কার একটি ব্যাধিমাত্র নয়। এ হচ্ছে ‘উম্মুল আমরায’ সর্বব্যাধির শিকড়।
এই ব্যাধি যখন কারো মধ্যে বিস্তার লাভ করে তখন তার কলব ও রূহ অকেজো হয়ে পড়ে। তার রূহানিয়াত পারে না শয়তানিয়াতকে প্রতিরোধ করতে। অহঙ্কার রূহ ও কলবের অন্যায়-প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করে দেয়। অহঙ্কারী ভুলে যায় তার আত্মপরিচয়। সে মানুষের বন্ধু নয়, প্রভু হতে চায়। অহঙ্কারী তখন মানুষ থাকে না, মানবেতর প্রাণীও থাকে না, সে হয়ে যায় শয়তানেরও অধম। শয়তান সৃষ্টিকর্তার অবাধ্য হয়েছিল; স্রষ্টার আদেশ অমান্য করে বলেছিল=‘আমাকে তুমি আগুন দ্বারা বানিয়েছ আর তাকে বানিয়েছ মাটি দ্বারা।’
পক্ষান্তরে অহঙ্কারী মানব-সন্তানের কণ্ঠে ঘোষিত হয়েছে= ‘আনা রাববুকুমুল আলা।’ আমিই তোদের বড় খোদা। অহঙ্কারী মানব তার স্রষ্টাকেও অস্বীকার করেছিল। অহঙ্কারী ভুলে যায় তার পরিণাম। সৃষ্টির ঘৃণা ও অভিশাপ তাকে নিয়ে যায় সৃষ্টিকর্তার আযাব ও গযবের কাছে। প্রতিমুহূর্তে সে অগ্রসর হতে থাকে চিরলাঞ্ছনার অতল গহবরে দিকে। অথচ খাদের কিনারায় দাঁড়িয়েও তার বোধের উদয় হয় না। যখন হয় তখন আর সময় থাকে না।
তাই অহঙ্কার মানব-প্রবৃত্তির সবচেয়ে মারাত্মক প্রবণতা। এর চিকিৎসা হতেই হবে। ব্যক্তি ও সমাজে কোথাও তা বিকশিত হতে দেয়া যাবে না। কিন্তু চিকিৎসার উপায় কী? একটি সহজ সত্য এই যে, চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ সহজ। একটি মানব-শিশু যখন পৃথিবীতে আগমন করে তখন সে থাকে ঘুমন্ত। ধীরে ধীরে চার পাশের পরিবেশ তাকে জাগ্রত করে। তার সুকুমার বৃত্তিগুলো জাগ্রত হয় কিংবা কুপ্রবৃত্তিগুলো। সে হয়তো বিনয়ী ও হৃদয়বান হয় কিংবা উদ্ধত ও নির্মম হয়।
আমাদের চার পাশের পরিবেশে কি আছে বিনয়-শিক্ষার উপাদান? দুর্বলের প্রতি সদয় আচরণের চর্চা? পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে কি আছে ক্ষমা ও সহনশীলতার অনুশীলন? যদি না থাকে তাহলে কেন নেই? কেন আমরা জাতি হিসেবে এত রিক্ত ও নিঃস্ব? এই রিক্ততা তো সামান্য বিষয় নয়, এ তো আমাদের অস্তিত্বের সঙ্কট! এই নির্মমতা ও হৃদয়হীনতার পরিবেশে যে প্রজন্ম বেড়ে উঠছে তাদের কাছে আমরা কীভাবে আশা করব সহৃদয়তা। তাদের আচরণ যদি হয় নির্মম ও অশালীন তাহলে তো আশ্চর্যের কোনো কারণ নেই।
নতুন প্রজন্মের এই অধঃপতনের জন্য কি এ জাতির অভিভাবকদের কোনো দায় নেই? একজন পিতা কি দায় এড়াতে পারেন তার বখে যাওয়া সন্তানের? একজন শিক্ষক কি কোনো দায়িত্বই বহন করবেন না তার হিংস্র ও নির্মম ছাত্রটির? আজ যে যুবক বিপথগামী হয়েছে তার বিপথগামিতার কোনো দায়ই কি গ্রহণ করবেন না সমাজের কান্ডারিও অভিভাবকগণ!
এই সত্য অস্বীকারের কোনো উপায় নেই যে, আমাদের অপরাধের বোঝা ভারী হয়ে চলেছে। পিতা-মাতা, শিক্ষক-উস্তাদ, নেতা ও পরিচালক সকলেই আমরা অপরাধী, শুধু ব্যক্তি ও সমাজের কাছে নয়, শুধু ওই তরুণ যুবকটির কাছেও নয়, যে তার ভাইকে পায়ের তলায় পিষ্ট করতে পেরেছে; আমরা তো মহা অপরাধী আমাদের এবং ঐ যুবকের সৃষ্টিকর্তার কাছে।
আমাদের স্রষ্টা কি আমাদের দান করেননি আসমানী কালাম, যাতে আছে সকল ব্যাধির উপশম? আমাদের রব কি আমাদের মধ্যে পাঠাননি তাঁর রাসূল, যিনি ছিলেন মানবজাতির সর্বোত্তম আদর্শ? আমাদের সৃষ্টিকর্তা তো আমাদের পথ দেখিয়েছেন, কিন্তু আমরা সে পথে চলিনি। আলোর পথ ছেড়ে আমরা চলেছি অন্ধকারের পথে। মানবতার পথ ছেড়ে আমরা চলেছি পাশবিকতার পথে। তাই এখন চার পাশে শুধু শুনতে পাচ্ছি হায়েনার ডাক। একটি মানব-বসতি কীভাবে এমন বিরান হয়ে গেল? কেউ কি আছে, এই বিরান জনপদের ওপর দু’ফোঁটা অশ্রæ ফেলবে?
এখনো সময় আছে। আল্লাহ তাঁর কালাম এখনো উঠিয়ে নেননি। তাঁর রাসূলের সুন্নাহ এখনো আছে আমাদের মাঝে। এখনো সুযোগ আছে বিনীত হওয়ার, তওবা করে জুলুম ও পাপাচার ত্যাগ করার। আরহামুর রাহিমীনের ক্ষমার দুয়ার এখনো খোলা। কিন্তু একদিন তা বন্ধ হবে। যেদিন বন্ধ হবে সেদিন শত আর্তনাদেও তা আর খুলবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন