বিশ্বের বায়ু দূষণের শীর্ষের শহরগুলোর অন্যতম হচ্ছে ঢাকা। দেশের এ রাজধানী শহর বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে পড়ছে। নিয়ম-নীতি ও পরিবেশের তোয়াক্কা না করেই হাজার হাজার বহুতল ভবন নির্মাণ করায় ঢাকা এখন বিল্ডিংয়ের জঞ্জালের শহরে পরিণত হয়েছে। বিমান উঠানামার কারণে বাকি ছিল হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সেখানেও বিমান উঠানামার ঝুঁকিতে ফেলে ৫টি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। সরকারের ঘনিষ্ঠ এবং প্রভাবশালী ব্যবসায়ী হওয়ায় তাদের এসব সুউচ্চ স্থাপনা নির্মাণ করতে দেয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে যারা এসব বিল্ডিং নির্মাণ করেছেন তাদের চাওয়া-পাওয়াকে উপেক্ষা করার মতো অবস্থা সরকারের দায়িত্বশীলদের নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি এই বিমানবন্দর দিয়ে দেশে আসা যাওয়া করেন। অথচ এসব ভবনের ছাদ থেকে বিমান উঠানামার দৃশ্য দেখা যায়। ফলে নিরাপত্তার জন্য এসব স্থাপনা হুমকি হবে। শুধু তাই, এই ভবনগুলো চালু হলে দেশের সবচেয়ে ব্যস্ততম বিমানবন্দর সড়কে যানবাহন থমকে যাবে। যানজটের কারণে এ সড়কে চলাচল করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
জানতে চাইলে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মফিদুর রহমানকে ফোন এবং এসএমএস দিলে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বেবিচকের সাথে সমন্বয় করে বিষয়টি সুরাহা করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও কেপিআইডিসির সভাপতি মো. আশরাফ হোসেন বলেন, এগুলো অফিসিয়াল বিষয়, মিটিংয়ে আলোচনা হয়, সিদ্ধান্ত হয়। তবে এর বাইরে তিনি কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর স্থাপনা ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। চট্টগ্রাম ও সিলেটের দুটি বিমানবন্দরের চেয়ে এই বিমানবন্দরই বহিঃবিশ্বের সাথে যোগাযোগে বেশি ব্যবহৃত হয়। বিমানের উঠা-নামা ও নিরাপত্তার কারণে এর আশপাশের এলাকায় ৫ থেকে ৬ তলার ওপরে ভবন নির্মাণে বিধি-নিষেধ রয়েছে। কিন্তু কোনো ধরনের নিয়মনীতি না মেনে বিমানবন্দরের প্রবেশমুখেই গড়ে তোলা হয়েছে ৫টি বহুতল ভবন। এর ১টি ১২ তলা ৫ তারকা হোটেল, ১টি ১৩ তলা ৩ তারকা হোটেল ও ১টি ৬ তলা শপিং কমপ্লেক্স, ১টি ১২ তলা কার পার্কিং ও অফিস কমপ্লেক্স এবং ১টি ৩ তলা ব্যাংকুয়েট হল। এসব ভবন থেকে বিমানবন্দরের প্রতিটি স্পর্শকাতর স্থান দেখা যায়। স্পর্শকাতর ওই এলাকায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) কিভাবে বেসরকারি মালিকানায় ৫টি বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে? এছাড়া বিমানবন্দরের সামনের সড়কটি দেশের উত্তরের সাথে রাজধানীর যোগাযোগে ব্যবহৃত হচ্ছে। একারণে সর্বক্ষণই এটিতে যানজট লেগেই থাকে। কখনো কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হচ্ছে যাত্রীদের। এমন বাস্তবতায় বিমানবন্দরের পাশেই এসব ভবন চালু হলে ওই এলাকাজুড়ে চরম যানজট ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ট্রাফিক বিভাগ। এ অবস্থায় কেপিআই (কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন) কর্তৃপক্ষ, ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ), এনএসআই ও পুলিশের ট্রাফিক বিভাগসহ অন্যান্য কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র ছাড়া বিমানবন্দরের প্রবেশমুখের ৫টি ভবন যাতে কোনোভাবেই চালু করতে না পারে সেজন্য জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত কেপিআইডিসির সভায়।
এ ঘটনায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ২ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি শাহজালালের সীমানা প্রাচীর থেকে নির্মিত ভবনগুলোর দূরত্ব নির্ধারণপূর্বক প্রতিবেদন তৈরি করে বেবিচক ও কেপিআইডিসির কাছে পাঠানো হবে।
সভা সূত্রে জানা যায়, সভায় বলা হয় বিমানবন্দরের প্রবেশমুখে ৫টি বহুতল ভবন চালু হলে ব্যাপক যানজটসহ বিমানবন্দর দারুণভাবে নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। ফলে যেকোনো সময়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। বিমানবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর কেপিআই স্থাপনার কর্তৃপক্ষ সিভিল এভিয়েশন। বিমানবন্দরের সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ কোনো নিয়মনীতি অনুসরণ না করে কেপিআইয়ের ভ‚মিতে পাঁচ তারকা ও তিন তারকা হোটেল এবং মার্কেট নির্মাণ করার জন্য লীজ প্রদানের চুক্তির বিষয়টি অদূরদর্শিতার শামিল। এমনকি চুক্তির বিষয়টি কেপিআইডিসি’র সভাপতি ও জরিপ কমিটির সভাপতিকেও অবগত করা হয়নি।
জানা গেছে দেশের দুটি শীর্ষ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সামিট ও ইউনাইটেড গ্রæপের মালিকানাধীন এই ভবনগুলো নিয়ে এখন বড় ধরনের দুশ্চিন্তায় পড়েছে সরকার। ভবন নির্মাণের অনুমতি ও লিজ ছাড়পত্র দিয়েও বেকায়দায় আছে বেবিচক। ভবনগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হয়ে গেছে ২০২১ সালে। কিন্তু নানা বাধ্যবাধকতার কারণে এক বছর ধরে ভবনগুলো চালু করতে পারছে না। এ অবস্থায় বড় ধরনের অনিশ্চয়তায় পড়েছে ৪ হাজার কোটি টাকার বিশাল এই প্রকল্পটি।
জানা যায়, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সঙ্গে বিওটি ও ল্যান্ড লিজ চুক্তির আওতায় বাস্তবায়নাধীন ইপকো হোটেল প্রকল্পের জন্য আবেদন করেন ইপকো ডেভেলপমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড। আবেদনকারী ছিলেন ইপকোর নির্বাহী পরিচালক আবু রেখা খান। বেবিচক বিমানবন্দরের প্রবেশ মুখে ১৫ দশমিক ৭৪ একর জমিতে পাঁচ তারকা, তিন তারকা হোটেল এবং মার্কেট নির্মাণ করার জন্য কেপিআইডিসি’র অনুমোদন ছাড়াই সিঙ্গপুরের একটি সংস্থা ইপকো ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডকে ২০০০ সালে ৬০ বছরের জন্য লীজ প্রদান করে। ইপকো ডেভেলপমেন্ট ও বেঙ্গল গ্রæপ যৌথভাবে ২০০০ সালেই রাজউক হতে ইপকো হোটেলস ও শপিং কমপ্লেক্সের নামে নকশা অনুমোদন সাপেক্ষে বিমানবন্দর প্রবেশ মুখে উত্তর পার্শে¦ ও ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের পশ্চিম পার্শ্বে ডিটিসিএ, কেডিআইডিসি, এনএসআই এবং পুলিশ (ট্রাফিক) বিভাগসহ অন্যান্য সংস্থার ছাড়পত্র না নিয়ে একটি ১২ তলাবিশিষ্ট পাঁচ তারকা হোটেল, একটি ১৩ তলাবিশিষ্ট তিন তারকা হোটেল, একটি ৬ তলা শপিং কমপ্লেক্স, একটি ১২ তলা কার পার্কিং ও অফিস কমপ্লেক্স এবং একটি তিনতলা ব্যাংকুয়েট হলের নির্মাণকাজ শুরু করে।
ভবনগুলোর অর্ধেক কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর অজ্ঞাত কারণে নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ২০১১ সালে ইপকো, সামিট গ্রæপ ও ইউনাইটেড গ্রæপ যৌথভাবে ভবনগুলোর কাজ পুনরায় শুরু করে। এতে ব্যয় হয় ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ। ২০২১ সালে ভবনগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হয়।
এর মধ্যে ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর কেপিআই জরিপ কমিটি একটি প্রতিবেদন প্রেরণ করে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ১ ‘ক’ শ্রেণির কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠান। ১ হাজার ২৯৮ একর জমির ওপর বিমানবন্দর অবস্থিত। আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে যাত্রী ও মালামাল পরিবহণে বিমানবন্দরের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিনিয়ত এই রুটে দেশি-বিদেশি যাত্রী আসা-যাওয়া এবং পণ্যবাহী বিমান ওঠানামা করে। কেপিআইর অভ্যন্তরে কোনো ভবন নির্মাণ করতে হলে কেপিআইডিসির অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক।
সভার কার্যবিবরণীতে আরো উল্লেখ করা হয়, নির্মাণাধীন ভবনগুলোর ছাদ হতে বিমানবন্দরের প্রতিটি স্পর্শকাতর এলাকা দৃশ্যমান। বিমানবন্দরের ভিভিআইপি টার্মিনাল ব্যবহার করে দেশি ও বিদেশি ভিভিআইপিগণ গমনাগমন করে থাকেন।
সেখানে আরো বলা হয়, ২০১৭ সালের ১৩ নভেম্বর বেবিচকের জরিপ কর্তৃপক্ষ কেপিআইডিসির কাছ থেকে ভবন নির্মাণের অনুমতি ও নিরাপত্তার বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু এ সংক্রান্ত কোনো চিঠি নেই কোনো সংস্থার কাছে। এমনকি চুক্তির বিষয়টি কেপিআইডিসির সভাপতি ও জরিপ কমিটির সভাপতিকে অবহিত পর্যন্ত করা হয়নি।
চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি কেপিআইডিসি’র সভায় বিমানবন্দরের সীমানা প্রাচীর থেকে নির্মাণাধীন ভবনসমূহের দূরত্ব নির্ধারণ করে প্রতিবেদন কেপিআইডিসি’র নিকট প্রেরণের কথা বলা হয়। গত সভার দিন পর্যন্তও সেটি পাঠানো হয়নি বলে জানা যায়।
সভায় এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরকে বলা হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন