ভারত বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র ব্যবহার করবে। এ মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ৪ দিনের ভারত সফরে যাবেন তখন এ সম্পর্কিত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে বলে গত কাল ঢাকার বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভবত ১৭ ডিসেম্বর ভারত সফরে যাবেন। পর দিন ১৮ ডিসেম্বর এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে বলে প্রকাশ। চুক্তির বিস্তারিত কিছুই জানা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর উপলক্ষ ইতোমধ্যেই উভয় দেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক কর্মতৎপরতা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যেই ভারতের নৌপরিবহন সচিবের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি টিম ঢাকা সফর করেছে। ঢাকা সফরকালে এই টিম বাংলাদেশের নৌপরিবহন সচিবের নেতৃত্বাধীন ১৬ সদস্যের একটি টিমের সাথে একাধিক বার বৈঠকে মিলিত হয়। বৈঠক শেষে দুই সচিব এই মর্মে তথ্য প্রকাশ করেন যে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার সম্পর্কিত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হবে। ইতোমধ্যেই এ সম্পর্কে একটি খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে বলে এই দুই সচিব জানিয়েছেন। ভারত কিভাবে বাংলাদেশের বন্দরসমূহ ব্যবহার করবে এবং সেক্ষেত্রে কোন পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে সে সমস্ত তথ্য ঐ খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলে জানা গেছে। যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে সেটির নাম হবে স্ট্যান্ডার্ড অপারেশনাল প্রসিজিউর (এসওপি)। অন্যান্য আন্তর্জাতিক সমুদ্র বন্দর বিভিন্ন দেশ যেভাবে ব্যবহার করে ভারত বাংলাদেশের এই দু’টি বন্দর ব্যবহার করার সময়ও একই নিয়ম অনুসরণ করবে বলে বলা হচ্ছে। খসড়া চুক্তি মোতাবেক চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাল খালাস করে ভারতের কোনো এলাকায় নিয়ে যাওয়া অথবা ভারতের কোনো এলাকা থেকে মাল পরিবহন করে চট্টগ্রাম বন্দরে আনয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূখ- ব্যবহার করা হবে। সেই সাথে একটি বহুমুখী কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ এবং পর্যটকদের জাহাজ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চলাচলের বিষয়টিও চুক্তিতে থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও অংশিদারীত্বের বিষয়টি চুক্তির অন্তর্ভুক্ত থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের সময় ৩০ থেকে ৩৫টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশের বাঁচা মরার সমস্যা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে জানা গেছে। সংক্ষেপে বলা যায় যে, ভারত বাংলাদেশের দু’টি সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করবে, শুধু এই টুকুই এখন জানা গেছে। এর বাইরে আর কোনো তথ্যই প্রকাশ করা হয়নি।
কয়েক দিন আগে এই একই বিষয়ে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিলো। ঐ খবরে বলা হয় যে, ভারত বাংলাদেশের দুটি বন্দর ব্যবহার করবে, কিন্তু এ জন্য কোনো মাসুল দেবে না। নয়া দিল্লীর তরফ থেকে বলা হয়েছে যে, ভারত শুধুমাত্র প্রশাসনিক ফি দেবে, তবে কোনো কাস্টমস ডিউটি বা কোনো শুল্ক দেবে না। ঐ খবরে আরো বলা হয়েছিলো যে, ভারতীয় জাহাজে করে যখন ভারতীয় পণ্য চট্টগ্রাম বা মংলাতে আনলোড করা হবে তখন তাদের পণ্য রাখার জন্য আলাদা জায়গা দিতে হবে। বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যের আমদানি বা রফতানির ক্ষেত্রে যেসব সুযোগ-সুবিধা পায় তাদেরকেও তাই দিতে হবে। এই খসড়া সম্পর্কে বাংলাদেশের মতামত ভারতকে দ্রুত জানানোর অনুরোধ করা হয়েছে যাতে করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময়েই এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করা যায়। অপর একটি খবরে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের আকাশসীমা ও বিমান বন্দর ব্যবহার করার জন্য ভারত বাংলাদেশের নিকট থেকে ওপেন স্কাই বা খোলা আকাশ সুবিধা চায়। ভারত কর্র্তৃক চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করার বিষয়টি অনেক পুরাতন ইস্যু। এর রয়েছে একটি দীর্ঘ ইতিহাস। ভারত বিভক্তির পর পশ্চিমবঙ্গ কলকাতা সমুদ্র বন্দর পায় কিন্তু বাংলাদেশের কোনো সমুদ্র বন্দর ছিলো না। তাই তৎকালিন পাকিস্তান সরকার মাত্র ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহার করার সুযোগ চায় ভারতের কাছে। কিন্তু ভারত এই মর্মে কঠিন জবাব দিয়েছিলো যে, ৬ মাস কেন, ৬ ঘণ্টার জন্যও পাকিস্তানকে কলকাতা বন্দর ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না।
এখন এমন এক সময় এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে যখন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের আমদানি-রফতানি হ্যান্ডেল করতে গিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে বিপুল জাহাজ জটের সৃষ্টি হচ্ছে। সেই সাথে সৃষ্টি হচ্ছে কন্টেইনার জট। চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ জট সৃষ্টি হওয়ায় বিদেশের অনেক জাহাজ এখন চলে যাচ্ছে মংলা সমুদ্র বন্দরে। এই দুটি বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি না পাওয়াতেই এই দ্বিবিধ জটের সৃষ্টি হচ্ছে। ঐ দিকে বন্দর ব্যবহার করার সাথে সাথে ভারত জাহাজ থেকে মাল খালাস করে তাদের বিভিন্ন গন্তব্যে সেইগুলো পরিবহন করবে। এই জন্য ১০টি রুট প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের ভূখ-ের যেসব রাস্তা এই জন্য ব্যবহার করা হবে সেসব রাস্তা এখন উন্নত নয়। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত সড়ক পরিবহনে স্বাভাবিক অবস্থাতেই বিপুল যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। তার সাথে যদি বন্দর থেকে খালাস করার পণ্য সামগ্রী ভারতের ভারী যানবাহনে পরিবাহিত হয় তাহলে ঐ যানজটই শুধু বৃদ্ধি পাবে না, বরং সেই রাস্তাগুলো চুরমার হয়ে যাবে। এসবের সাকুল্য ফল হিসেবে বাংলাদেশের আমদানি ও রফতানি বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। এই অবস্থায় বন্দরসমূহের সক্ষমতা বৃদ্ধি না করে যদি ভারতের জাহাজসমূহ বাংলাদেশের বন্দরসমূহ ব্যবহার করে তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আরো কথা আছে। যখন সক্ষমতা বাড়বে তখন ভারতকে এসব বন্দর ব্যবহার করতে দিলে বাংলাদেশ কি কি সুবিধা পাবে সেটিও পূর্বাহ্নে স্থির হওয়া দরকার। মানুষ ভুলে যায়নি যে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা স্থল ট্রানজিটের মাশুল সুপারিশ করেছিলেন টন প্রতি ১০৫৮ টাকা। কিন্তু সেখানে ভারত দিচ্ছে টন প্রতি মাত্র ১৯২ টাকা। এসব বিষয় বিবেচনা করে সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করার মতো অতিব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাড়াহুড়া করা উচিত হবে না। চুক্তির আগে উত্থাপিত পয়েন্টসমূহ বিবেচনা করার প্রয়োজন বলে বাংলাদেশের অভিজ্ঞ মহল মনে করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন