বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ঘনঘন লোডশেডিং থাকার কারণে বিএনপি সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে। সে কারণে বর্তমান সরকার ক্ষমতার আসার পরে নতুন আইন করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সারাদেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন করছে। কিন্তু গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে দেশে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষরা। জ্বালানি সঙ্কট দেখা দেয়ায় দুর্ভোগ বেড়েছে। ঢাকাতেই ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। আর গ্রামে মাত্র ৬ থেকে ৭ ঘণ্টায় মিলছে বিদ্যুৎ বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, গ্যাস আনতে না পারায় নভেম্বরের আগে লোডশেডিং পরিস্থিতি উন্নতির আশা নেই। লোডের কারণে আমরা দিনের বেলা কিছু পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ রাখছি। আবার দিনে যেগুলো চালাচ্ছি সেগুলো রাতে বন্ধ রাখছি। এজন্য লোডশেডিংয়ের জায়গাটা একটু বড় হয়ে গেছে। নভেম্বরের আগে লোডশেডিং পরিস্থিতি উন্নতির আশা নেই। ধারনা করা হচ্ছে অবিরা, লোডশোডিং এর পথে যাচ্ছে দেশ।
রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকার বাসিন্দা নিপা সরকার ইনকিলাবকে জানিয়েছেন, ভোর ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৫ বার বিদ্যুৎ চলে গেছে। আর রাতে আসলেও আড়াই টার পরে বিদ্যুৎ না থাকায় গরমে বাচ্চারা ঘুমাতে পারেনি। ধানমন্ডির বাসিন্দা ইকবাল হাসান জানান, এক ঘণ্টা পরপরই বিদ্যুৎ যাচ্ছে। বিদ্যুৎ যায় আর আসে।
ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষের (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান ইনকিলাবকে বলেন, দিনে পাঁচ ঘণ্টা করে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। গত শনিবার বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট, উৎপাদন ১২ হাজার ২৮৯ মেগাওয়াট। সরকারি তথ্য মতে ঘাটতি ১ হাজার ৪৫৯ মেগাওয়াট বলা হলেও প্রকৃত লোডশেডিং ৩ থেকে ৪ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট। জ্বালানি সঙ্কটে প্রায় চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। কারিগরি সমস্যায় উৎপাদন বন্ধ আছে সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে বেড়েই চলছে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি। নাকাল অবস্থা কোলের শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত। ঘনঘন লোডশেডিংয়ে ব্যাহত হচ্ছে কলকারখানার উৎপাদনও। এতে বিপাকে মালিকদের সাথে শ্রমিকরাও। ১ ঘণ্টা নয় এখন থেকে কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের নতুন শিডিউল দিয়েছে ডিপিডিসি। এখনো কথা বলতে না পারা দেড় বছরে আইয়াদ। বিদ্যুৎ চলে গেলে বড়রা কষ্টের কথা মুখফুটে বলতে পারলেও তার মতো শিশুটির সাধ্য কেবল ছটফট করা পর্যন্ত। যে বেদনা ছুঁয়ে যায় বৃদ্ধদেরও। শুধু দেড় বছরের শিশুই নয় ৭৫ বছরের আয়েশা বেগমেরও যন্ত্রনার কারণ বিদ্যুতের এ ভয়াবহ লোডশেডিং। ডিজিটাল যুগে এসেও আবার হাতপাখার যুগে ফিরে যাওয়ার কষ্ট সইবার মতো নয়। কাজের পিক আওয়ার ধরা হয় সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত। এ সময় কারখানার বাইরে অলস সময় কাটাতে বাধ্য হচ্ছে শ্রমিকরা। বিদ্যুৎ না থাকায় নষ্ট হচ্ছে মেশিনের সক্ষমতাও। সময়মতো মাল ডেলিভারি না দিতে পেরে মাথায় হাত মাঝারি মানের উদ্যোক্তাদের। এর আগে, কথা ছিল প্রতিদিন শিডিউল করে এলাকাভিত্তিক এক ঘণ্টা লোডশেডিং করবে ডিপিডিসি। কিন্তু, সাম্প্রতিক ব্ল্যাকআউটের পর সব তছনছ। সিডিউলের কোনো বালাই নেই। ছুটির দিনেও ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত থাকতে হচ্ছে বিদ্যুৎহীন।
গতকাল সোমবার সচিবালয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা চেয়েছিলাম অক্টোবর থেকে কোনও লোডশেডিংই থাকবে না। কিন্তু সেটা আমরা করতে পারলাম না। কারণ আমরা গ্যাস আনতে পারিনি। সমস্যাটা সাময়িক হতে পারে। তবে আমি মনে করি, বললেই এটা সাময়িক হচ্ছে না। কারণ বিশ্ব পরিস্থিতি আবার অন্যরকম করে ফেলে। অক্টোবর মাসটা একটু কষ্ট করতে হবে। আশা করছি, সামনের মাস থেকে আরেকটু ভালো হবে। নভেম্বর থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অক্টোবর থেকে ভালো পরিস্থিতি হয়ে যাবে বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু শিল্পে চাহিদা বেড়ে গেছে। তাই আমরা বিদ্যুতে গ্যাস কমিয়ে দিয়েছি।
এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হাবিবুর রহমান বলেছেন, গতকাল সোমবার রাত থেকেই বিদ্যুৎ পরিস্থিতি উন্নতি হতে শুরু করবে। ঘোড়াশালে একটি উপকেন্দ্রে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে পূর্বাঞ্চলের সারপ্লাস বিদ্যুৎ পশ্চিমাঞ্চলে আনতে না পারায় পরিস্থিতি বেশি অবনতি হয়েছে। সচিব বলেন, পূর্বাঞ্চলে ১১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত রয়েছে। কিন্তু ঘোড়শাল উপকেন্দ্রের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে আনা যাচ্ছে না। সোমবার বিকেলের মধ্যেই উপকেন্দ্রটি চালু হবে। ওই ১১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গ্রিডে বাড়তি যোগ হবে। এতে করে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হবে। তিনি বলেন, গ্যাস সরবরাহ কম পাচ্ছি, এতে করে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বসে থাকছে। কয়লা সঙ্কটের কারণে বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ যে কারণে সঙ্কটটা বেড়েছে। করোনার কারণে বড়পুকুরিয়ার কয়লা উত্তোলন বন্ধ ছিল। সেখানে আবার কয়লা উত্তোলন শুরু হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু করা সম্ভব হবে। ধারণা করা হচ্ছে শিগগিরই ব্লাক আউটের গত ৪ অক্টোবর পূর্বেই অবস্থায় যেতে পারবো।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, এলএনজির কার্গো আসা কমেছে। এলএনজি থেকে গ্যাস সরবরাহ দৈনিক ৩৮ কোটি ঘনফুটে নেমে এসেছে। আগে যা ছিল ৮৫ কোটি ঘনফুট। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকদের সংগঠন বিপ্পার সভাপতি ইমরান করিম বলেন, প্রায় চার মাসের বিদ্যুৎ বিক্রির অর্থ সরকারের কাছে পাওনা রয়েছে। অর্থ সঙ্কটের কারণে অনেক মালিক ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে পারছেন না ফলে উৎপাদন কম হচ্ছে ।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, ১১ অক্টোবর সর্বোচ্চ চাহিদার প্রক্কলন করা হয়েছে ১৪২০০ মেগাওয়াট, আর সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ১২৬৮৬ মেগাওয়াট। ঘাটতি ১৫১৪ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হবে। তবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ওই তথ্যকে বাস্তবতা বিবর্জিত বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই। তারা বলেছেন, চাহিদার যে প্রাক্কলন করা হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি চাহিদা রয়েছে। যে কারণে বিতরণ সংস্থাগুলো ঘোষিত লোডশেডিং সিডিউল যথাযথভাবে অনুসরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, তবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ওই তথ্যকে বাস্তবতা বিবর্জিত বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই। তারা বলেছেন, চাহিদার যে প্রাক্কলন করা হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি চাহিদা রয়েছে। যে কারণে বিতরণ সংস্থাগুলো ঘোষিত লোডশেডিং সিডিউল যথাযথভাবে অনুসরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। যদিও এ ঘটনায় গঠিত দু’টি কমিটি তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগ গঠিত তদন্ত কমিটি বলছে, ২০১৪ সালের গ্রিড বিপর্যয়ের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা এবং তার আলোকে ভবিষ্যতে সুরক্ষা নিশ্চিতের বিষয়ে পদক্ষেপগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। এদিকে, গ্রিড বিপর্যয়ের কারণে দেশজুড়ে লোডশেডিং বাড়লেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলছেন, সহনীয় মাত্রায় রয়েছে লোডশেডিং।
গত ৪ অক্টোবর দুপুর ২টা ৪ মিনিট থেকে জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন গ্রিড বিপর্যয় হওয়ায় দেশের উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলা ছাড়া সারাদেশে ব্ল্যাকআউট সৃষ্টি হয়। এরপর থেকেই সারা দেশে শুরু হয়েছে বিদ্যুতের আসা-যাওয়া। বিদ্যুতের লোড ব্যবস্থাপনা এবং গ্রিডের ফ্রিকোয়েন্সি ঠিক রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। শুক্রবার চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের উৎপাদন কম থাকায় ৯৫৪ মেগাওয়াট ঘাটতি মেটাতে লোডশেড করতে হয়েছে।
গ্রিড বিপর্যয়ের সম্ভাব্য কারণ খুঁজে বের করতে বিদ্যুৎ বিভাগ গঠিত কমিটি গত শনিবার প্রথম বৈঠকে বসে। প্রায় দুই ঘণ্টার বৈঠক শেষে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক বলেন, ভবিষ্যতে যেনো এমন বিপর্যয় আর না হয়, সেজন্য তদন্ত করে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। বাংলাদেশের জাতীয় পাওয়ার গ্রিডে বিপর্যয়ের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর। সে সময় সারাদেশ ১৭ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন ছিল। এক ঘণ্টা নয় ছয় ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের নতুন শিডিউল ডিপিডিসি’র।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন