মোহাম্মদ আবু নোমান : দেশের প্রতিটি নির্বাচনের ইশতেহারে শীর্ষ দল এবং জোটের সুশাসন, দারিদ্র্য এবং দুর্নীতি প্রতিরোধের অঙ্গীকার থাকলেও কাক্সিক্ষত বাস্তবায়ন আমরা দেখি না। বলা হয় দারিদ্র্যের কারণে অনেকে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়। বাস্তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় উচ্চপদাধিকারী, শিক্ষিত, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক এবং সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরাই অধিক দুর্নীতিগ্রস্ত। এই উচ্চবিত্তদের দুর্নীতি যে দারিদ্র্য বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ ও দুর্নীতি বিমোচনে প্রধান অন্তরায় তাতে সন্দেহ নেই।
সরকার এবার প্রথমবারের মতো হতদরিদ্রের জন্য ১০ টাকা কেজি দরে ৫০ লাখ পরিবারের মাঝে প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল দেয়ার কর্মসূচি নেয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিগত দিনগুলোতে এই কর্মসূচির যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে এবং এখনো বেরোচ্ছে তা চরম দুঃখ ও হতাশাজনক। শাসক দলের নেতাকর্মী-সমর্থক, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, তাদের আত্মীয়স্বজন, সরকারী কর্মচারী, স্কুল-কলেজের শিক্ষকসহ স্থানীয় প্রভাবশালীদের অনেকেই এই চাল ভাগবাটোয়ারা করে খাচ্ছে। নৈতিকতার অবক্ষয় কোন পর্যায়ে নেমে গেছে তা গবীর, দুঃখি, দুস্থ’, ভিখারী, অনাহারীদের চাল নিয়ে লুটপাট থেকেই বুঝা যায়। এতে প্রমাণ হয়, দেশে ক্ষমতার পালাবদল, হাতবদল, দলবদলের সাথে সাথে দুর্নীতিরও ভরা পূর্ণিমার জোয়ার বইছে। দুর্নীতি আজ বৃষ্টি হয়ে ঝরছে আমাদের ব্যক্তি, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সর্বস্তরে। লোভ-লালসার জিহ্বা বর্ষার স্ফীত নদীর মতো দুই কূল প্লাবিত করে দুর্নীতি আজ সমাজের সর্বস্তরে প্রাসাদ গড়ে আমাদের অর্থনীতির সম্ভাবনাময় সব পুষ্পিত শাখা-প্রশাখা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করছে।
যে শান্তি, সুশাসন, সমৃদ্ধি, দুর্নীতি, নিপীড়ন, শোষণহীন ও সুশাসিত দেশের প্রত্যাশায় আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, ইতোপূর্বে সেই স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বিভিন্ন দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও সংগঠনকে পুরস্কার দেয়ার আয়োজন করেছিল সরকার। বিদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা স্মারক হিসেবে দেওয়া ক্রেস্টে স্বর্ণ জালিয়াতি করা হয়েছিল। রঙ্গভরা বঙ্গে নজিরবিহীন বহু ঘটনা ঘটতেই পারে কিন্তু দুর্নীতির কোনো ঘটনা, মহা থেকে মহানজিরবিহীন হতে পারে কি-না এ নিয়ে গোল বাধা খুবই স্বাভাবিক। তাদের যে ক্রেস্ট দেয়া হয় তাতে ১ ভরি স্বর্ণ ও ৩০ ভরি রুপা থাকার কথা ছিল। কিন্তু ক্রেস্ট পরীক্ষা করে দেখা যায় তাতে মাত্র সোয়া তিন আনা স্বর্ণ, রুপার বদলে তামা, পিতল ও দস্তা দেয়া হয়েছে। ৩৪৪টি ক্রেস্টে ৭ কোটি ৩ লাখ ৪৬ হাজার ২৮০ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
রাসূল (সা.) বলেছেন, সরকারি দায়িত্ব একটি আমানত। কিয়ামতের দিন তা লজ্জা ও অপমানের কারণ হবে। অবশ্য সেই ব্যক্তির জন্য নয় যে তা দায়িত্বানুভূতি সহকারে গ্রহণ করে এবং তার উপর অর্পিত কর্তব্য যথাযথভাবে সম্পাদন করে। অন্যত্র এসেছে : যখন অযোগ্য ব্যক্তির উপর কাজের দায়িত্ব অর্পণ করা হবে তখন তুমি মহাপ্রলয়ের অপেক্ষা কর। পবিত্র কোরআনে কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে সততা ও বিশ্বস্ততা, দৈহিক শক্তি এবং জ্ঞান ও স্মৃতিশক্তি এ তিনটি দিক বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। জনগণের সেবা করা একজন সরকারি কর্মকর্তার নৈতিক দায়িত্ব। সে সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত জনগণের সেবক। রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহ ততক্ষণ তার বান্দার সাহায্যে রত থাকেন, বান্দা যতক্ষণ পর্যন্ত তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে। তিনি আরও বলেন, মুসলিম জনগণের জন্য নিয়োগকৃত কোনো শাসক বা কর্মচারী তাদের সাথে প্রতারণাকারী হিসেবে মারা গেলে আল্লাহ তার জন্য বেহেশতে প্রবেশ হারাম করে দেন। ইরশাদ হয়েছে, হে ইমানদারগণ! তোমরা অন্যায় ও অবৈধভাবে পরস্পরের ধন-সম্পদ আত্মসাৎ করো না (বাকারা)।
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে ‘দ্য লাস্ট জ্যাকেট হ্যাজ নো পকেট’। অর্থাৎ ‘শেষ পিরানের (কাফনের) পকেট নেই’। বলা হয় যে, মানুষের সাধ মিটবে না সেই পর্যন্ত, যে পর্যন্ত না তার মুখে মাটি পড়বে। অর্থাৎ মৃত্যু হয়ে কবরে না পৌঁছবে। আমাদের দেশের কর্তা ব্যক্তিদের অনেকেই প্রবাদটি শুনেছেন ও জানেন। তবে ক্ষমতার অন্ধ নেশার ঘোরে যেন তা ভুলে গেছেন। ক্ষমতাসীনরা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দিনবদল ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার কথা বলে থাকেন। কিন্তু আমরা বাস্তবে দেখছি, দুর্নীতিমুক্ত তো হয়ইনি বরং দুর্নীতি হয় না এমন কোনো সেক্টর আর এখন খুঁজে পাওয়া যায় না।
লেভ তলস্তয়ের লেখা বিখ্যাত গল্প ‘হাউ মাচ ল্যান্ড ডাজ অ্যা ম্যান রিকয়ার’। গল্পটিতে দেখা যায়, একজন মানুষ লোভের তাড়নায় অঢেল জমির দখল পেতে চায় এবং কোদাল হাতে বিশাল বেড় দিয়ে জমির দখল নিতে সে প্রাণান্ত ছুটে চলে। অতিমাত্রায় ছোটাছুটি করে ক্লান্ত ঘর্মাক্ত মানুষটি অবশেষে তার সদ্য দখলে নেওয়া জমির কিনারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। লোকজন জমিলোভী মৃত মানুষটিকে তার জমিতে কবর দিয়ে দেয়। লোভী মানুষটি বিশাল বেড় দিয়ে সহস্র হেক্টর জমি দখল করেছিল; কিন্তু মরার পরে লোকটি নিজের কবরের জন্য সাড়ে তিন হাত জমির বেশি দখল করতে পারেনি।
দেশের বড় বড় আমলা ও রাজনীতিকদের দুর্নীতির বিচার হয় না বা তা সম্ভবও নয় বলে প্রমাণিত। দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান তার অসহায়ত্বের কথা বলেছিলেন ক্ষমতা থেকে চলে আসার পর। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কিন্তু তিনি তার অসহায়ত্বের কথা বলেননি। পরে তিনি সংবাদমাধ্যমে বলেন ১০০ বা ৫০০ রাজনীতিবিদদের যদি জেলে ভরতে পারতাম তাহলে বোধহয় আমি সফল হতাম। তার এই রিয়ালাইজেশন নিয়ে প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি তাহলে সেটি কেন করেননি? কেন, তার হাত-পা বাঁধা ছিল কি?
ভারতের বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কূলদীপ নায়ার তার ইবুড়হফ ঃযব খরহবং বইয়ে ভারতের দু’জন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সম্পর্কে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। তারা হলেন শিক্ষামন্ত্রী মাওলানা আজাদ ও কংগ্রেসের জাদরেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাফি ভাই কিদোয়ানি। তারা দু’জন দীর্ঘদিন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রিত্ব করে যখন মারা যান, তখন তাদের ঘরে কোনো নগদ টাকা ছিল না। সেই সঙ্গে তাদের ব্যাংকের অ্যাকাউন্টও শূন্য ছিল। ভারতের কেউ কেউ ২০ বছরের উপরে মুখ্যমন্ত্রী থেকেও তারা পারিবারিকভাবে অতিসাধারণ বেশভূষায় চলেছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের জন্য সম্পদ অর্জনের মতো হীন ধারণা তাদের কল্পনায়ও আসেনি। ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায়, খোলাফায়ে রাশেদীনেরা পারিবারিক বা কোন মেহমানদের সাথে যখন কথা শুরু করেছেন তখনই রাষ্ট্রের খরচে জ্বালানো বাতি নিভিয়ে রেখেছেন।
ইতোপূর্বে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান একটি পরিসংখ্যানে বলেছেন, রফতানিকারকদের দেয়া বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধার অপব্যবহারের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ যে পরিমাণ বন্ড সুবিধার অপব্যবহার হয় তা ঠেকানো গেলে বছরে ২টি পদ্মা সেতুর সমপরিমাণ অর্থায়ন করা সম্ভব। ড. ইফতেখারুজ্জামানের মতে, রাষ্ট্রের সব খাত মিলিয়ে দুর্নীতির পরিমাণ কমপক্ষে জিডিপির ৫ শতাংশ। যাতে ক্ষতির পরিমাণ ৬৫ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকার কম নয়। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আরেকটি বার্তা দিয়েছেন জাতিকে। যে বার্তা ভয়ঙ্কর। গা শিউরে ওঠার মতো খবর বটে। তিনি বলেছেন, ‘নিজেদের লোকদের সমর্থনের কারণে সোনালী ও বেসিক ব্যাংক অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেননি’। শেয়ার কেলেঙ্কারির কারণে ৩৪ লাখ বিনিয়োগকারী পথে বসলেও অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমি শেয়ারবাজার বুঝি না’। হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে হইচই করার কিছু নেই বলে মনে করছেন অর্থমন্ত্রী। এমনকি তিন বা চার হাজার কোটি টাকা Its Nothing বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা চুরির ব্যাপারে এফবিসিসিআই সভাপতি সরকারের আস্থাভাজন আবদুল মাতলুব আহমেদ বলেছিলেন, ‘এটা কোন বিষয় না’, ‘অত বড় চোর নয়, ছেঁচড়া চোর’। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সবাই পায় সোনার খনি, তেলের খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি। যারেই যেখানে দায়িত্ব দেই, সে কেবল চুরি করে’।
অর্থমন্ত্রী ক্ষমতাসীনদের সাফাই গাওয়ার সুরে বলেছিলেন, ‘ক্ষমতাশালীদের সম্পদ বেড়েই থাকে। ওটা কোন বড় বিষয় নয়।’ মন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কি ব্যক্তিগত সম্পদ সৃষ্টির হাতিয়ার, যে ক্ষমতা পেলেই কারো সম্পদ বাড়বে? দেশে প্রচলিত আর দশটা পেশার মতো রাজনীতি কি একটি লাভজনক পেশা? অর্থমন্ত্রীর মতো শীর্ষ রাজনীতিবিদরা যদি ক্ষমতাবানদের সম্পদ বৃদ্ধির বিষয়টিকে তুচ্ছ ভেবে উড়িয়ে দেন, তাহলে জনগণের আর আশা-ভরসার জায়গা থাকে না।
রাসূল (সা.) বলেছেন, কোনো ব্যক্তিকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগদানের পর তার নির্ধারিত বেতনের অতিরিক্ত যেটা গ্রহণ করবে সেটা আত্মসাৎকৃত মাল। রাসূল (সা.) এক সাহাবিকে কর্মচারী নিয়োগ করে যাকাত আদায়ের জন্য পাঠালেন। তিনি ফিরে এসে রাসূল (সা.)-কে বললেন, এটা যাকাতের মাল আর এটা আমাকে উপঢৌকনস্বরূপ দেয়া হয়েছে। এতে নবী করিম (সা.)-এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে বললেন, সরকারি কর্মচারীর কি হলো! আমরা যখন তাকে কোনো দায়িত্ব দিয়ে কোথায়ও প্রেরণ করি তখন সে ফিরে এসে বলে, এই মাল আপনাদের (সরকারের) এবং এটা আমাকে প্রদত্ত উপহার। সে তার বাড়িতে বসে থেকে দেখুক তাকে উপহার দেয়া হয় কি-না।
এখন চাকরি ক্ষেত্রে মেধার মূল্যায়ন নেই, লাগে ঘুষ কিংবা মামা-ভাগ্নের সম্পর্কের মতো জাদুর ছোঁয়া। একটা মেথর নিয়োগ থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিয়োগে চলে বাণিজ্য আর অপরিসীম দুর্নীতি। ঠিকাদারদের মন্ত্রী, আমলা, ইঞ্জিনিয়ার, স্থানীয় মাস্তানদের পার্সেন্টিস ও চাঁদা দিয়ে কাজ করতে হয়। ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না। অবৈধ লোন দিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তারা পয়সা কামান। জাল সার্টিফিকেটে শিক্ষকতা, ভুয়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ। এমনিতর শত-সহস্র বাঁধ ভাঙা অনৈতিক ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এসবের কথা ভাবলে মনে হয়, ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেব কোথা’। বাংলাদেশের দুর্নীতির গল্প ঠিক আরব্য রজনীর গল্পের মতো। রাত ফুরিয়ে ভোর হবে কিন্তু সীমাহীন দুর্নীতির গল্প যেন শেষ হওয়ার নয়, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার অন্যতম অন্তরায়।
abunoman72@ymail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন