পৃথিবী বদলে গেছে। বদলে গেছে বাংলাদেশ। জীবনের প্রয়োজনে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও কাজ করছেন। তারাও দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। অথচ এক সময়ে বাংলাদেশের নারীদের বাড়ির বাইরে যাওয়ায় ছিল প্রায় কল্পনাতীত। পরিবারের ভরণপোষণ হচ্ছে স্বামীর জন্য দায়িত্ব এবং স্ত্রীর প্রাপ্য অধিকার। বৈবাহিক সম্পর্কের জন্য থাকা খাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ, চিকিৎসা ও জীবনধারণের জন্য অন্যান্য যে সব উপকরন লাগবে স্ত্রী তা স্বামীর কাছ থেকে পাওয়ার অধিকারী হন। কিন্ত স্বামী অক্ষম বা বিধবা হলে নারীরই জীবন বাঁচানোর তাগিদে কোনো না কোনো কর্মসংস্থানে সম্পৃক্ত হন। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে দেশের সাহসী নারীরা পুরুষের পাশাপাশি পরিবারের হাল ধরতে বর্হিবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছেন। বিশেষ করে তেল সমৃদ্ধ সউদীসহ মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত লাখ লাখ প্রবাসী নারী গৃহকর্মী রেমিট্যান্স খাতে অভাবনীয় সাফল্য রাখছেন।
বিএমইটির সূত্র জানায়, গত জানুয়ারি থেকে গত ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৯ লাখ ৩২ হাজার ১৯৬ জন নারী-পুরুষ কর্মী চাকরি লাভ করেছে। শূন্য অভিবাসন ব্যয়ে বিদেশে গিয়ে শুধু সউদীতেই নারী গৃহকর্মীরা প্রতি মাসে এক হাজার রিয়াল থেকে বারোশ’ রিয়াল আয় করছেন। এতে প্রতি মাসে সউদী আরবে কর্মরত প্রায় সাড়ে ৪ লাখ নারী গৃহকর্মী গড়ে ১ হাজার ২শ’ ৬০ কোটি টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে কর্মরত নারী কর্মীরাও প্রতি মাসে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন। নারী গৃহকর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্স জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মতে, বর্তমানের বর্হিবিশ্বে প্রায় সোয়া কোটি বাংলাদেশি নারী-পুরুষ কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন তার দপ্তরে ইনকিলাবের সাথে আলাপকালে বলেন, করোনা মহামারির পর বর্হিবিশ্বে পুরুষ কর্মীর পাশাপাশি নারী গৃহকর্মীর চাহিদাও বাড়ছে। ১৯৯১ সাল থেকে এ যাবত শুধু সউদী আরবেই ৪ লাখ ৬২ হাজার ১৩৮ জন নারী গৃহকর্মী কর্মসংস্থান লাভ করেছে। তিনি বলেন, বিদেশে কর্মরত নারী গৃহকর্মীরা কঠোর পরিশ্রম করে বিনা পুঁজিতে প্রতি মাসে শত শত কোটি টাকার রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন। প্রবাসী নারী কর্মীরা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রবাসী সচিব বলেন, সউদীতে বর্তমানে বাংলাদেশি নারী কর্মীরা এক হাজার রিয়াল বেতন পাচ্ছে। কিছু কিছু প্রবাসী বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীর নানা নির্যাতন প্রসঙ্গে প্রবাসী সচিব বলেন, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও আমাদের দূতাবাসের কর্মকর্তারা অত্যান্ত সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে সৃষ্ট সঙ্কট নিরসনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। সচিব বলেন, রিয়াদ, জেদ্দাসহ তিন শেলটার হোম স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে শেলটার হোমে আশ্রিত নারী গৃহকর্মীদের আইনী সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
বায়রার সাবেক ইসির সদস্য মোহাম্মদ আলী জানান, নারী গৃহকর্মী প্রেরণকারী ৭০০ রিক্রুটিং এজেন্সি গৃহকর্মী সউদী পাঠিয়ে জনপ্রতি গড়ে ২ হাজার থেকে ২৫শ’ মার্কিন ডলার সার্ভিস চার্জ হিসেবে আয় করেছে। এসব আয়ের (সার্ভিস চার্জের) একটি বড় অংশ সউদী গমনেচ্ছু নারী গৃহকর্মী সংগ্রহকারী এজেন্টকে (দালাল) দিতে হয়। একজন নারী গৃহকর্মী সংগ্রহ করে রিক্রুটিং এজেন্সির অফিসে এনে দিতে পারলে বর্তমানে এসব এজেন্ট ৮০ হাজার টাকা থেকে ৯০ হাজার টাকা কমিশন পাচ্ছে। সউদী গমনেচ্ছু নারী গৃহকর্মী যোগার করে রিক্রুটিং এজেন্সির অফিসে সরবরাহ করে এজেন্টরা লাখ লাখ টাকা আয় করছে। এছাড়া নারী কর্মীর বিমানের টিকিট এবং বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যু, পাসপোর্ট ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের ব্যয়ও মেটাতে হয়। কোনো নারী গৃহকর্মী দুই বছরের চুক্তিতে সউদী গিয়ে তিন মাসের মধ্যে দেশে ফেরত চলে এলে সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সিকে প্রায় আড়াই লাখ টাকা জরিমানা দিতে হয়।
চলতি বছরের অক্টোবর মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫২ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১০৪ টাকা হিসাবে) এর পরিমাণ ১৫ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। গত আট মাসের মধ্যে এটিই প্রবাসীদের পাঠানো এক মাসে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স। উল্লেখ্য, গত বছরের অক্টোবরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৬৪ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। গত ১ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রবাসী পুরুষ কর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পাশাপাশি নারী গৃহকর্মীদের রেমিট্যান্স জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রবাসী নারী কর্মী নির্ভরশীল পরিবারগুলোর ভরণপোষণে এসব রেমিট্যান্স বিরাট অবদান রাখছে। প্রবাসী নারীদের রেমিট্যান্স দিয়ে তাদের ছেলে মেয়েদের লেখা-পড়ার ব্যয়ভার বহন করা হচ্ছে। অনেক প্রবাসী নারী গৃহকর্মীর আয়ের অর্থ দিয়ে গ্রামাঞ্চলে বহুতল বিল্ডিং এবং মার্কেটে দোকান-পাটও গড়ে উঠছে। প্রবাসী নারী গৃহকর্মীদের আয়ের অর্থে গড়ে উঠা এসব অবকাঠামো দেখভাল করছে তাদের স্বামী বা আত্মীয় স্বজনরা। বিদেশের মাটিতে নিজের কষ্টার্জিত অর্থে গড়ে উঠা এসব বিল্ডিং এবং দোকানপাট মোবাইল রেকডিংয়ের মাধ্যমে দেখে কেউ কেউ অতি আনন্দের চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। এসব প্রবাসী পরিবারের অনেক ছেলে মেয়েদের বিবাহ-শাদিও সম্পন্ন হচ্ছে নারী গৃহকর্মীদের আয়ের অর্থ দিয়ে। নিকট আত্মীয় স্বজনদের কেউ কেউ বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য গেলে তাদের অভিবাসন ব্যয় মেটানোর ক্ষেত্রেও এসব রেমিট্যান্সের অবদান রয়েছে। একাধিক প্রবাসী নারী গৃহকর্মী এসব তথ্য জানিয়েছেন। সউদী নিয়োগকর্তারা নারী গৃহকর্মীদের থাকা খাওয়া, চিকিৎসার সকল ব্যয় বহন করছে। প্রত্যেক নারী গৃহকর্মী প্রতিবছর ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা থেকে পৌনে তিন লাখ টাকা আয় করছেন।
বিদেশে নারীদের যাওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই। তবে এর উল্টো চিত্রও রয়েছে। কম যোগ্যতাসম্পন্ন নারীদের শ্রমবাজারে টিকে থাকতে গিয়ে নানা হয়রানির শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসার সংখ্যাও কম নয়। এখন পেছনের সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে নারীদের যোগ্য করেই বিদেশে পাঠাতে চায় সরকার। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরিকল্পনা রয়েছে কর্মক্ষেত্রে।
বিএমইটির সূত্র জানায়, ১৯৯১ সাল থেকে গত সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ১০ লাখ ৮৬ হাজার ২৫০জন নারী কর্মী কাজ নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এদের মধ্যে শুধু সউদী আরবেই ৪ লাখ ৬২ হাজার ১৩৮ জন নারী গৃহকর্মী চাকরি লাভ করেছে। এসব নারী গৃহকর্মী থাকা-খাওয়া ফ্রি এবং প্রতি মাসে ১ হাজার রিয়াল থেকে ১২০০ রিয়াল বেতন পাচ্ছেন। উল্লেখিত সময়ে জর্ডানে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৮২২জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৭০৯ জন, ওমানে ১ লাখ ১১ হাজার ৮৪২জন, লেবাননে ১ লাখ ৭ হাজার ৫৮৩ জন, কাতারে ৩৭ হাজার ১৮১ জন এবং মরিশাসে ১৮ হাজার ৯৯৮ জন চাকরি লাভ করেছে। এদের মধ্যে আবার অনেকেই চুক্তি শেষে এবং নির্যাতনসহ নানা সমস্যার দরুণ দেশে ফিরেছেন।
অতিসম্প্রতি সউদী আরবে অবৈধভাবে আটকে রাখা ২৪ বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীকে দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় উদ্ধার করে রিয়াদস্থ ফিমেল ডিপোর্টেশন সেন্টারে হস্তান্তর করা হয়েছে। রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের উদ্যোগে প্রতারণার শিকার এসব নারী গৃহকর্মীকে উদ্ধার করা হয়েছে। শিগগিরই উদ্ধারকৃত নারী গৃহকর্মীদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে। রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র এতথ্য জানিয়েছে।
দেশটির রাজধানী রিয়াদ থেকে প্রায় ১১০০ কিমি দূরে অবস্থিত আরআর শহর থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়। একটি সউদী রিক্রুটিং এজেন্সি ২৪ জন বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীকে অবৈধভাবে আটকে রেখেছে বলে খবর পান সউদী আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। তিনি এই নারীদের দ্রুত উদ্ধার করে দেশে পাঠানোর জন্য দূতাবাসের শ্রম কল্যাণ উইংকে নির্দেশ দেন।
এদিকে, জেদ্দার নুজলাস্থ বাংলাদেশ সেইফ হোমে প্রায় ২৩ জন নারী গৃহকর্মী দীর্ঘ দিন যাবত চরম উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। তারা নানা সমস্যার কারণে নিয়োগকর্তার কাছে পাওনা বকেয়া বেতন এবং দেশে ফিরতে পারছে না। প্রতি দিনের খাবার দাবারের সমস্যাও রয়েছে বলে জানা গেছে। জেদ্দাস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটের নিয়োগকৃত সেইফ হোম কেয়ারটেকার হুমায়রা নুজলাস্থ সেইফ হোমে প্রতিদিন নারী গৃহকর্মীদের দেখভালের দায়িত্ব পালন না করে কনস্যুলেট অফিসে সারা দিন আড্ডায় ব্যস্ত থাকে। এ বিষয়টি সেইফ হোমের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রথম সচিব আরিফুজ্জামানকে অবহিত করেও কোনো সুরাহা পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে। প্রথম সচিব আরিফুজ্জামানের সাথে মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। এছাড়া কিশোরগঞ্জের প্রবাসী নারী গৃহকর্মী নূরুন্নাহার নিয়োগকর্তার নানা হয়রানির শিকার হয়ে পালিয়ে জেদ্দাস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটে দীর্ঘ দিন যাবত ধরণা দিয়েও কোনো সহযোগিতা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। জেদ্দা থেকে প্রবাসী অসহায় নারী গৃহকর্মী নূরুন্নাহার ইনকিলাবকে জানায় নিয়োগকর্তার কাছ থেকে বকেয়া বেতন আদায় এবং নিয়োগকর্তার দায়েরকৃত চুরি মামলার ব্যাপারে আইনী সহয়তা চেয়েও কনস্যুলেট অফিসের সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না। কনস্যুলেট অফিসে গেলে শ্রম সচিব ও অন্য কর্মকর্তারা নানা অপবাদ মূলক কথা বার্তা বলেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকার বিদেশে বাংলাদেশের কনস্যুলেটের কর্মকর্তাদের বেতন ভাতা দিয়ে পাঠিয়েছেন প্রবাসী কর্মীদের দেখভাল করার জন্য কিন্ত তা’ থেকে বিপদগ্রস্ত নারীরা অনেকটাই বঞ্চিত হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন