মোহাম্মদ আবু তাহের : মহান আল্লাহ্ তাআলার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হচ্ছে মানবজাতি। সাধারণভাবে বলতে গেলে মানুষ যেসব অধিকার জন্মগতভাবে ভোগ করে তাই মানবাধিকার। মানুষ কতগুলো স্বতঃসিদ্ধ অধিকার নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। দেশ-কাল-ধর্ম-বর্ণ জাতি নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের বেলায় সে অধিকার সমানভাবে প্রযোজ্য। এই অধিকারগুলোকে একত্রে বলা হয় মানবাধিকার। সহজভাবে বলা যায় ব্যক্তির মানবসত্ত্বা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকারই হলো মানবাধিকার। মানবাধিকার হরণ করার ক্ষমতা কারো নেই। প্রথম হলো বাঁচার অধিকার, এরপর অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকার। এগুলো সাংবিধানিকভাবে মৌলিক অধিকার হিসেবেও স্বীকৃত।
ইসলামে মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রত্যেক ব্যক্তিরই তার ব্যক্তিগত জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার নিশ্চিত গ্যারান্টি রয়েছে। ইসলাম চিন্তার স্বাধীনতার উপরও অনেক গুরুত্ব দিয়েছে। এরই সঙ্গে ইসলাম মানুষের ভালোমন্দের চিন্তার স্বাধীনতা দিয়েছে। মানুষকে তার ব্যক্তিগত ভালোমন্দ কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেক বঞ্চিত ব্যক্তির অধিকার ইসলামী মানবাধিকারে সংরক্ষিত। দারিদ্র্য সীমার নিচে যাদের বসবাস তারা অন্ন-বস্ত্র ও বাসস্থানের অধিকার থেকে বঞ্চিত। শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকার দিকে তাকালেই দেখা যাবে অসংখ্য মানুষ বস্তিতে বাস করে এবং বস্তিতেও বাস করে না ছিন্নমূল মানুষ হিসেবে যারা পরিচিত এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ যা বেশ কিছুদিন পূর্বে সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়। যারা বস্তিতে বাস করে তাদের কোন নিরাপত্তা নাই। এদের শিশুরাও শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিনোদন থেকে বঞ্চিত। বস্তিতে ও খোলা আকাশের নিচে বসবাসকারী শিশু মৃত্যু হার অনেক বেশি যা জাতিসংঘের জরুরি সহায়তা তহবিলের (ইউনিসেফ) এক জরিপ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। ইসলামের মূল স্তম্ভের মধ্যে একটি হলো জাকাত। এ জাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে ধনীদের সম্পদের উপর দরিদ্রের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে ধনীদের সম্পদে রয়েছে প্রয়োজনশীল প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার (সুরা আযযারিয়াত ১৯)। বাংলাদেশের বিত্তশালী মানুষ যদি সঠিকভাবে হিসাব করে জাকাত আদায় করতেন তাহলে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাবলম্বী করে তোলা সম্ভব হতো। কিন্তু আমাদের দেশের অনেক ধনী মানুষই জাকাত আদায় করেন না। আবার যারাও করেন তাদের মধ্যে অনেকেই সম্পদের হিসাব না করে রমজান মাস এলে জাকাতের নাম করে কিছু দান করেন। কিন্তু এর দ্বারা ফরজ জাকাত আদায় হবে না, দারিদ্র্য বিমোচনেও সহায়ক হয় না। মহানবী কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন কারো কোন প্রতিবেশী অভুক্ত থাকলে এবং সে পেট পুরে খেতে থাকলে তার সারা জীবনের ভালো কাজ আল্লাহ্র কাছে গৃহীত হবে না। মানুষের মানবাধিকার রক্ষার জন্য এর চেয়ে আর কোন মূল্যবান বক্তব্য হতে পারে না। মহানবীর বিদায় হজের ভাষণ মানবাধিকারের মূর্ত প্রতীক যা পৃথিবীর সকল মানুষের মানবাধিকারের ম্যাগনাকার্টা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য ইসলাম বিশেষভাবে দিকনির্দেশনা দিয়েছে। ইসলাম হতদরিদ্র মানুষের হক বা অধিকার সংরক্ষণ করেছে। ইসলামের জাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব। ধনীরা তাদের উদ্বৃত্ত সম্পদের ৪০ ভাগের এক ভাগ বছরান্তে জাকাত প্রদান করে মানবতার সেবা করার মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মানবাধিকার রক্ষা করার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। রাষ্ট্র যদি সংবিধানে স্বীকৃত মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো পূরণ করতে না পারে, সকল নাগরিকের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার নিশ্চয়তা দিতে না পারে তাহলে মানুষ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পাবে না। পাশাপাশি পুষ্টিহীনতার কারণে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়ার কারণে কর্মক্ষমতাও নষ্ট হয়ে যাবে। এ বিষয়গুলো রাষ্ট্রকেই নিশ্চিত করতে হবে। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মোঃ ইউনুস একাধিকবার বলেছেন দারিদ্র্যের জন্য দরিদ্র মানুষকে দায়ী করা যায় না। তিনি বলেছেন সব মানুষই অফুরন্ত সম্ভাবনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং দরিদ্র মানুষ দারিদ্র্যের জন্য দায়ী নয়, তাদের উপর দারিদ্র্য চাপিয়ে দেয়া হয়।
দারিদ্র্য মানবাধিকার লংঘনের অন্যতম কারণ। দারিদ্র্য শুধু মানবাধিকার হরণ করে না বিশ্ব শান্তিকেও বিঘিœত করে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বহু আগেই বলেছেন দারিদ্র্যই সন্ত্রাসের মতো মানবতাবিরোধী অপকর্মের জন্ম দিয়ে থাকে। দারিদ্র্য দূরীকরণ ছাড়া বিশ্ব শান্তিও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন ‘ভোগের পেয়ালা উপচায়ে পড়ে তব হাতে, তৃষ্ণা তোরের হিস্যা আছে ও পেয়ালাতে’। মানবাধিকারের ধারণা অনুসারে প্রতিটি মানুষের অধিকার রয়েছে জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা পাওয়ার, কিন্তু একজন দারিদ্র্য মানুষের পক্ষে ইহা নিশ্চিত করা অসম্ভব। দারিদ্র্য মানেই হচ্ছে নিজের মৌলিক অধিকারগুলো পূরণে অক্ষমতা। সুতরাং দারিদ্র্য ও মানবাধিকারের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। দীর্ঘদিনের আর্থিক ও সামাজিক বঞ্চনা থেকে দারিদ্র্যের উৎপত্তি। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধুমাত্র রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হলেই হবে না। সকল মানুষেরই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার।
আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনের হাইকমিশনার মেরী রবিনসন্স বলেছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘন হলো চরম দারিদ্র্য। বাংলাদেশের এখনো লক্ষ লক্ষ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে। দেশের দারিদ্র্য কমিয়ে আনতে হলে মাথাপিছু আয় বাড়াতে হলে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রের কাছাকাছি নিয়ে যেতে হলে গ্রামীণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানহীন মানুষের বাসস্থানের ব্যবস্থার অগ্রাধিকার দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে সামগ্রিকভাবে জনগনের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন ‘আমার নিজস্ব একটা দর্শন রয়েছে যার লক্ষ্য হচ্ছে দেশের সিংহভাগ গ্রামীণ দরিদ্র মানুষ এবং ভূমিহীন ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ঘটানো।’ এ কথাগুলো দেশের সকল মানুষেরই মনের কথা বলে মনে করি। দেশের মানুষ এর সফল বাস্তবায়ন দেখতে চায়।
বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক উন্নয়ন খাতে। নারীর ক্ষমতায়ন, প্রবাসীদের অর্থ প্রেরণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সবকিছুতেই এদেশের মানুষের সৃজনশীলতার প্রমাণ বহন করে। এদেশের কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষ একটু সুযোগ পেলেই নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করতে পারে। কৃষকদের সৃজনশীলতা ও কঠোর পরিশ্রমের কারণে বাংলাদেশ এখন এক খাদ্য বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয় দেশ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে নৃশংস ও পৈশাচিক কায়দায় খুনের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে, যেভাবে প্রতিদিন বিভিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটে চলছে, যেভাবে গরিব ঘরের শিশুদের নৃশংস নির্যাতন ও খুন করা হচ্ছে। এতে কিছুসংখ্যক মানবরূপী জানোয়ারদের কারণে আমাদের দেশের এত বড় বড় অর্জনই যেন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। বিপন্ন হচ্ছে আমাদের মূল্যবোধ ও বিবেকবোধ। সামাজিক আন্দোলন, মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এসমস্ত জঘন্য অপরাধীদের নির্মূল করা সম্ভব। বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের মূল লক্ষ্য হবে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করা। একটি রাষ্ট্র কতটা উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হলো সেটি দিয়ে রাষ্ট্রের মহত্ত্ব পরিমাপ হতে পারে না। একটি রাষ্ট্রের মর্যাদা পরিমাপ করা হয় রাষ্ট্রটিতে কতটা আইনের শাসন আছে। নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার কতটা সুরক্ষিত। সেখানে সবচেয়ে দুর্বল মানুষটি কতটা সুবিচার পায় তা দিয়ে। মানবাধিকার নিশ্চিতকরণে ন্যায়বিচারের বিকল্প নেই। যে কারণে ইসলামে ন্যায়বিচারের ধারণাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সুরা নিসার ১৩৫নং আয়াতে এরশাদ করা হয়েছে, হে মুমিনগণ তোমরা ন্যায়বিচারে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর সাক্ষীস্বরূপ যদিও ইহা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতামাতা এবং আত্মীয়স্বজনদের বিরুদ্ধেও হয়। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য পবিত্র কোরআন মজিদে অত্যন্ত কঠোরভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের কাছে মানুষের প্রত্যাশা ন্যায়বিচার পাওয়া।
লেখক: সভাপতি, ব্যাংক অফিসার্স এসোসিয়েশন, মৌলভীবাজার এবং নির্বাহী সভাপতি, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, মৌলভীবাজার জেলা শাখা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন