কে. এস. সিদ্দিকী : ইসলামী চান্দ্র বর্ষের তৃতীয় মাস রবিউল আউয়াল। মহানবী রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম ও ওফাতের মাস হওয়ায় এ মাসের আলাদা গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য রয়েছে। বিশেষত মিলাদুন্নবীর রাতকে শবে কদরের চেয়েও ফজিলতপূর্ণ বলে কেউ কেউ বলেছেন। রবিউল মিলাদুন্নবীর মাস হওয়ায় গোটা মাসটাই স্বতন্ত্র মাস ও শানের অধিকারী। এ মাসের আলাদা ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য স্বীকৃত। মহান মুসলিম ব্যক্তিত্ব, মনীষী, যাদের জন্ম-মৃত্যু এই মাসে তাদের সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। এ উপমহাদেশে কত ইসলাম ধর্মের প্রচারক, আউলিয়া-মাশায়েখ, ফকীহ, ইমাম ওলামায়ে কেরামের জন্ম হয়েছে এ মাসে তার সঠিক হিসাবও কারো কারো কাছে নেই। এখানে সাধক পুরুষ হজরত শায়খ নিজামুদ্দীন আউলিয়া (রহ.)-এর নাম উল্লেখযোগ্য, যার ওফাত হয় এ মাসে মাসে।
মাহবুবে এলাহী, নিজামুদ্দীন আউলিয়া (রহ.)-এর সর্বাধিক প্রসিদ্ধ উপাধি। তার আসল নাম মোহাম্মদ, পিতার নাম সৈয়দ আহমদ এবং দাদার নামছিল সৈয়দ আলী, মাতার নাম সৈয়দা জোলেখা। তার উর্ধ্বতন পঞ্চদশ পুরুষ হযরত আলী (রা.)। তার কয়েকটি উপাধি ছিল। যেমনÑ সুলতানুল আউলিয়া, সুলতানুল মাশায়েখ, সুলতানুল সালাতীন এবং মাহবুবে এলাহী প্রভৃতি। হিজরি ৬৩৪ মতান্তরে ৬৩৬ সালের ২৭ সফর বদায়ুনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া (রহ.)-এর পূর্ব পুরুষগণ সাদাত বংশের লোক ছিলেন। হিজরি ৬ষ্ঠ শতকে তাতারি হামলাকারীরা -এশিয়া মাইনরের বালখ, বোখারা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দিয়েছিল। সেখান থেকে অসংখ্য খান্দান হিন্দুস্থানে চলে আসে, সেখানে তখন শামসুদ্দীন আলতামাশ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বিদ্যানুরাগী ও জ্ঞানপিপাসু এ সুলতানের সুখ্যাতি ছিল ব্যাপক। খাজা নিজামুদ্দীনের দাদা ও নানা উভয়ই তাদের পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজনের সাথে রোখারা হতে হিজরত করেন এবং প্রথমে লাহোরে এসে বসবাস আরম্ভ করেন। কিছুদিন পর এ পরিবার বদায়ুনে স্থানান্তরিত হয়ে যায়। খাজা নিজামুদ্দীনের মাতা সৈয়দা জোলেখা ছিলেন এক আরব সৈয়দের কন্যা। বদায়ুনে অবস্থানকালে তার প্রথম শিশুর জন্ম হয় হিজরি ৬২৪ সালের ২৭ সফর এবং তার নাম রাখা হয় মোহাম্মদ। এ শিশু পরবর্তীকালে নিজামুদ্দীন আউলিয়াসহ বিভিন্ন উপাধি লাভ করেন।
নিজামে আউলিয়ার (ওলীদের নিজাম হতে নিজামুদ্দীন হয়েছে। দুই শব্দের মাঝখানে আদ্দীন শব্দ যুক্ত হওয়ায় নিজামুদ্দীন হয়েছে বলে নিজামুদ্দীন আউলিয়া নামে পঠিত) দাদা আলী বোখারী ও নানা খাজা আরব একই সাথে হিজরতকারী যেমন পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। পিতা সৈয়দ আহমদ জাহেরী ও বাতেনী উভয় বিদ্যায় কামেল ব্যক্তি ছিলেন। সুলতান আলতামাশ তাকে বদায়ুনের কাজী নিযুক্ত করে, কিন্তু কিছু দিন পর তিনি বাদশাহকে বলেন :
‘আপনি আমার নামাজগুলোর সামনে দুনিয়া কোথা থেকে এনে রেখে দিয়েছেন। এ পদ কোনো আগ্রহী ব্যক্তিকে প্রদান করুন।’ তিনি কাজী পদ ছেড়ে দিয়ে সারাক্ষণ আল্লাহর স্মরণে নিজেকে নিয়োজিত করেন।’ একদিন মসজিদে হঠাৎ অনুভব করেন যে, তার সমগ্র ঘর তার দিকে এগিয়ে আসছে। তিনি একে গায়েবি ইশারা মনে করে দ্রুত গৃহে পৌঁছেন। আত্মীয়স্বজনরা তাকে সন্তান জন্মের সুসংবাদ জানায়। সৈয়দ আহমদ গৃহে গিয়ে সন্তানের চেহারা দেখেন। পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় সন্তানের উজ্জ্বল চেহারা দেখে আনন্দিত হন এবং আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করেন এবং ছেলের কপাল চুম্বন করে শহরের বাইরে চলে যান।
শিশু বাড়তে থাকে। সৈয়দ আহমদ গৃহে কম আসতে থাকেন, কিন্তু শিশুর জন্য তার অসীম ভালোবাসা, তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি অবহিত ও সচেতন ছিলেন। তিনি পুত্রের নাম মোহাম্মদের স্থলে নিজাম নামে ডাকতেন। নিজাম তার পিতার সদৃশ ছিলেন। চার বছর বয়স থেকে পিতার সাথে জঙ্গলে চলে যেতেন। সৈয়দ আহমদ আল্লাহর স্মরণ ও ধ্যানে থাকতেন। নিজাম চাঁদ-সূর্যের উদায়াস্ত ও তারকারাজির চমকদমক উপভোগ করতেন। তিনি শৈশবেও কোনো নামাজ কাজা করেননি। তার মাতা অধিকাংশ সময় তাকে ওলী-দরবেশদের কেচ্ছাকাহিনী শুনাতেন। তিনি মোজাহেদ ও সাধকদের কাহিনী আকর্ষণীয়ভাবে বর্ণনা করতেন। নিজামের কাছে এসব কাহিনী এবাদত মনে হতো। তখন থেকেই তিনি চাইতেন, যদি কোথাও থেকে কোনো গায়েবি ব্যক্তি এসে এমন এক ভুবনে পৌঁছে দিত, যেখানে তার খোদা ব্যতীত কেউ থাকবে না। মাতা জোলেখা তার আদরের ছেলের এ নিষ্পাপ বাসনা শুনে হাসতেন এবং তাকে সান্ত¦না দিতেন। বলতেন, বেটা, খোদা তোমাকে উচ্চ মর্যাদা দান করুন। তবে এ জন্য তোমাকে তোমার পিতা ও নানার অনুসরণ করতে হবে। ইলম হাসেল করে প্রিয় নবীর চরিত্রে চরিত্রবান হতে হবে। নিজাম তার মাতার উপদেশ বাণী গভীর মনোযোগের সাথে শুনতেন। তার পিতার সাথে লাগাতার রোজা রাখতেন। লোকেরা বলত, নিজাম তার এখনো তোমার ওপর রোজা ফরজ হয়নি। নিজাম বলতেন, খাবারের চেয়ে রোজাই আমার কাজে মজাদার, রোজাই আমার প্রিয় খাদ্য।
সে সময়ে একদিন নিজাম একাকী গৃহ হতে বের হয়ে জঙ্গলে যাচ্ছিলেন। বিপরীত দিক থেকে এক যোগী কয়েকজন লোকসহ আসছিল। তারা নিজামকে দেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে যায় এবং কিছুক্ষণ তার দিকে এক ধ্যানে দেখতে থাকে। অতঃপর এক কদম অগ্রসর হয়ে তার পদচুম্বন করতে থাকে। তার সঙ্গীরা তাকে জিজ্ঞাসা করে, মহারাজ! এ বালকের মধ্যে আপনি কী দেখতে পেয়েছেন? যোগী বলল, ‘বালক বহু বড় মানুষ, সময় হলে দেখবে’। কেউ জিজ্ঞাসা করল, ‘এ কি শহরের শাসন কর্তা হবে?’ যোগী বলল, ‘আরে, শহরের শাসন কর্তা তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে, সালাম করার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়বে।’ অপর এক ব্যক্তি বলল, ‘তাহলে মহারাজ এ (বালক) অবশ্যই বাদশাহ হবে?’ যোগী মাথা ঝুঁকে বলল, ‘আরে বাদশাহ কি বিক্রি করবে পাগলে, সাতরাজার মুকুট তার পদতলে থাকবে।’ নিজাম আদরের সাথে ’ যোগীকে বললেন, ‘বড় মিয়া ক্ষমতা ও বাদশাহী কেবল আল্লাহর জন্য। যদি আমার আল্লাহ আমাকে পরীক্ষায় নিক্ষেপ করেন এবং আপনি জীবিত থাকেন তা হলে আমার নিকট চলে আসবেন, আমি সাতটি মুকুটই আপনাকে দান করে দেব।’ যোগী চলার পথে বলল : ‘সত্য বলেছ, আমার বেটা সত্য বলেছ তুমি’।
মাহবুবে এলাহীর পাঁচ বছর বয়সে তার পিতা খাজা আহমদ ইন্তেকাল করেন। তিনি মৃত্যুকালে দুনিয়াবি মালমাত্তা কিছুই রেখে যান নি। তাই নিজাম ও তার মাতা অত্যন্ত অভাব ও দরিদ্রের মধ্যে জীবনযাপন করতে থাকেন। অধিকাংশ সময় অভুক্ত থাকার মতো পরিস্থিত দেখা দিত। যেদিন ঘরে কোনো খাদ্য থাকত না, নিজামের মাতা মুচকি হেসে বলতেন, ‘নিজাম আজ আমরা আল্লাহর মেহমান।’ এ কথা নিজামের খুব পছন্দ হতো, আল্লাহর মেহমান হওয়া কি মজার ব্যাপার। কখনো যদি দুই তিন দিন লাগাতার খানা পাকাতো, তখন তিনি অজ্ঞাতসারে বলতেনÑ ‘মা! এখন তো অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে গেল, আমরা কখন আল্লাহর মেহমান হব?’
নিজামের মাতা জোলেখা ছিলেন অত্যন্ত এবাদতগুজার। লেখকগণ তার বহু কারামতের কথা উল্লেখ করেছেন। বহু অলৌকিক ঘটনার অধিকারিণী এ তাপসী খাতুনের পৃষ্ঠপোষকতায় নিজামের লালন-পালন হতে থাকে। তার মাতা কোরআন শিক্ষার জন্য তাকে মক্তবে পাঠিয়ে দেন। যেহেতু তিনি অসাধারণ মেধা ও ধীশক্তির অধিকারী ছিলেন তাই অল্প দিনের মধ্যে কোরআন পাঠ খতম করেন ও আরবির প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করতে থাকেন এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই তা শেষ করেন। তিনি ফিকার কিতাব কুদুরী বদায়ুনের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আলাউদ্দীন উসুলীর নিকট খতম করেন। এ কিতাব শেষ করা উপলক্ষে তার মাতা শহরের উলামা-মাশায়েখকে একত্রিত করেন এবং নিজ হাতে বুনা পাগড়ি দস্তারে ফজিলত হিসেবে নিজামের মাথায় তাদের হাতে বাঁধান। এ সময় কোনো সাহেবেহাল ব্যক্তি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, এ বালকের মাথা কোনো মানুষের সামনে নত হবে না। এ ভবিষ্যদ্বানী তার জীবদ্দশায়ই বাস্তবায়িত হয়েছিল।
অধিক শিক্ষার জন্য নিজামের মাতা তাকে সঙ্গে করে দিল্লিতে আসেন এবং সেখানে তিনি বিখ্যাত আলেমেদ্বীন মাওলানা শামসুদ্দীন ও মাওলানা কামলুদ্দীন জাহেদের কাছে শিক্ষা লাভ করেন। এ দুজন আলেমও কাছে ছওমে জাহেরী শিক্ষা লাভ করে তার যুগের বিখ্যাত ওলামা-মাশায়েখের অন্তর্ভুক্ত হন। এ দুইজন বুজুর্গ সে যুগের সেরা আলেমদের মধ্যে গণ্য হতেন। সুলতান বলবনের ওপর তাদের ব্যাপক প্রভাব ছিল এবং বলবনও তাদের প্রতি অত্যন্ত সম্মান প্রদর্শন করতেন। অল্প দিনের মধ্যেই নিজাম জাহের ইলমসমূহের সনদ লাভ করেন এবং সব শাস্ত্রেই পারদর্শিতা অর্জন করেন এবং সেরা আলেমদের মধ্যে গণ্য হতে থাকেন। এভাবে তার খানকাহ একদিকে যেমন বাতেনী জ্ঞান কেন্দ্রে পরিণত হয়ে যায়, তেমনি জাহের জ্ঞানও শিক্ষার কেন্দ্রে রূপ নেয়। বারো বছর বয়সের মধ্যে তার শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটে। যার পেছনে তার মায়ের ভূমিকা ছিল প্রধান। খাজা নিজামুদ্দীনের শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার পর তার মায়েরও অন্তিম অবস্থা। তার ইন্তেকালের দিন ভোরে তিনি পুত্রের হাত ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি নিজামকে তোমার কাছে সোপর্দ করছি। আজ হতে সে তোমার নিজাম। এ কথা বলেই তিনি চোখ বন্ধ করে নেন। মাতা জোলেখার প্রতি খাজা নিজামের ছিল অগাধ ভক্তি-ভালোবাসা। এ শোকাবহ ঘটনা ছিল তার জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক। সারাজীবন যিনি সুতার কাজ করে পুত্রের লেখাপড়া ও বইপুস্তক কিনে শিক্ষা খরচ চালিয়েছেন এবং অনেক সময় অভাব-অনটন তথা মাতা-পুত্র অতি কষ্টে জীবন কাটিয়েছেন সে আত্মত্যাগী মায়ের কথা খাজা নিজাম ভুলতে পারেননি। মায়ের কথা স্মরণ হলে তিনি অশ্রুসজল হয়ে বলতেনÑ এ বেদনা বিস্মৃত হওয়ার জন্য তিনি শায়খ নজীবের সাথে মেলামেশা করে সময় কাটাতেন।
শায়খ গঞ্জে শকরের খেদমতে
শায়খ ফরিদউদ্দীন গঞ্জে শকরের ভাই ও খলিফা ছিলেন শায়খ নজীবুদ্দীন মোতাওয়াক্কেল (রহ.)। তার সম্পর্কে হজরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া (রহ.)-এর একটি ঘটনা প্রসিদ্ধ। খোদ হযরত খাজা বলেন :
‘শায়খ ফরিদউদ্দীনের সাথে সাক্ষাৎ লাভের আগের কথা। একদিন আমি শায়খ নাজিবুদ্দীনের খেদমতে হাজির এবং আরজ করি যে, একবার সূরা ফাতেহা ও সূরা এখলাস এই নিয়তে পড়–ন যাতে আমি কোন স্থানের কাজী নিযুক্ত হই। শায়খ নাজিবুদ্দীন শুনেও না শোনার ভান করেন। আমি মনে করলাম যে, তিনি আমার আবেদন শোনেননি। তাই আমি আবার আরজ করি যে, একবার সূরা ফাতেহা ও সূরা এখলাস এই নিয়তে পাঠ করুন যেন আমি কোনো স্থানের কাজী নিযুক্ত হই। এবার তিনি মুসকি হেসে বললেন, তুমি কাজী না, অন্য কিছু হও।
এ ঘটনা প্রমাণ করে যে, সূরা ফাতেহা ও সূরা এখলাসের যে মহিমা মাহাত্ম্য রয়েছে তা এ দুজন মহান অলিউল্লাহর কথোপকথন হতে জানা যায়। তাছাড়া শায়খ নাজিবুদ্দীন খাজা নিজামুদ্দীনের আহ্বানের সাড়া না দেওয়ায় পরবর্তীকালে যে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন, তা বলাই বাহুল্য।
(অসমাপ্ত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন