গত আলোচনায় হাদিয়া-উপহার আর অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ রক্ষা করার মৌলিক কথাগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা সামাজিকভাবে এ বিষয়টি যেভাবে নিজেদের ওপর চাপিয়ে নিয়েছি, এখন তা নিয়ে অবশ্যই ভাবনার অবকাশ আছে। স্বাভাবিক সময়ে কেউ যদি কারো অতিথি হয় তাহলে সাধারণত গৃহকর্তাদের জন্যে কিছু একটা নিয়েই যায়। এক্ষেত্রে অবশ্য কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যার যা ইচ্ছা তাই নেয়। দামি-কমদামি নানান রকমের জিনিসই মানুষ নিয়ে যায় অতিথি হিসেবে। এটাও হাদিয়া, আবার অতিথির আপ্যায়নও তো একপ্রকার হাদিয়া। কিন্তু সঙ্কট হল বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে। বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠান, আকীকার অনুষ্ঠান, এ জাতীয় আরো যত অনুষ্ঠান, সেখানে যদি কাউকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়, তবে সে নিমন্ত্রণ কেউ কেউ যেমন খুশিমনে গ্রহণ করে এবং তা সাগ্রহে রক্ষাও করে, আবার এই নিমন্ত্রণ অনেকের জন্যেই বিপদেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যাদের অভাবের বা টানাটানির সংসার, কিংবা যাদেরকে চলতে হয় অত্যন্ত মিতব্যয়িতার সঙ্গে এবং একটি নির্দিষ্ট আয় দিয়ে, তারা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আর প্রতিবেশীর এরকম আনন্দ অনুষ্ঠানের সংবাদে ও নিমন্ত্রণে যেমন আনন্দিত হয়, পরক্ষণেই আবার দুশ্চিন্তায়ও ছেয়ে যায় তাদের চেহারা। কারণ সেখানে একটা মানসম্মত ‘গিফট’ দিতেই হবে।
সামর্থ্য যতটুকু আছে তাতে মান রক্ষা হয় না। আর মান রক্ষা করতে গেলে নিজের ক্ষমতায় কুলোয় না। আপনজন কারো বিয়েতে বা অন্য কোনো আয়োজনে শরিক না হওয়ার কোনো ইচ্ছাও নেই, আবার সামাজিকতা রক্ষা করে সেখানে শরিক হওয়ার মতো স্বচ্ছলতাও নেই। এ এক উভয়সঙ্কট। আর বিয়ের দাওয়াতের অর্থই হল, আপনাকে উপস্থিত হতেই হবে এবং মানসম্মত উপহারও নিয়ে যেতে হবে। এ উপহার গ্রহণ করার জন্য করা হয় নজরকাড়া আয়োজন। তা আবার ‘দলিলস্বরূপ’ লিখেও রাখা হয়। এরপর চলে হিসাব, কে কত দিল এবং কত খরচ হল আর কত টাকা উঠে এল। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, তবে আমাদের সমাজের স্বাভাবিক বাস্তবতাটা এমনই।
একটা সময় যখন বিভিন্ন উপহারসামগ্রী কিনে দেয়ার রেওয়াজ ছিল, তখন এ রেওয়াজের মধ্যেও একটু আন্তরিকতার ছোঁয়া ছিল। কিছু উপহার ঘরে স্মৃতি হিসেবে রেখে দেয়া হত, কিছু আবার ভাই-বোন কিংবা এজাতীয় কাছের আত্মীয়দের মধ্যে বণ্টন করা হত। ওসব এখন আর নেই বললেই চলে। এখনকার বাস্তবতা হল, দাওয়াত দিলাম, আসবেন, খাবেন এবং টাকা দিয়ে চলে যাবেন। আরো মজার বিষয় হল, এ উপহার যেন ‘মানসম্মত’ হয় সেজন্য অনুষ্ঠানের তারিখটাও ‘সুবিধামতো’ নির্ধারণ করা হয়।
এর প্রতিক্রিয়া বিপরীত দিক থেকেও হয়। নিমন্ত্রণ জানানো হল একজনকে, কিন্তু টাকা যা দিতে হবে তা তো একজন খেয়ে ‘পোষাতে পারবে’ না। তাই নিমন্ত্রকের অনুমতি এবং সম্মতি ছাড়াই সে নিয়ে যায় তার ছেলে, ভাই কিংবা বন্ধুকে। যেন পুষিয়ে আসার একটু চেষ্টা! এতে যে নিমন্ত্রণকারীর অতিথি আপ্যায়নে ব্যাঘাত ঘটবে না- এ নিশ্চয়তা দেবে কে? একটি অন্যায় সামাজিকতা এভাবেই আরেকটি অন্যায়কে টেনে নিয়ে আসে।
আমরা যদি এ থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে চাই, তাহলে প্রথমেই এগিয়ে আসতে হবে নিমন্ত্রকদের। তারা যদি অনুষ্ঠানে কেবল অতিথিকেই বরণ করে আর উপহার গ্রহণের আনুষ্ঠানিক কোনো ব্যবস্থা না রাখে, তবে অনেকাংশেই দুর্বল হয়ে পড়বে এ অন্যায় সামাজিকতা। আর যারা অতিথি, তারাও যদি একটু হিম্মত করতে পারেন, তাহলে তো দাফনই হয়ে যেতে পারে এ অন্যায়ের।
কিছু কিছু মানুষকে উদ্যোগী হতে দেখাও যায়। হয়ত এ উপলদ্ধি থেকেই তারা ওলিমার দাওয়াতপত্রে লিখে দেন, ‘দয়া করে সাথে কোনো গিফট আনবেন না’। এ উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। এর দ্বারা নিমন্ত্রিত অতিথিদের অনেকেরই হয়ত টনক নড়বে। আরো মানুষ উদ্যোগী হবে।
যাহোক, সামাজিক চাপ নয়; হাদিয়া আদান-প্রদান হওয়া উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। ইসলামের হাদিয়ার যে ধারণা ও শিক্ষা সে অনুসারে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য (কাউকে কিছু) দেয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই দেয়া থেকে বিরত থাকে; আল্লাহর জন্যই যে ভালোবাসে আর আল্লাহর জন্যেই যে ঘৃণা করে, ... সে তার ঈমান পূর্ণ করল। (জামে তিরমিজি : ২৫২১)।
তাই প্রচলিত সামাজিক রীতি-রেওয়াজের অন্ধ অনুসরণ নয়,পূর্ণ ঈমানের অধিকারী হতে চাইলে প্রাধান্য দিতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টিকেই। সমাজ কী বলল, সেটা দেখার বিষয় নয়। এটাই মুমিনের বৈশিষ্ট্য, মুমিনের পরিচয়। সামাজিকতার চাপে নয়, কাউকে যদি কিছু সে উপহার দেয়, তাহলে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই দেবে, যদি কাউকে না দেয়, তাহলে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই দেয়া থেকে বিরত থাকবে। ঈমানের পূর্ণতার জন্য আমাদেরকে এখানে উঠে আসতেই হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন