শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ

| প্রকাশের সময় : ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এবি সিদ্দিক : মরহুম আবদুল মোহাইমেন তার দুই দশক স্মৃতি গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যতদূর শুনেছি ঢাকার দাঙ্গা মুসলমান হিন্দু দুই এলাকা থেকেই আরম্ভ হতো। শহরের মুসলমানরা যেহেতু গরিব ও অধিকাংশই শ্রমজীবী তাই দাঙ্গার সময় তাদের প্রায় না খেয়ে উপোষ করে মরার মত অবস্থা হত, তাছাড়া প্রশাসনে পুলিশে হিন্দুদেরই আধিপত্য ছিল বলে দাঙ্গা বাধলে মুসলমানরাই বেশি মার খেত, ক্ষতিগ্রস্তও হতো বেশি এবং পুলিশ রিপোর্টের ফলে জেলজরিমানারও বেশি সম্মুখীন হতো। ঢাকায় তখন যুগান্তর ও অনুশীলন পার্টির খুব জোর। এসব পার্টির শিক্ষাধীন হিন্দু যুবকরা তখন খুব সাহসী ও যোদ্ধাসুলভ মনোভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। অশিক্ষিত দরিদ্র অসহায় মুসলমানরা যতই প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের দ্বারা অবহেলিত হচ্ছিল, তাচ্ছিল্যপূর্ণ ব্যবহার পাচ্ছিল ততই তারা শাসক ইংরেজ সম্প্রদায়কে ত্রাণকর্তা হিসেবে বেশি করে আঁকড়ে ধরে তাদের বসংবদ হতে চাচ্ছিল। এতে ভারতকে বিদেশী শাসন মুক্ত করার মনোভাব সম্পন্ন হিন্দু যুবক সম্প্রদায়ের মনোভাব মুসলমানদের প্রতি ক্রমাগত কঠোর ও বৈরী হয়ে উঠছিল। এখানে মনে রাখতে হবে, ঢাকাতেই ১৯০৬ সনে মুসলীম লীগের জন্ম হয়। ১৯২০ সন থেকে ১৯৪৬ সন পর্যন্ত ঢাকায় যতগুলো দীর্ঘস্থায়ী হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা হয়েছে এত সংখ্যক দাঙ্গা অখ- বাংলার আর কোন স্থানেই হয়নি। আরো আশ্চর্যের বিষয়, এসব দাঙ্গা আরম্ভ হতো সাধারণত লাটিম খেলা, ঘুড়ি ওড়ানো, মসজিদের সামনে বাজনা বাজানোর মত সাধারণ ব্যাপারকে উপলক্ষ করে। তখনকার হিন্দু সমাজে ছুরি মারামারির ব্যাপারটা বাল্যকাল থেকেই ছোট ছেলেদের কিভাবে শিক্ষা দেয়া হত তার একটা উল্লেখ দেখা যায় কিছুদিন আগে সর্দার ফজলুল করিম কর্তৃক পুরান দিনের ৪০-শের ঢাকা সম্পর্কে লেখা দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধে। তিনি লিখেছেন, তার বাবা তখন সূত্রাপুরা থানার ওসি সেখানে আরও কয়েকজন হিন্দু পুলিশ অফিসার ছিল। দাঙ্গার সময় একদিন বাল্য বয়সে আরও কয়েকটি হিন্দু মুসলমান অফিসারদের ছেলেরা এক সাঁঝে লাটিম খেলছিল। ছেলেদের মধ্যে খেলা নিয়ে একটু বচসা হতেই একটি আট বৎসরের হিন্দু ছেলে হঠাৎ পকেট থেকে একটি ছুরি বের করে অন্য ছেলেদের সাঁশাতে লাগল। যা হোক বয়স্ক লোকেরা মাঝে পড়ে থামিয়ে দেয়ার ব্যাপারে আর বেশিদূর গড়াতে পারেনি’ (পৃষ্ঠা ৩৫/৩৬)।
এবার আমার কিছু স্মৃতির কথা বলি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি কিশোর। কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার জালুয়াপাড়া আমাদের গ্রাম। আশপাশ অনেক হিন্দু বাড়ি। এর মধ্যে প্রভাবশালী হিন্দু পরিবার হলো পালবাড়ি। পটল চন্দ্র পাল বয়স্ক লোক আর আমার বাবারও বয়সে বড়। আমি উনাকে দাদা বলে ডাকতাম। তার ছেলে হরিবল চন্দ্র পাল, ব্রজেন্দ্র পাল, সন্তোষ পাল। ভাতিজা সুনিল চন্দ্র পাল প্রমুখ। যুদ্ধ শুরু হতেই পটল চন্দ্র পাল ছাড়া সবাই ভারতে চলে যায়। পটল পালকে আমাদের এলাকার মুসলমানেরা লুকিয়ে রাখতো যেন পাকসেনারা বা রাজাকাররা খুঁজে না পায়। আর পাল বাড়িসহ আশপাশের হিন্দু বাড়িগুলো যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য আমার ভাইয়েরা বা আমাদের পাড়া-প্রতিবেশী মুসলমানেরা দিন-রাত পাহারা দিত। যুদ্ধ শেষ হল, দেশ হলো স্বাধীন। হিন্দুরা তাদের বাড়িঘরে ফিরে এলেন। পটল চন্দ্র পালের পরিবারটা ছিল বেশ বড়। বিশাল এলাকাজুড়ে বাড়ি। যুদ্ধকালীন সময়ে তাদের বাড়িঘর, গাছপালা কোন কিছুরই ক্ষতি হয়নি বা ক্ষতি হতে দেয়নি মুসলমানেরা। দুঃখের বিষয় হলো যে, পটল পালের পরিবার থেকে অভিযোগ উঠলো যে, তাদের নাকি একটা কাঁসার থালা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ কথাটা আমার বড় ভাই রোস্তম আলীকে বললো পটল পাল। পরে একটি কাঁসার থালা কিনে দিল আমার আরেক প্রতিবেশী চাচাতো ভাই দ্বীন মুহাম্মদ (দুলু)। আমার বাবা (তৈয়ব আলী) ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় মারা যান তখন তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। আমাদের কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর উপজেলাধীন গাঙ্গাটিয়া জমিদারবাড়ির একজন কর্মচারী ছিলেন আমার বাবা। জমিদার ছিলেন অতুলপ্রসাদ রায়। জমিদারবাড়ির গোলাঘর, কাচারিঘর সবই ছিল আমাদের বাড়িতে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময়ে যখন অতুল প্রসাদ রায় সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে ভারতে পাড়ি জমান তখন আমার বাবাকে বিনামূলে অনেক জায়গাজমি লিখে দিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু আমার বাবা কোন সম্পদ নেননি। যাক সেসব কথা। আমরা এখন যাদের সংখ্যালঘু বলি তাদের বেশিরভাগই হিন্দু। আর এদেশে ১৯৪৭-এর আগে হিন্দুদেরই প্রভাব ছিল। আমার বাবা-মার কাছে শুনেছি যে, হিন্দু বাড়ির সামনে দিয়ে কোন মুসলমান জুতা পায়ে দিয়ে বা ছাতা মাথায় দিয়ে যেতে পারত না। যে পালদের কথা আগে বললাম তাদেরই একজন উপেন্দ্র পাল। চিরকুমার। আমার বাবা তার জমি ভাগে চাষ করতেন। আমি তাকে দাদা ডাকতাম। আমার পরিষ্কার মনে আছে- একটি ঘটনার কথা। তখন আমি ৫ম শ্রেণীর ছাত্র সালটা ১৯৭০। উপেন্দ্র বাবুর বাড়ির পাশে তারই জমিতে ধানের চারা রোপণ কাজ করছে আমার বাবা, দুই ভাই আরো একাধিক ব্যক্তি। উপেন্দ্র বাবু আমাকে ডাক দিলেন- এই বাচ্চু (আমার ডাকা নাম) এদিকে আয়। আমি গেলাম। আমাকে বললেন, হাত পাত, আমি হাত পাততেই বললেন নিচে হাত পাত, তাই করলাম। তিনি তার গাছের ৪/৫ লিচু আমার হাতের উপর ছেড়ে দিলেন। আমার হাতে স্পর্শ তার হাতে লাগতে দিলেন না। যাক সেসব কথা।
স্বাধীন বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু’ বলে একটা কথার প্রচলন ঘটেছে। এটা চালু করেছে রাজনীতিকরা। কেউ বলছেন সংখ্যালঘু, কেউ বা বলছেন সংখ্যালঘু বলতে কিছু নেই। আসলেই তো এদেশে সংখ্যালঘু বলতে কেউ নেই। সবাই আমরা বাংলাদেশী। একদিকে মসজিদে আযান, অপরদিকে উলুধ্বনি। সব ধর্মের মানুষ যে যার মত করে ধর্ম-কর্ম করছে। হিন্দু-মুসলিম সবাই আমরা ভাই ভাই। তবে দুঃখের বিষয়টা হলো যে, রাজনৈতিক কারণে এদেশের স্বার্থান্বেষী মহল একটা বিভক্তির সৃষ্টি করছে বা করে যাচ্ছে। সংখ্যালঘু নির্যাতন বলতে বিছিন্নভাবে যা হচ্ছে তা রাজনৈতিক কারণে। আর এই ইস্যু তুলে মুসলিম সম্প্রদায়কে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হেয় করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। শুধু তাই নয়, মহলে বিশেষের কাছে ইসলাম ও মুসলমান যেন তাদের গায়ে বিষফোড়া হয়ে দেখা দিয়েছে বা দিচ্ছে। মুসলমান মানেই তাদের কাছে মৌলবাদী আর দাড়ি-টুপি হলো রাজাকারের প্রতীক। মুসলমানের সন্তানেরাই মুসলমানদের অকারণে বলছেন “মৌলবাদী”। কোন হিন্দুতো মুসলমানকে মৌলবাদী বলে বলে না। মাঝে মধ্যে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কেন, এ নিয়ে ওঠে নানা কথা। কিছু ব্যক্তি, গোষ্ঠী আর কিছু গণমাধ্যসম রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলের বিষয়ে বেশ সোচ্চার। তাদের ভাষায় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম অসাম্প্রায়িক বাংলাদেশের জন্য বড় বাধার কারণ। অথচ ইসলাম ধর্মে সাম্প্রদায়িকতার কোন স্থান নেই। ইসলামের বিধান স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেনে চলা তার ওপর বাধ্যতামূলকভাবে চাপিয়ে দেয়া হয়নি। এর ফলে মানুষের মধ্যে যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে ধর্মীয় উগ্র সাম্প্রদায়কিতা। আর প্রকৃতপক্ষে ইসলাম এ ধরনের সাম্প্রদায়কিতা কখনো অনুমোদন করে না। বরং সাম্প্রদায়িকতা উচ্ছেদ করে পারস্পরিক শান্তি ও সৌহার্দ্যমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠা করাই ইসলামের মূল লক্ষ্য। মুসলিম সম্প্রদায়ের আচার-অনুষ্ঠানগুলো অন্য কোনো অমুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর চাপিয়ে দেয় না। এ বিষয়ে আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘দ্বীন তথা জীবনবিধান গ্রহণের ব্যাপারে কেনো জবরদস্তি নেই; কেননা সত্য পথ হতে ভ্রান্ত পথ সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।’ (২:২৫৬) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের দ্বীন বা ধর্ম তোমাদের জন্য আর আমাদের দ্বীন বা ধর্ম আমাদের জন্য।’ (১০:৯:৬) বস্তুত ইসলামরে মূল কথা হচ্ছে একদিকে মুসলিম সম্প্রদায় পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান ইসলামের ধর্মীয় ও বৈশ্বিক অনুশাসন জীবনের সব ক্ষেত্রে পুরোপুরি মেনে চলে একটি আদর্শ সমাজ ও দুনিয়া গড়ে তুলবে যার সুফল অন্য সব সম্প্রদায়ের লোকরা ভোগ করবে এবং এর প্রতি আকৃষ্ট হবে। অপরদিকে অন্য সম্প্রদায়ের লোকদের স্বাধীনভাবে তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করার সুযোগ দেবে এবং তাতে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে না। আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা তাদের গালমন্দ করো না, আল্লাহ ছাড়া যাদের তারা ডাকে তারা গালমন্দ করবে আল্লাহকে শত্রুতা পোষণ করে অজ্ঞতাবশত।’ (৬:১০৮) ‘নর হত্যা এবং দুনিয়াতে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করার অপরাধ ব্যতীত যে ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করল সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করল। আর যে তাকে বাঁচাল যেন সব মানুষকেই বাঁচাল।’ (৫:৩২) সমাজের ধর্মান্ধতা এবং উগ্র সাম্পদায়িকতা রোধে এই আয়াতগুলোর কার্যকারতিা প্রণিধানযোগ্য। ইসলাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল নমুনা হলো আল কুরআনের ভাষায় বিশ^জগতরে সব সৃষ্টির প্রতি করুণার আধার বিশ^নবী হজরত মুহাম্মদ (সা:)-এর জীবন চরিত্র তথা তাঁর কথা, কাজ এবং অনুমোদন যার অপর নাম সুন্নাহ। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, নবী করিম (সা:) কসম খেয়ে তিনবার বললেন, ‘সেই লোক প্রকৃত ঈমানদার নয় যার অনিষ্ট হতে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়।’ (বুখারি, মুসলিম) অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি পেট ভরে আহার করল অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্থ থাকল সে মুমিন নয়।’ (বুখারি, মুসলিম) আরেক হাদিসে এসেছে, ‘যখন তুমি খাবার রান্না করবে তখন তাতে তুমি অতিরিক্ত পানি দিয়ে ঝোল বাড়াবে যাতে তুমি তোমার প্রতিবেশীর খবর নিতে পারো।’ (মুসলিম) একবার নবী করিম (সা:) মুসলিম নারীদের সম্বোধন করে বললেন, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিবেশীদের বাড়িতে খাদ্যদ্রব্য পাঠানোকে তুচ্ছ মনে করো না। যদিও তা বকরির পায়ের সামান্য অংশও হয়ে থাকে।’ (বুখারি, মুসলিম) একবার নবী করীম (সা:) সাহাবিদের এক প্রশ্নরে জবাবে বললেন, ‘তোমাদের নিকটতম প্রতিবেশীকে সহযোগিতা দেয়ার ব্যাপারে অগ্রাধিকার দেবে।’ (বুখারি) বর্ণিত হাদিসগুলোতে প্রতিবেশী বলতে যে কোন ধর্ম, বর্ণ, গোত্রীয় সম্প্রদায়ের প্রতিবেশীকে বোঝানো হয়েছে। মুসলমান ও ইসলাম অন্য কোন ধর্মের মানুষকে আঘাত করে না, খাটো করেও দেখে না। বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ। এদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা অন্য সব ধর্মের মানুষকে আপন করেই দেখে। সবাই এদেশের নাগরিক আর একে অপরের ভাই ভাই। যারা এদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে চায় বা এ ধরনের ইস্যু তুলে বিবেদ সৃষ্টি করতে চায় তারা মূলত তা করে ব্যক্তি স্বার্থেই।
লেখক: সাংবাদিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন