চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের প্রধান ছাত্রাবাসে একটি কক্ষে আটকে চার ছাত্রকে টানা একদিন এক রাত নির্যাতন করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুইজন এখন চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে। বাকি দুইজনকে আহত অবস্থায় বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য করার অভিযোগ রয়েছে নির্যাতনকারী ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবার রাতে ওই দুই ছাত্রকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হলে তাদের উপর পাশবিক নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ পায়। বেরিয়ে আসে ছাত্রলীগের আরো একটি অপকর্মের কাহিনী।
চট্টগ্রামে সরকারি দলের এই ছাত্র সংগঠন এখন যে কোন সময়ের তুলনায় বেপরোয়া। প্রতিটি অঘটনেই আসছে তাদের নাম। ওমর গণি এম ই এস কলেজের অর্থনীতি বিভাগের এক শিক্ষিকাকে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করেন এক ছাত্রলীগ নেতা। চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে ফের পরীক্ষা দিতে গিয়ে এক শিক্ষককে গালাগাল ও দেখে নেয়ার হুমকি দেয় ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে আন্দোলনরত চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের উপর হামলা ও এক নারী সাংবাদিককে লাঞ্ছিত করার ঘটনায়ও জড়িত ছাত্রলীগ। পছন্দের প্রার্থীকে শিক্ষক পদে চাকরি না দেওয়ায় চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি অফিসে হানা দিয়ে ভাঙচুরের সাথে জড়িত হয় ছাত্রলীগ। গত কয়েক দিনে সংগঠিত এসব ঘটনায় চট্টগ্রামজুড়ে তোলপাড় চলছে। অথচ নিজেদের ছাত্র সংগঠনের এমন দুর্বৃত্তপনার লাগাম টানার ক্ষেত্রে নির্বিকার সরকারি দলের মন্ত্রী নেতারা। এর ফলে অপকর্মে ছাত্রলীগের রীতিমত বেপরোয়া আচরণে অসহায় প্রশাসন।
সর্বশেষ ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হয় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ৬২তম ব্যাচের চার শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে জাহিদ হোসেন ওরফে ওয়াকিল (২২) ও সাকিব হোসেনকে (২২) চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে। ছাত্রশিবির সন্দেহে গত বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত চমেকের প্রধান ছাত্রাবাসে জিম্মি করে তাদের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নির্যাতন করে বলে অভিযোগ। একই সময় এস এ রায়হান (২১) ও মোবাশ্বির হোসেন (২২) নামের অপর দুই ছাত্রকে নির্যাতন করে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বুধবার রাতে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী ওই চার ছাত্রকে ছাত্রাবাসের নিজ নিজ কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে যান। পরে তাদের অন্য একটি কক্ষে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। তাদের আত্মচিৎকারে ছাত্রাবাসে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও কেউ তাদের রক্ষায় এগিয়ে আসেনি। সেখানে থাকা পুলিশ সদস্যরাও ছিলেন নির্বিকার। টানা নির্যাতনে ওই চারজনের শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম হয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাদের নির্যাতন শেষে কক্ষ থেকে বের করে নিজেদের কক্ষের বদলে বাড়ি চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয় নির্যাতনকারীরা। আহত অবস্থায় রায়হান ও মোবাশ্বির বাড়িতে ফিরে যান। গুরুতর আহত জাহিদ ও সাকিব চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান।
চমেক হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলছেন, নির্যাতনে তারা গুরুতর আহত হয়েছেন। তবে আইসিইউতে তাদের অবস্থা শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত স্থিতিশীল ছিল। জানা গেছে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী চমেক ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী এ ঘটনায় জড়িত। যদিও হামলার শিকার ছাত্ররা প্রাণভয়ে কারও নাম বলেননি বলে পুলিশ ও চমেক কর্তৃপক্ষ জানায়। এই বিষয়ে চমেক প্রিন্সিপাল প্রফেসর সাহেনা আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, চমেকে রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তারপরও কেন এই ঘটনা ঘটল, কারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তা চমেকের অভিযোগ নিষ্পত্তি কমিটি খতিয়ে দেখছে। চমেক ছাত্রলীগের মহিবুল হাসানপন্থী গ্রæপের নেতা অভিজিৎ দাশ সাংবাদিকদের বলেন, ওই চার শিক্ষার্থী ছাত্রশিবির করেন। গোপনে এই কাজগুলো তারা করে যাচ্ছিলেন। তাদেরর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে কোনো নির্যাতন করা হয়নি। চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনজুর কাদের গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, প্রধান ছাত্রাবাসে চার ছাত্রকে নির্যাতন করার খবর পেয়ে ছাত্রাবাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তবে নির্যাতনের বিষয়ে কেউ থানায় কোন অভিযোগ করেনি। দুই ছাত্র চমেকে আছে, বাকি দুইজন বাড়ি চলে গেছে।
ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরকে তাড়িয়ে গত দেড় দশক ধরে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে একচ্ছত্র আধিপত্য চালিয়ে যাচ্ছে ছাত্রলীগ। চমেকে ছাত্রলীগের দুটি ধারা সক্রিয়। মহিবুল হাসানের বাইরে সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের একটি পক্ষ চমেকে সক্রিয়। ২০২১ সালের ৩০ অক্টোবর ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মারামারির পর চমেক বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তখন মারামারিতে মহিবুল হাসানপন্থী মাহাদি জে আকিব নামের এক ছাত্র গুরুতর আহত হয়েছিলেন। এরপর চমেক ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়। অভিযোগ রয়েছে ছাত্র নির্যাতনের সাথে জড়িতরা অপকর্মের দায়ে কলেজ থেকে বহিঃস্কৃত হলেও তারা প্রধান ছাত্রাবাসে থাকছে। তাদের কাছে অসহায় প্রশাসন।
এর আগে বৃহস্পতিবার চবি ক্যাম্পাসে চারুকলা ইনস্টিটিউটকে ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাকর্মী। এসময় ভিডিও ফুটেজ নিতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত এক সাংবাদিককে হেনস্তা করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ভুক্তভোগী মারজান আকতার সাংবাদিকদের বলেন, ছাত্রলীগের অনুসারীরা যখন চারুকলার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বাধা দিচ্ছিলেন, তখন পেশাগত দায়িত্ব হিসেবে আমি ফুটেজ নিচ্ছিলাম। এ সময় ছাত্রলীগের ভিএক্স গ্রæপের অনুসারীরা এসে আমাকে আটকায় এবং ভিডিও ডিলিট করার জন্য চাপ দিতে থাকে। আমি ভিডিও ডিলিট করবো না বলায় তারা আমাকে বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করতে থাকে। এ সময় তারা বলছিলো তোর নিরাপত্তা কে দেয় আমরা দেখবো। কয়েক দিন আগে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় নিজেদের পছন্দের প্রার্থী নিয়োগ না পাওয়ায় ভিসি অফিসে চড়াও হন ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী। তারা সেখানে ভাঙচুর করেন। চবিতে নানা উপদলে বিভক্ত ছাত্রলীগ প্রতিনিয়তই নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের বেপরোয়া কর্মকাÐে অসহায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
চট্টগ্রাম পলিকেটনিকে পছন্দের জায়গায় বসতে না দেয়ায় এক ঘণ্টা পরীক্ষার দিয়ে বের হয়ে যায় তিন শিক্ষার্থী। এরপর তারা ফিরে এসে শিক্ষককে ভয়ভীতি দেখিয়ে আবার সেই খাতা ফেরত নিয়ে পরীক্ষা দেয়। এসময় তারা শিক্ষক জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর প্রকাশ সিকদারকে গালাগাল ও দেখে নেয়ার হুমকি দেয়। এতে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বাধ্য হয়ে তাদের ফের পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেন। প্রকাশ সিকদারের ভাষ্য অনুযায়ী, পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে তারা ইনস্টিটিউটের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছাত্রলীগ নেতা শাহাদাত হোসেন ওমরসহ কয়েকজনে ডেকে আনে। ছাত্রলীগ নেতারা তিন ছাত্রকে খাতা ও প্রশ্নপত্র ফেরত দিয়ে ফের পরীক্ষায় বসতে দেওয়ার দাবি জানায়। প্রকাশ সিকদার অস্বীকৃতি জানালে তারা শিক্ষককে অকথ্য ভাষায় গালাগাল ও হুমকি-ধমকি দেয়।
খবর পেয়ে তিনজন বিভাগীয় প্রধান ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের খাতাগুলো ফেরত দেয়ার নির্দেশ দেন। খাতা ফেরত পেয়ে তিন ছাত্র তাদের পছন্দমতো আসনে বসে পরীক্ষা দেন। ওই দিন রাতে প্রকাশ সিকদার জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে নগরীর খুলশী থানায় জিডি করেন। পরদিন অবশ্য এই ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি হয়েছে। শাহদাত হোসেন ওমর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের বলয়ের যুবলীগ নেতা মো. মহিউদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
এর আগে মঙ্গলবার প্রকাশ্যে শত শত শিক্ষার্থীর সামনে ওমর গনি এম ই এস কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষিকা ববি বড়–য়াকে শারিরকভাবে লাঞ্ছিত করেন ডবলমুরিং থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাকিব হায়দার। শিক্ষিকা তাৎক্ষণিক বিষয়টি শিক্ষা উপমন্ত্রীকে জানান। লাঞ্ছনার শিকার শিক্ষিকা বলছেন, এই ঘটনায় তিনি স্তম্ভিত, অপমানিত এবং লজ্জিত। চট্টগ্রামে প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের দাপট চলছে। অন্যকোন ছাত্রসংগঠন কোথাও প্রকাশ্যে কোন কর্মকাÐ চালাতে পারে না দীর্ঘদিন ধরে। এই অবস্থায় প্রায় প্রতিটি কলেজে নিজেরা নিজেরা মারামারিতে জড়িয়ে পড়ছে ছাত্রলীগ। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা অপকর্মে জড়িত কিছু ছাত্রলীগ কর্মীকে বহিস্কার করা হলেও তারা ক্যাম্পাসে দাপট চালিয়ে যাচ্ছে। চবিতে বহিস্কৃত হওয়ার পরও ছাত্রলীগ নেতাদের পরীক্ষায় অংশ নেয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। ##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন