শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

আতঙ্কের নাম ছাত্রলীগ!

ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন এখন অপরাধীদের আশ্রয়স্থল যেখানেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ পাচ্ছি সেখানে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করছি : শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন। বিগত শতকের পঞ্চাশ, ষাট, সত্তুর দশকে সংগঠনটির নাম শুনলে মানুষ সমীহ করতেন। বহু বছর সংগঠনটি প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা রেখেছে। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সেই ছাত্রলীগের নাম শুনলে মানুষ এখন আতঙ্কিত হয়ে উঠে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া সর্বোত্রই একই অবস্থা। ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের যে কোনো প্রান্তের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, নির্যাতন, যৌন হয়রানি, দুর্নীতি, প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটলেই মানুষ ধরেই নেয় ছাত্রলীগের কাজ। এক সময় যে ছাত্রলীগকে শিক্ষার্থীরা সমীহ করে চলতেন; সেই ছাত্রলীগের নেতাদের দেখলে শিক্ষার্থীরা মুখ ফিরিয়ে নেন।

শিক্ষার্থীদের স্বার্থরক্ষা, অধিকার আদায়, শিক্ষার সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরিতে ছাত্র সংগঠনের কাজ করার কথা থাকলেও ঠিক যেন উল্টো পথে হাটছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ। খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, নির্যাতন, যৌন হয়রানি, দুর্নীতি, প্রশ্নফাঁস, ভর্তি ও সিট বাণিজ্য, শিক্ষককে হেনস্থা হেন কোনো অপরাধ নেই যা ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ করছে না। অথচ ক’দিন আগেই ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্বে আসা সাদ্দাম-ইনান জানিয়েছিলেন তাদের নেতৃত্বে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কাজ করবে ছাত্রসংগঠনটি। কিন্তু তা বক্তব্যেই সীমাবদ্ধ। বরং নতুন করে সেই পুরোনো অপকর্মেই জড়িয়ে পড়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। অভিভাবক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগের উপদেশ কিংবা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সতর্কবার্তা কিছুই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আমলে নিচ্ছেন না। তারা একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েই যাচ্ছেন। তাদের রোষানল থেকে বাদ যাচ্ছে না ভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মী, সাংবাদিক ও সাধারণ শিক্ষার্থী কেউই।

জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, আমরা চাইনা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী সুনামের সংগঠনের নাম কোনো প্রকার অপকর্ম, অপসংস্কৃতি ও অপতৎপরতার সাথে যুক্ত হোক। আমরা যেখানেই কোনোরকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ পাচ্ছি সেখানে আমাদের সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করছি এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে অনুরোধ করছি যাতে ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে।

ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটির নানবিধ গর্হিত কর্মকাণ্ডে বিব্রত খোদ আওয়ামী লীগের নেতারাও। গত শনিবারই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে অপকর্ম করছে দুর্বৃত্তরা। আওয়ামী লীগের কোনো সংগঠনে দুর্বৃত্তদের থাকার অধিকার নেই। অপকর্মে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।

জানা যায়, দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন একক আধিপত্য ছাত্রলীগের। হল কিংবা ক্যাম্পাস কোথাও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ন্যূনতম সুযোগ দেয়া হয় না ভিন্ন মতাবলম্বী ছাত্রসংগঠনগুলোকে। চেষ্টা করলেই তাদের ওপর করা হচ্ছে মামলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বড় ক্যাম্পাসগুলোতে অনেকটা বিশেষ বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। যখন যাকে ইচ্ছা মারধর করছে, আটকে আদায় করা হচ্ছে টাকা, করা হচ্ছে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, কখনো কখনো তুলে দিচ্ছে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর হাতেও। আর প্রতিপক্ষ না থাকলে তখন নিজেদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে জড়িয়ে পড়ছে সংঘর্ষে। নির্যাতন আর একক আধিপত্যে শিক্ষার্থীদের কাছে আতঙ্কের নাম হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে ছাত্রলীগ।

সম্প্রতি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের (চমেক) দুটি কাণ্ড দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ইবিতে ছাত্রীকে রাতভর নির্যাতনের পর বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণের কাণ্ড গড়িয়েছে উচ্চ আদালত পর্যন্ত। আর চমেকের কাণ্ডে ভুক্তভোগী দুই শিক্ষার্থীকে আইসিইউতে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। ছাত্রনেতাদের কিছু কিছু কক্ষ টর্চার সেলে পরিণত হয়েছে। অবশ্য এসব ঘটনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর তরফে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে; বিভিন্ন অনভিপ্রেত কাণ্ডে ছাত্রলীগ থেকে এ পর্যন্ত ২৫ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও কুষ্টিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনার খবর বেরুচ্ছে কয়েকদিন পরপরই।

জানা যায়, ১৭ মাস আগেও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে মাহাদি জে আকিব নামে এক শিক্ষার্থীর মাথার খুলি থেঁতলে দেয়ার ঘটনায় আলোচিত হয়েছিল সারা দেশে। নিজের সহপাঠীর মাথার খুলি থেঁতলে দিয়ে আলোচনায় আসেন একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রলীগ নেতা অভিজিৎ দাশ। সে সময় শাস্তি হিসেবে তাকে দুবছরের জন্য বহিষ্কার করা হলেও ফিরে এসে এবার অভিজিৎ ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা আবারও জড়িয়ে পড়েন ছাত্র নির্যাতনের মতো অপকর্মে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের চার শিক্ষার্থীকে ডেকে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে ছাত্রলীগের অভিজিৎ বাহিনী। টর্চার রুমে চারজনকে সারারাত পেটানো হয় লোহার রড ও খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে। এদের মধ্যে দুজন ইতোমধ্যে মৃত্যুভয়ে ছেড়েছেন ক্যাম্পাস ও বাকি দুজনকে ভর্তি করা হয় আইসিইউতে। তবে আইসিইউতে গিয়েও আহতদের হুমকি দিয়েছেন অভিজিৎ বাহিনীর সদস্যরা। অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হওয়া দূরের কথা, দম্ভের সঙ্গে আহতদের হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‹এখন আইসিইউতে আছিস, নাম বললে মর্গে থাকবি!› একই ধাচের ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিপক্ষের ওপর হামলার পাশাপাশি ক্যাম্পাসজুড়ে এখন ছিনতাই, চাঁদাবাজিতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জড়িয়ে পড়ছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: একের পর এক শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়েই চলেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শাখা ছাত্রলীগ। গত এক বছরে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে নির্যাতন, হুমকি প্রদান, ভয়ভীতি প্রদর্শন, সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজি ও আবাসিক শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক হল থেকে বের করে দেওয়া এমনকি স্বাধীনতা দিবসের খাবার লুট করার মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। এসব ঘটনার লিখিত অভিযোগ পাওয়া সত্ত্বেও জড়িত কাউকে স্থায়ী শাস্তির আওতায় আনেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আর শাস্তি না হওয়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠছেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।

জানা যায়, গত এক বছরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অন্তত ৪২টি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। এছাড়া নির্যাতনের শিকার হয়েও প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ দেয়নি এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা হবে শতাধিক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে দেওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে ১৩টি তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। তার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে মাত্র ৬টির। তবে কোনো ঘটনায় ছাত্রলীগের কাউকে শাস্তির আওতায় আনেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। দু-একটি ঘটনার বিচার হলেও সেগুলো ছিল সাময়িক।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে এক সনাতন ধর্মাবলম্বী ছাত্রকে হলরুমে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করেছে একই হলের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. সোলাইমান ও তাদের অনুসারীরা। শুরুতে তাকে শিবির ট্যাগ দিয়ে পেটানো হলেও পরে যখন জানা যায় সে সনাতন ধর্মাবলম্বী তখন সংখ্যালঘুতার সুযোগ নিয়ে তাকে আরেক দফা পেটানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী কৃষ্ণ রায় জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর ও হল প্রভোস্টের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এর আগেও চলতি বছর ১৯ জানুয়ারি শাহ মাখদুম হলের সামিউল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থীকে মারধর ও টাকা ছিনিয়ে নেয়া, ২২ জানুয়ারি শহীদ শামসুজ্জোহা হলের জাকির হোসেন নামে এক শিক্ষার্থীকে মারধর করে তার নিজের কক্ষ থেকে বের করে দেয়াসহ একই রকমের নানা অপরাধ ও নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটিয়ে আসছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। দেশজুড়ে ছাত্রলীগের শিক্ষার্থী নির্যাতনের প্রতিবাদে গত বৃহস্পতিবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্বোহা চত্বরে প্রতীকী অনশনে বসেন বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন খান।

ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা : গত ১২ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে শেখ হাসিনা হলের একটি কক্ষে আটকে রেখে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ভিডিও ধারণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তার সহযোগীরা। ভুক্তভোগী ছাত্রী জানান, গণরুমে নিয়ে তাকে চড়, লাথি, ঘুষি মেরে বিবস্ত্র করা হয়। রাত ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত তার ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। ঘটনার পর ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের জন্য ভিসির সাথে দেখা করে দাবি জানান ওই ছাত্রলীগ নেত্রী।

ভুক্তভোগী ওই ছাত্র অভিযোগ করে বলেন, আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দিচ্ছিল আর এর ফাঁকে ফাঁকে চালাচ্ছিল শারীরিক নির্যাতন। কিল, ঘুষি, থাপ্পড় কোনোটাই বাদ রাখেনি। কাপড় আটকানোর আলপিন দিয়ে পায়ের ঊরুতে ফুটাচ্ছিল। নির্যাতনের সময় আরেক ছাত্রী মুঠোফোন দিয়ে ভিডিওধারণ করেন। একপর্যায়ে বিবস্ত্র করে ভিডিওধারণ করা হয়। কাঁদতে কাঁদতে তিনি পা ধরে ক্ষমা চাইলেও তারা কোনো কথা শোনেননি। বরং বিবস্ত্র করে ভিডিওধারণের সময় হুমকি দেওয়া হয়। বলা হয় এই কথা কাউকে জানালে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হবে। আপুরা মারার সময় বলছিল ‘মুখে মারিস না, গায়ে মার যেন কাউকে দেখাতে না পারে।’
রাতের কথা কাউকে জানালে ওই ছাত্রীরা তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেন বলে অভিযোগ করেন তিনি বলেন, এ কথা কাউকে বললে হল থেকে বের করে দেবে বলে শাসায়।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ: ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বিচারে ছাত্রলীগের ২০ নেতাকর্মীর মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনের যাবজ্জীবন হয়। বুয়েটে মর্মান্তিক ঘটনার পরও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যে কমেনি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজকাণ্ড তার প্রমাণ। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) শাখা ছাত্রলীগের ‘নির্যাতনের’ শিকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির দুই ছাত্রকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়। ওই দুই ছাত্র হলেন জাহিদ হোসেন ওরফে ওয়াকিল ও সাকিব হোসেন। ছাত্রশিবির সন্দেহে চমেকের প্রধান ছাত্রাবাসে তাদের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নির্যাতন করেন বলে অভিযোগ করা হয়। একই সময় এস এ রায়হান ও মোবাশ্বির হোসেন নামের অপর দুই ছাত্রকে নির্যাতন করে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তারা সবাই মেডিকেলের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।

চমেক সূত্রে জানা যায়, ৮ ফেব্রুয়ারি বুধবার রাতে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী ওই চার ছাত্রকে ছাত্রাবাসের নিজ নিজ কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে যান। পরে তাদের অন্য একটি কক্ষে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনে তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম হয়। ৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার দিকে তাদের বাড়িতে চলে যেতে বলা হয়। রায়হান ও মোবাশ্বির বাড়িতে ফিরে যান। জাহিদ ও সাকিব চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে ঘটনা জানাজানি হয়।
অভিযোগের বিষয়ে চমেক ছাত্রলীগের নেতা অভিজিৎ দাশ সাংবাদিকদের বলেন, ‘তারা (চার ছাত্র) শিবির করেন। গোপনে এই কাজগুলো তারা করে যাচ্ছিলেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। মারা হয়নি।’ যদি মারাই না হবে, তাহলে আইসিইউতে ভর্তি হতে হলো কেন? এ বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী পক্ষ ক্যাম্পাস একক নিয়ন্ত্রণে নেয়। ২০২০ সাল থেকে মহিবুল হাসানের অনুসারী পরিচয়ে আরেকটি ধারার সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে ক্যাম্পাস ও ছাত্রাবাসে সংঘর্ষের শুরু হয়। ২০২০ সালেই সাতবার সংঘর্ষে জড়ায় দুই পক্ষ। এর মধ্যে ১২ জুলাই দুই পক্ষের মারামারিতে ১৩ জন আহত হন। ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মারামারির ঘটনায় মাহাদি জে আকিব নামে মহিবুলপন্থির এক কর্মী গুরুতর আহত হন। তাঁর মাথার খুলির হাড় ভেঙে গিয়েছিল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে চমেক ক্যাম্পাস বন্ধ ছিল ২৭ দিন। পরে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। এই ঘটনার আগেও ২০২১ সালের শুরুর দিকে দুই দফা সংঘর্ষে জড়িয়ে ছিল পক্ষ দুটি। চলতি বছরের গত ১ ফেব্রুয়ারি দুই পক্ষের হাতাহাতি ও ভাঙচুরের পর নগরের নাছিরাবাদে অবস্থিত চমেক প্রথম বর্ষের দুটি ছাত্রাবাস বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সময়মতো খাবার পরিবেশন না করায় এক দোকানদারকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এক নেতার বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা ইছহাক আলম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা বিষয়ক উপ সম্পাদক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে হলে টর্চার সেলে শিক্ষার্থী নির্যাতন প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর হামলার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়েছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রায়ই ঘটছে বহিরাগতদের মারধর করে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, হেনস্তা এমনকি শ্লীলতাহানির ঘটনা। তাদের হাত থেকে বাদ যাচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরাও, নারী হলেও অপদস্ত করা হচ্ছে নির্বিচারে। অন্ধকার হতে না হতেই সংঘবদ্ধ কয়েকটি চক্র কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ফুলার রোড ও কার্জন হল প্রাঙ্গণে নেমে পড়ছে শিকারে; বিশেষ করে প্রেমিক-যুগল বা দম্পতিদের লক্ষ্য করে ‘বহিরাগত’ তকমা দিয়ে মারধর করে টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোন ও দামি অলংকার ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ মিলছে অহরহ। এছাড়া রাতের বেলা ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে গাড়ি চলাচলে গতিরোধ করেও চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটে।

গত এক মাসেই এধরনের ১২-১৫টি ঘটনা ঘটেছে। আর এগুলোতে জড়িতদের অধিকাংশই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী বলে অভিযোগ। ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ, থানায় মামলা বা সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ ছাড়াও এধরনের ঘটনা অনেক; যেগুলো ভুক্তভোগীরা সামাজিক হেনস্তা কিংবা ভয়ে চেপে যান।

গত বৃহস্পতিবার রাতে অমর একুশে বইমেলায় পুলিশ পরিচয়ে চার ব্যক্তির কাছ থেকে চাঁদাবাজির সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রলীগ নেতাকে হাতেনাতে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাইমিনুল ইসলাম ওরফে ইমন এবং অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের রাজিব হোসাইন ওরফে রবিন। দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। ইমন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার দা সূর্যসেন হল ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এবং রবিন শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি পদে রয়েছেন। ঘটনার পর তাদেরকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
এছাড়া গত শুক্রবার বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের পঞ্চম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের হামলায় অন্তত ২০ আহত হয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের ‘সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, ছাত্রী নিপীড়ন, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির’ ঘটনার নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানিয়েছে ছাত্রদল। সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবিএম ইজাজুল কবির ও সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন, ছাত্রী নিপীড়নসহ দেহব্যবসার অভিযোগ, বিরোধী মতের শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ, সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন, ছিনতাই-চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহারসহ বিভিন্ন অপকর্মের কারণে দেশজুড়ে ছাত্রলীগ আজ আতঙ্কের প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছে।

ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ভুলুণ্ঠিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল। গতকাল রোববার সাদা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রফেসর লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, বর্তমান সরকারের সমর্থক বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ঐতিহ্য ইতোমধ্যেই ভুলুণ্ঠিত হয়েছে। আমরা আমাদের প্রাণের প্রতিষ্ঠানে ভিন্নমতের ওপর হামলার পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না। বিবৃতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শুক্রবার বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলাকে ‘ন্যক্কারজনক’ মন্তব্য করে এর প্রতিবাদ ও দোষীদের বিচারের দাবি জানানো হয়। একই সঙ্গে এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তীব্র নিন্দা জানানো হয়।

এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ, শরীয়তপুরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের উপদলীয় সংঘর্ষ এবং একপক্ষের সমর্থকদের আরেকপক্ষের মারধরের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার নেপথ্যে ছাত্রলীগের আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এবং হলে হলে সিট বাণিজ্যসহ নানা বিষয় রয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে যে বিষয়গুলো ঘটেছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক মন্তব্য করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, আমরা চাইনা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী সুনামের সংগঠনের নাম কোনপ্রকার অপকর্ম, অপসংস্কৃতি ও অপতৎপরতার সাথে যুক্ত হোক। আমরা যেখানেই কোনোরকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ পাচ্ছি সেখানে আমাদের সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করছি এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে অনুরোধ করছি যাতে ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। তিনি বলেন, তদন্ত সাপেক্ষে অপরাধ প্রমাণিত হলে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। তবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ৫০ লক্ষ নেতাকর্মীর একটি বড় সংগঠন। তাই সংগঠন পরিচালনায় অনেক ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু মিডিয়ায় অনেক সময় তা অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়। আমরা বিশ্বাস করি আমাদের সংগঠনের যে ভাবধারা ও আলোকজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে তা আমরা বজায় রাখতে পারব।

স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিরা এখনো তৎপর রয়েছে। তারা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সুনাম ক্ষুণ্ন করার জন্য আমাদের সংগঠনে অনুপ্রবেশ করছে বলেও মনে হয়। এবং এই অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আমরা সজাগ দৃষ্টি রাখছি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (9)
Aoŋɩĸ Mʌʜɱʋɗ ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৮:৩৭ এএম says : 0
পুলিশকে কঠোর হতে হবে। ফালতু রাজনীতির কারণে আজ এই অবস্থা
Total Reply(0)
তানবীর হাসান তনু ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৮:৩৪ এএম says : 0
এই ছাত্রলীগের জন্য তো দেশবাসী অতিষ্ট,, এদের নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়জন
Total Reply(0)
Gias Uddin ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৮:৩৪ এএম says : 0
ইতিহাস ঐতিহ্য সম্বলিত নাম বাংলা দেশ ছাত্র লীগ, কিন্তু ইদানীং কিছু সমস্যা জড়াচ্ছে মুষ্টিমেয় কয়েকজন শুধু নামধারী।
Total Reply(0)
Rabbul Islam Khan ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৮:৩৪ এএম says : 0
অন্যায় কারির যাহারা সাপোর্ট করে, তাদে কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত।
Total Reply(0)
Md Saidul Islam Shohan ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৮:৩৫ এএম says : 0
আচ্ছা লীগের সব নেতারা যে বলেন,বাংলাদেশের সব জনগন তাদের পাশে আছে,তাই যদি হয় তাহলে এরা কারা যারা আওয়ামীলীগ আর ছাত্রলীগ কে গাল ভরে গালি দিচ্ছে??? আচ্ছা আমার তো বুঝে কিচ্ছু আসছে না,,এই কি সেই ছাত্রলীগ যারা বলে কিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষের শুভ শক্তি?? যদি ছাত্রলীগ ভাল হয়,আর ছাত্রদল আর শিবির খারাপ হয় তাহলে বাকিদের থেকে এদের এতো জঘন্য অবস্থা কেন??
Total Reply(0)
Vagrant Rumman ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৮:৩৫ এএম says : 0
দীর্ঘমেয়াদী ক্ষমতায় থাকার ফলাফল। আওয়ামীলীগ এর সকল সংগঠন দেশ টাকে বাপ দাদার সম্পত্তি ভেবে নিয়েছে। জনগণের কাছে জবাবদিহিতা থাকলে এত বাড়তে পারতো না।
Total Reply(0)
Rafiqul Islam ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৮:৩৫ এএম says : 0
দেশে কোন ডাকাত আর সন্তাস নেই,, সব হইল ছাএলীগ
Total Reply(0)
আরিয়ান রাশিদ ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৮:৩৬ এএম says : 0
শিক্ষাঙ্গনে রাজনিতী নিশিদ্ধ হওয়া এখন সময়ের দাবি। গুটি কয়েক পাতি নেতার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারন জণগন অনেক অতঙ্কে থাকে।
Total Reply(0)
salman ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৬:১৫ এএম says : 0
Ata akta JONGI, SONTRASHI songhoton. Ader Nisiddho kore Ain er Awowtai niye asha uchit.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন