ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে এক নবাগত ছাত্রীকে র্যাগিংয়ের অভিযোগ উঠেছে। গত শনিবার ও রোববার দেশরতœ শেখ হাসিনা হলে রাত সাড়ে ১১টা থেকে রাত প্রায় তিনটা পর্যন্ত শারীরিক নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীর। ভুক্তভোগী ফুলপরি ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী। র্যাগিংয়ের সময় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেত্রীরা তার বিবস্ত্র ভিডিও ধারণ করে রাখে বলে অভিযোগ তার। পরদিন সোমবার সকালে ভয় পেয়ে হল ছেড়ে বাসায় চলে যান ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী। র্যাগিংয়ের নামে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তার বিচার ও নিরাপত্তা চেয়ে গতকাল মঙ্গলবার প্রক্টর ও ছাত্র-উপদেষ্টা দপ্তর বরাবর লিখিত দিয়েছেন ভুক্তভোগী।
লিখিত অভিযোগে ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী বলেন, গত ৮ ফেব্রæয়ারি আমার ওরিয়েন্টেশন ক্লাস শুরু হওয়ার জন্য তিনি গত ৭ ফেব্রæয়ারী দেশরতœ শেখ হাসিনা হলের ৩০৬ নম্বর রুমে তার এলাকার (পাবনা) পরিচিত এক আপুর রুমে গেস্ট হিসেবে উঠেন। যথাযথভাবে সবাইকে সম্মানপূর্বক রুমে অস্থায়ীভাবে অবস্থান করেন। এরপর ১১ ও ১২ তারিখে ২ দফায় তিনি দেশরতœ শেখ হাসিনা হলের আবাসিক ছাত্রী ও পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরার নেতৃত্বে ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী তাবাসসুম নাম না জানা আরো অন্তত ৭-৮ জন দ্বারা র্যাগিংয়ের নামে চরমভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের স্বীকার হন। অভিযোগে তিনি আরো বলেন, সে সময় তাকে বিবস্ত্র করে গোপন ভিডিও ধারণ করে রাখে তারা। এমনকি তারা তাকে জীবননাশের হুমকিও প্রদান করে।
অভিযোগপত্রে ভয়ঙ্কর অভিযোগের বর্ণনা দিতে গিয়ে ওই ভুক্তভোগী ছাত্রী বলেন, ‘গত ৯ ফেব্রæয়ারি আমাকে ডিপার্টমেন্টের ২০২০-২১ এর তাবাসসুম নামের ওই সিনিয়র আপুর রুমে দেখা করতে বলা হয়। কিন্তু আমি অসুস্থ থাকায় যথাসময়ে আপুর রুমে যেতে পারিনি। এরপর থেকেই তারা আমার উপর চড়াও হতে থাকে এবং পরবর্তীতে তাদের রুমে গেলে আমার সাথে খারাপ আচরণ করেন, ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে থাকেন এবং হল থেকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন। তারা অভিযোগ করতে থাকেন তাদের না জানিয়ে কেন হলে উঠেছি। অথচ হলে আমি আবাসিক শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, গেস্ট হিসেবে সাময়িক সময়ের জন্য ওই রুমে উঠেছিলাম। কিন্তু প্রথম দফায় শনিবার ১১ই ফেব্রæয়ারি রাতে আমার উপরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয় এবং হল থেকে বের করে দেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়। পরে গত রোববার ১২ই ফেব্রæয়ারি বিকেল আনুমানিক ৪টার সময় হল প্রভোস্ট এবং সহকারী প্রক্টোরের হস্তক্ষেপে উক্ত বিষয়টি মিমাংসিত হয়। কিন্তু রাত না পেরুতেই রোববার দিবাগত রাত আনুমানিক ১১টার সময় অন্তরা আপুসহ ৭-৮জন আমাকে একটি গণরুমে নিয়ে যান এবং রুমে নিয়ে গিয়ে কথায় কথায় ওনারা ৭-৮ জন মিলে এলোপাতাড়িভাবে চড় থাপ্পড় মারতে থাকেন। আপু, আপনারা আমাকে কেন মারছেন বলতে গেলে উনারা আমার মুখ চেপে ধরেন এবং সজোরে চোয়ালে থাপ্পড় মারতে থাকেন। তারা বলতে থাকেন- চিনিস আমাদের, আমরা কত খারাপ? আমরা তোর কি করতে পারি জানিস তুই? কোন আইডিয়া আছে আমাদের সম্পর্কে তোর? আর আমি কান্না করে আপু আমাকে আর মাইরেন না বলে ওনাদের পা ধরে মাফ চাইতে গেলে তারা পা দিয়ে লাথি মারেন। আর অকথ্য ভাষায় আমাকে ও আমার মা বাবাকে নিয়ে গালিগালাজ করতে থাকেন, যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। এরপরে আমার বুকের উপর হাত দিয়ে জোর করে থাবা মারেন এবং গামছা দিয়ে আমার গলায় ফাঁস দিয়ে ধরে রাখে আর ছাড়ে। আর বলতে থাকে যা বলবো একটা কথা ও যেন বাইরে না যায়। একপর্যায়ে তারা একটা ময়লা গøাস আমাকে দিয়ে চেটে পরিষ্কার করায়ে নেয় এবং সেটার ভিডিও ধারণ করে। তারপর তারা বলতে থাকেন জামা খুলে, আমি জামা খুলতে না চাইলে তারা আমাকে আবার মারা শুরু করেন এবং আমার জামা খুলে জোর করে আমাকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করেন। ভিডিওগুলো তাদের কাছে সংরক্ষণ করা আছে। তারপর আমাকে বলেন, যদি বাইরের কাউকে একথা বলিস, তাহলে তোর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করে দিবো। যাতে তুই কাউকে মুখ দেখাতে নাহ পারিস এবং অন্তরা আপু বলেন, তুই যদি প্রশাসনের কাছে কোনো অভিযোগ দিস, তাহলে তোকে মেরে কুত্তা দিয়ে খাওয়াবো, যা বলেছি তা মনে থাকে যেনো! টর্চার শেষে রাত আনুমানিক রাত সাড়ে ৩টার পর আমাকে অন্য একটি গণরুমে পাঠিয়ে দেয়। আর সবাই বলেন মুখ খুললেই কিন্তু খবর খারাপ হয়ে যাবে। পরেরদিন সোমবার ১৩ ফেব্রæয়ারি খুব সকালে জীবন বাঁচাতে আমি হল থেকে পালিয়ে গ্রামের বাড়ি পাবনাতে চলে যাই। তারপর সকালে আমাকে হলে না পেয়ে অন্তরা আপুসহ ওই ৭-৮ জন সবাই আমাকে একাধিকবার ফোন দেন কিন্তু ভয়ে আমি কারো ফোনই রিসিভ করিনি। পরে আমি বাসায় এসে আমার পরিবারের সাথে আলাপ আলোচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিকট অভিযোগ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেই।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা বলেন, ওই ছাত্রীর সঙ্গে এরকম কোন কিছু ঘটেনি। ওই ছাত্রীর পরিচিত এক ভাই ফোন দিয়ে আমাকে তুলে নেয়ার হুমকি দেয়।
এদিকে ভুক্তভোগী ওই ছাত্রীর বিরুদ্ধে হল প্রভোস্ট, প্রক্টর ও ছাত্র-উপদেষ্টা বরাবর পাল্টা লিখিত অভিযোগ দিয়েছে অভিযুক্ত ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ওই ছাত্রীর সঙ্গে এরকম কোন কিছু ঘটেনি। সে সিনিয়রদের সঙ্গে বেয়াদবি করেছিল। এমনকি সে ওর এক ভাইকে দিয়ে আমাকে তুলে নেয়ারও হুমকি দিয়েছে।
ইবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত বলেন, ঘটনাটি শুনেছি। বিষয়টি খোঁজখবর নেওয়া হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে। হল প্রভোস্ট ড. শামসুল আলম বলেন, বিষয়টি জেনেছি। লিখিত অভিযোগ পেয়ে একটা তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রক্টর প্রফেসর ড. শাহাদৎ হোসেন আজাদ বলেন, উভয়ের পক্ষ থেকে অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষও দেখছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যেই এটার সমাধান করা হবে।
ভিসি ড. শেখ আবদুস সালাম বলেন, র্যাগিংয়ের বিষয়টি আমি শুনেছি। র্যাগিং তো একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনও র্যাগিং ছিলো না। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এ বিষয়গুলোকে অ্যালাউ করে না। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন