শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

লিটল ম্যাগের ভাগ্যে নেই পরিবর্তন

রাহাদ উদ্দিন | প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

মেলা যায় মেলা আসে, স্থানও হয় পরিবর্তন। কিন্তু ভাগ্য পরিবর্তন হয় না একসময়ের তুমুল জনপ্রিয় লিটল ম্যাগাজিনের। জনপ্রিয় সব লেখক, প্রকাশনী ও পত্রিকার ভীড়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে সত্তরের দশকের গণজাগরণের চালিকাশক্তি হিসেবে পরিচিত লিটল ম্যাগাজিনগুলো। বিপ্লবী ধারার এসব ম্যাগাজিনের স্থান দখল করে নিয়েছে পত্রিকাগুলো। কিন্তু এতসব বাধা বিপত্তির মাঝেও এখনো ঠিকে আছে কিছু ম্যাগাজিন। যেগুলোকে বইমেলায় বড় একটা অংশে স্থান বরাদ্দ দেয়া হয়।
দেড় দশকের বেশি সময় ধরে বাংলা একাডেমির বহেড়াতলায় স্থান পাওয়া বইমেলার অন্যতম আকর্ষণ ‘লিটল ম্যাগ চত্বর’ এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মূল অংশে। গত ৩ বছর ধরে এই চত্বরের জন্য জায়গা বরাদ্দ হয়ে আসছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চের পার্শ্ববর্তী স্থানে। ২০২১ সালে মেলার পূর্বাংশে রমনা কালীমন্দিরের পেছনে স্থান হলেও পরে আন্দোলনের মুখে আগের জায়গায় ফিরে আসে লিটল ম্যাগ চত্বর। কিন্তু এবার তা জনসাধারণের জন্য আরো সুবিধাজনক স্থানে মেলার উদ্যান অংশের নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনস্থলের সামনেই বিরাট জায়গা জুড়ে স্থান পেয়েছে। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হচ্ছে না প্রকাশক-সম্পাদকদের। যেন বিগতদিনের ধারাবাহিক খরা লেগেই আছে। গিটারের সুর আর গান-গল্পে এখানকার বিক্রেতারা কাটাচ্ছে অবসর সময়।
জানা যায়, মূলত উনিশ শতকের শুরুর দিকে আমেরিকা ও ইউরোপে লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রা শুরু হয়। বাংলায় একে সর্বপ্রথম পরিচিত করান বুদ্ধদেব বসু। ১৯৫৩ সালে ‘সাপ্তাহিক দেশ’ পত্রিকার মে সংখ্যায় তিনি তার সাহিত্যপত্র প্রবন্ধে সর্বপ্রথম লিটল ম্যাগাজিনের সাথে এদেশের সাহিত্য প্রেমীদের পরিচয় করিয়ে দেন। লিটল ম্যাগ বা লিটল ম্যাগাজিনগুলো সাধারণত গতানুগতিক ধারার বাহিরে লেখা প্রকাশ করে থাকে। আর এইসব ম্যাগাজিনে যারা লিখেন অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় তারা হয়তো একেবারেই নবীন কিংবা পাঠক বিচ্ছিন্ন লেখক। অনেকেই আদর্শিক দ্বন্দ্বের বেড়াজালে খুঁজে পান না পাঠক।
পুঁজিবাদী স্রোতের বিপরীতে গিয়ে অনেকেই সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা লালন করে এবং তা প্রকাশ করে ভাষায়, শব্দে। এসব তরুণ কিংবা বিপ্লবী ধারার লেখকরাই মূলত লিখে থাকেন লিটল ম্যাগে। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লেখকরাও অতটা পরিচিত হন না। আবার স্বাধীনভাবে লিখতে পারায় এসব লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক, প্রকাশক ও লেখকদের পিষ্ট হতে হয় দেশের রথী-মহারথীদের যাঁতাকলে। তাই এখন আর বড় কোনো প্রকাশনা সংস্থা এসবের ঝুঁকি নিয়ে এ ধারার ম্যাগাজিনগুলো প্রকাশ করে না। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় এর লেখক ও সম্পাদকরাই এইসব ম্যাগাজিনে প্রকাশক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন প্রকাশনা বা ব্যক্তি উদ্যোগে এইসব লিটল ম্যাগ বাজারে আসে। এগুলো মূলত অনেকটা অবাণিজ্যিক ও আদর্শবাদী হয়ে থাকে। আমাদের দেশে এর বিস্তার ঘটতে শুরু করে মূলত ষাটের দশক থেকে। পরবর্তীতে এই লিটল ম্যাগ তরুণ লেখকদের সাহিত্য চর্চার প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়।
পশ্চিমের আদলে আমাদের দেশে সর্বপ্রথম লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করেন প্রমথ চৌধুরী। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘সবুজপত্র’কে (১৯১৪) সর্বপ্রথম লিটল ম্যাগ হিসেবে গণ্য করা হয়। ষাটের দশকে আমাদের দেশে লিটল ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করে একপ্রকার সাহিত্য আন্দোলন গড়ে উঠে। সেসময় মানুষ তাদের চেতনা ও স্বাতন্ত্রধর্মী লেখার জন্য অনেকাংশেই নির্ভর ছিল এইসব লিটল ম্যাগাজিনের উপর। পরবর্তীতে দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্য সংখ্যা সেই জায়গা দখল করে নিলে আস্তে আস্তে কমতে থাকে লিটল ম্যাগের কদর। তবে যুগের সাথে যুদ্ধ করে আজও টিকে আছে অনেক লিটল ম্যাগ। যারা এখনো সমাজের নানা অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলে। সরকারের নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্তের সমালোচনা নির্ভয়ে করে যায়। এইসব কারণে অনেক সময় লিটল ম্যাগগুলোর উপর নেমে আসে প্রকাশনা বন্ধের খড়গও।
লিটল ম্যাগের জরাজীর্ণ অবস্থা নিয়ে গতকাল সোমবার কথা হয় ত্রিমাত্রিক ম্যাগাজিন খনন এর বিক্রেতা আব্দুর রবের সাথে। তিনি বলেন, ষাট কিংবা সত্তরের দশকে মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হতো লিটল ম্যাগে ছাপানো কবিতাগুলো। রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো অনেক বিখ্যাত লেখকরাই তখন ছিল নবীন, তরুণ। তাদের লিখনি ছিল মানুষের আশা জাগানিয়া। মানুষ এসবে খুঁজে পেতো আধ্যাত্মিক খোরাক। তাই তো তখন লিটল ম্যাগের জৌলুশ ছিল, গৌরব ছিল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাচ্ছে এসব। ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে লিটল ম্যাগের ইতিহাস ঐতিহ্য। গতানুগতিক ধারার বাইরে যারা লিখেন বা লিখতেন তাদের সামনে ধর্মের দেয়াল দাঁড় করিয়ে দেয়ার পর থেকেই মূলত লিটল ম্যাগের বেহাল দশা বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, এখানে যারা লিখেন তাদের অনেক শত্রু তৈরি হয়। একটা সময় গিয়ে মানুষও মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। তাই তো এখন এখানে নেই কোনো জৌলুশ। সারাদিন বসে থেকেও ২টা ম্যাগাজিনও বিক্রি হয় না।
লিটল ম্যাগের বাইরেও অনেককে স্টল বরাদ্দ দেয়া হয় অভিযোগ করে কাজি সাব্বির নামে এক বিক্রেতা জানান, আমাদের দেশে হাতে গোনা ১০ থেকে ১৫ টা লিটল ম্যাগ রয়েছে এবং এর বাইরে যা আছে একটাও লিটল ম্যাগাজিন না। সবগুলোই মিডি ম্যাগাজিন অথবা সাহিত্য ম্যাগাজিন। যারা বড় আকারে স্টল পাচ্ছে না তারাই কেবল ছোট আকারের এসব দোকানে নিজেদের বই বিক্রি করছে। এদিকে গতকাল সোমবার মেলার ২০তম দিনে নতুন বই এসেছে ১০০টি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন