মুনশী আবদুল মাননান : অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে ইহুদি বসতি স্থাপন বন্ধে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাবটি পাস হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা একটি বড় ঘটনা। ওই প্রস্তাবে পূর্ব জেরুজালেমে অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপন আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করে তা বন্ধে ইসরাইলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদের ১৪ সদস্য প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দেয়। যুক্তরাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থাকে। ২০১১ সালে একই রকম একটি প্রস্তাবের বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেয়। ইসরাইলের প্রধান মিত্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এবারও প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিতে পারে, এমন আশঙ্কা থাকারই কথা। তবে সেটি সে করেনি। একে বিরল ও বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলে অভিহিত করা যায়। পর্যবেক্ষকদের মতে, ওবামা প্রশাসন প্রস্তাবটি নির্বিঘ্নে পাস হোক, এটি চেয়েছে বলেই এমনটি ঘটেছে। ওবামা প্রশাসনের সঙ্গে বেশ কিছু দিন ধরে ইসরাইলের এক ধরনের শীতল সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সম্ভবত ওবামা প্রশাসন এটা দেখিয়ে দিতে চেয়েছে, ইসরাইলের বিরুদ্ধেও প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র যেতে পারে। ইসরাইলকে কিছুটা শিক্ষা দেয়ার মনোভাব কিংবা অন্য কোনো কারণ এর মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দেয়নি। তার এই বিরত থাকা প্রস্তাব পাসের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে।
প্রস্তাবটি নিয়ে একেবারে শেষ দিকে এক ধরনের নাটকীয়তা প্রত্যক্ষ করা গেছে। প্রথমে প্রস্তাবটি দিয়েছিল মিসর। সে মোতাবেক ভোটাভুটির সময়-তারিখও ঠিক হয়েছিল। হঠাৎই নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘণ্টা আগে মিসর প্রস্তাবটি ফিরিয়ে নেয় এবং ভোটাভুটি স্থগিত হয়ে যায়। মিসরের এই পদক্ষেপের আগে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মিসরের প্রেসিডেন্ট সিসির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। সম্ভবত তার অনুরোধ বা চাপে মিসর প্রস্তাব প্রতাহার করে নিতে বাধ্য হয়। ঘটনা প্রবাহের এই পর্যায়ে নিউজিল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভেনিজুয়েলা ও সেনেগালের পক্ষ থেকে একই প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। তাদের এই প্রস্তাবের ওপরই ভোটাভুটি হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরাইলের বিপক্ষে এ রকম কোনো প্রস্তাব পাস হোক চাননি। তার আগের বক্তব্য থেকেই সেটা প্রতিভাত হয়। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, প্রস্তাবে তিনি ভেটো দেবেন। তার এই অভিপ্রায় ও ঘোষণা নিষ্ফল হওয়ায় তিনি প্রস্তাব পাসের পর এক টুইট বার্তায় হুমকি দিয়েছেন এই বলে, ‘২০ জানুয়ারির পর পরিস্থিতি ভিন্ন ধাপে রূপ নেবে।’
এতদিন যা হয়নি, তেমন একটি প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে পাস হওয়ায় স্বভাবতই ফিলিস্তিনিরা অত্যন্ত খুশি ও আনন্দিত। তাদের এ খুশি ও আনন্দের কারণ, তাদের এতদিনের একটি দাবি নিরাপত্তা পরিষদে গ্রাহ্যতা পেয়েছে। এটা তাদের জন্য স্মরণ করার মতো একটি বিজয়। জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের প্রধান প্রতিনিধির বক্তব্য ফিলিস্তিনিদের অভিমতের প্রতিফলন ঘটেছে। তিনি রয়টার্সকে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, এটি আন্তর্জাতিক আইনের একটি বিজয়। সুসভ্য ভাষা ও সংকট নিরসন প্রক্রিয়ার জয়। এটি ইসরাইলি চরমপন্থার প্রত্যাখ্যান। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বার্তা দিয়েছে, দখল কায়েমের মধ্য দিয়ে শান্তি আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না। শান্তি আনতে দরকার দখল বন্ধ করা এবং ১৯৬৭ সালের সীমানা অনুযায়ী ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে ইসরাইলি রাষ্ট্রের পাশাপাশি শান্তিতে থাকতে দেয়া। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইল পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমের অংশবিশেষ দখল করে নেয়। পরবর্তীতে সেই দখল স্থায়ী করার জন্য ওই দুই এলাকায় ইহুদি বসতি স্থাপনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি জনগণসহ বিশ্বের শান্তিকামী ও অবৈধ দখলবিরোধী মানুষ লাগাতার প্রতিবাদ জানালেও ইসরাইল তার পরিকল্পনা ও লক্ষ্য থেকে সরে আসেনি। এ পর্যন্ত সে পশ্চিম তীরে ও পূর্ব জেরুজালেমে শতাধিক ইহুদি বসতি গড়ে তুলে কয়েক লাখ ইহুদিকে পুনর্বাসিত করেছে। নৈতিক ও আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে এই বসতি স্থাপন অবৈধ হলেও যুক্তরাষ্ট্রসহ ইসরাইলের মিত্রদের প্রশ্রয় ও সমর্থনের কারণে এই ঔদ্ধত্য সে প্রদর্শন করতে পেরেছে। এহেন প্রেক্ষাপটে প্রস্তাবটি পাস হওয়ার মধ্য দিয়ে ইসরাইল বড় ধরনের একটি ধাক্কা খেয়েছে। এতে ফিলিস্তিনিদের নৈতিক বিজয় হয়েছে, বিজয় হয়েছে বিশ্বের শান্তি ও স্বাধীনতাকামী মানুষের। এতে বাস্তবিক বিজয়ের একটি বার্তাও রয়েছে।
এ প্রস্তাব পাস হওয়ার ফলে ইসরাইল পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে স্থাপিত অবৈধ ইহুদি বসতি সরিয়ে নেবে, বসতি স্থাপন প্রক্রিয়া থেকে সরে আসবে, এ মুহূর্তে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। উল্টো আগামীতে দখল প্রবণতা আরও জোরদার হয়ে উঠতে পারে, এরূপ আশঙ্কাও রয়েছে। এর আভাস ইতোমধ্যেই পাওয়া গেছে। ইসরাইলের তরফে নতুন করে আরো ইহুদী বসতি গড়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইসরাইলের যে প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, তাতে তার সীমাহীন ঔদ্ধত্যেরই পরিচয় মেলে। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দফতর থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে এ প্রস্তাব পাসকে ‘লজ্জাজনক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে বলা হয়েছে, এর কোনো শর্ত ইসরাইল মানতে বাধ্য নয়। এ পর্যন্ত ইসরাইলের বিরুদ্ধে এ রকম বহু প্রস্তাব পাস হয়েছে। ইসরাইল সেগুলো মানেনি। আলোচ্য প্রস্তাবের সঙ্গে ১৯৬৭ সালের ২৪২ এবং ১৯৭৩ সালের ৩৩৮ নম্বর প্রস্তাবের তাত্ত্বিক মিল রয়েছে। ওই দুই প্রস্তাব ইসরাইল মানেনি। না মানার একটি বড় কারণ এই যে, প্রস্তাবে ইসরাইলকে নিন্দা জানানো হয়, আহ্বান জানানো হয় প্রস্তাব কার্যকর করতে কিন্তু কীভাবে কার্যকর করবে, কত দিনে করবে, না করলে তার বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ নেয়া হবে, তার কিছুই বলা হয়না। ফলে ইসরাইল প্রস্তাব থোড়াই কেয়ার করেও পার পেয়ে যায়। নেতানিয়াহুর দফতরের ঘোষণা থেকে স্পষ্ট, প্রস্তাবটি সে মানবে না। এ প্রস্তাবও হয়তো আগের প্রস্তাবগুলোর ভাগ্য বরণ করে নেবে যদি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ ব্যাপারে আরো কোনো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে।
তারপরও সন্দেহ নেই, এ প্রস্তাব পাসের পর আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ইসরাইল বিচলিত হয়ে পড়েছে। এ বিচলন ধরা পড়েছে তার প্রতিক্রিয়ার ধরন থেকে। এই প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের স্বার্থে ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসেনি। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইসরাইলের বিরাগ প্রচ-। ইসরাইল মনে করছে, ওবামা প্রশাসনই এ প্রস্তাব পাসের ক্ষেত্রে নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে। মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে নেতানিয়াহু রাখ-ঢাক না করেই বলেছেন, আমাদের কোনো সন্দেহ নেই, ওবামা প্রশাসন এটার উদ্যোগ নিয়েছে। এর পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এটার সমন্বয়ের জন্য কাজ করেছে। এবং এটা পাসের জন্য জেদ ধরেছে। শুধু তাই নয়, নেতানিয়াহু নজিরবিহীনভাবে ইসরাইলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছেন। সাধারণত, ইসরাইলে কোনো মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করাকে অস্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই দেখা হয়।
যে ১৪টি দেশ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হিসেবে প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে, ইসরাইল বড়দিনে তাদের রাষ্ট্রদূতদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠায়। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, ওই ১৪টি দেশের মধ্যে ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন, জাপান, ইউক্রেন, এঙ্গোলা, মিসর, উরুগুয়ে, স্পেন, সেনেগাল ও নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত করেছে ইসরাইল। ইতোমধ্যেই সে নিউজিল্যান্ড ও সেনেগাল থেকে তার রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বন্ধ করে দিয়েছে সাহায্য-সহযোগিতা। পরিকল্পিত কূটনৈতিক মতামত বিনিময়ও বাতিল করেছে। একই সঙ্গে জাতিসংঘের সংস্থাসমূহের সঙ্গে সহযোগিতা রিভিউ করা শুরু করেছে এবং ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বেসামরিক সহযোগিতা বন্ধ করে দিয়েছে।
ইসরাইলের এই বেপরোয়া প্রতিক্রিয়ার ফলাফল কী হতে পারে, এতে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে তার কী লাভ ক্ষতি হতে পারে, সেটা পরের বিবেচনা। এখন বরং এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কিংবা বিশ্বের প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর কাউকেই ইসরাইল তোয়াক্কা করছে না। এটা ইসরাইলের এতদিনকার স্বভাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। দুই রাষ্ট্র তত্ত্ব নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির জন্য যে প্রচেষ্টা চলছে, তার দৃশ্যগ্রাহ্য কোনো অগ্রগতি না হওয়ার প্রধান কারণ ইসরাইলের আগ্রাসী মনোভাব ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ। বলার অপেক্ষা রাখে না, দুই রাষ্ট্রতত্ত্ব কার্যকর করে স্থায়ী শান্তি ও সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হলে ইসলাইলকে অবশ্যই দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখ- ছেড়ে দিতে হবে, পূর্ব জেরুজালেমে রাজধানী করার স্বপ্ন পরিত্যাগ করতে হবে। একই সঙ্গে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হতে পারে, এমন সবকিছু ছাড়তে হবে। এর কোনোটিই করতে রাজি নয় ইসরাইল। নেতানিয়াহু এক সময় এই দুই রাষ্ট্রতত্ত্ব মেনে নিয়ে বলেছিলেন, ‘নিজস্ব পতাকা ও সরকার ব্যবস্থা নিয়ে পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে ভালো প্রতিবেশী হিসেবে একটি ক্ষুদ্র ভূমিতে দুটি স্বাধীন জাতির পাশাপাশি বসবাস সম্ভব, যারা কেউ কারো জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে না।’ এটা তার ২০০৯ সালের বক্তব্য। এ বক্তব্য তখন ব্যাপক প্রশংসা লাভ করেছিল। কিন্তু গত ৬-৭ বছরে তার এ বক্তব্যের কোনো প্রতিফলন বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেনি। এখন দুই রাষ্ট্রতত্ত্বের প্রতি কানাকড়ি শ্রদ্ধা নেতানিয়াহুর বা ইসরাইলের নেই। শান্তি আলোচনা বদ্ধ জলাশয়ে আটকে থাকার এটাই মূল কারণ।
দুই রাষ্ট্রতত্ত্ব বাস্তবায়িত হলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও নিরাপত্তার পরিবেশ গড়ে উঠতে পারে, এমনটাই আশা করেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকগণ। আর সেটা করতে হলে ইসরাইলকে দখলকৃত সকল ভূমি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অনুকূলে ছেড়ে দিতে হবে। পূর্ব জেরুজালেমের ওপর ফিলিস্তিনের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নিতে হবে এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি কোনো প্রকার হুমকি হওয়া চলবে না। এখানে বলা আবশ্যক, বিশ্বের শান্তি ও স্বাধীনতাকামী এবং নিরাপদ সহাবস্থানে বিশ্বাসী মানুষ ইসরাইলের ভূমি দখল, পূর্ব জেরুজালেম কুক্ষিগত করা এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালানো সমর্থন করে না। তারাও মনে করে, দুই রাষ্ট্রতত্ত্বের বাস্তবায়ন মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিয়ে আসতে পারে।
ওবামা প্রশাসন এই দুই রাষ্ট্রতত্ত্বের পক্ষে। এতদিন সে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক শান্তি প্রয়াস এগিয়ে নিতে চেয়েছে। কিন্তু ইসরাইলের অসহযোগিতার কারণে এ প্রয়াস সফলকাম হয়নি। নিরাপত্তা পরিষদে ইসরাইলের বিপক্ষে প্রস্তাব পাস হওয়ার পর যে ধরনের প্রতিক্রিয়া ইসরাইল প্রদর্শন করছে, তাতে ওবামা প্রশাসন বিরক্ত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি অধিকৃত এলাকায় ইহুদি বসতি স্থাপন নিয়ে ইসরাইলকে সতর্ক করে দিয়েছেন। ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম গার্ডিয়ান জানিয়েছে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিস্তিন-ইসরাইল শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে একটি রূপরেখা প্রকাশ করেছেন। তিনি দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের কথা ঘোষণা করেছেন। বলেছেন, দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান বিপজ্জনক পর্যায়ে রয়েছে। জাতিসংঘও ইহুদিদের এই বসতি স্থাপনা করে জমি দখল করার নিন্দা জানিয়েছে, যা মার্কিন মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি আরও বলেছেন, দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই ইহুদি কিংবা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। আমরা যদি সমস্যার পক্ষপাতপূর্ণ সমাধান করতে চাই তাহলে ইসরাইলকে আমরা রক্ষা করতে পারব না। আমাদের চোখের সামনেই দেশটি ধ্বংস হয়ে যাবে। ওবামা প্রশাসন মনে করে, মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে চলা বিবাদ দূর করতে হবে। ওবামা প্রশাসনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এ বিষয়ে একমত।
জন কেরির এ বক্তব্য থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, যুক্তরাষ্ট্র মূলত ইসরাইলের বৃহত্তর ও দীর্ঘ মেয়াদি স্বার্থেই শান্তি প্রক্রিয়াকে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্তের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায়। আসলে তার প্রস্তাবে ভোটদান থেকে বিরত থাকা ইসরাইলের বিরুদ্ধে বা তার স্বার্থের বিপক্ষে যাওয়া নয়। এ কথা কে না জানে, ইসরাইলকে এ যাবৎ যুক্তরাষ্ট্রই কার্যত টিকিয়ে রেখেছে। ইসরাইলকে নিরাপদ ও শক্তিশালী করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এমন কিছু নেই যা করেনি। ইরাকে আগ্রাসন থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য যুক্তরাষ্ট্রই দায়ী। এটা সে করেছে ইসরাইলেরই স্বার্থে ও কল্যাণে। এ জন্য তাকেও কম খেসারত গুনতে হয়নি। আর্থিক ক্ষতিসহ বন্ধু হারানোর ঝুঁকিও নিতে হয়েছে। সর্বশেষ সিরিয়া যুদ্ধে তার পরাজয় স্বীকার করে নিতে হয়েছে। এত কিছুর পরও ইসরাইলের এখনকার আচরণ তার কাছে অপরিণামদর্শিতার পরিচায়ক। এতে তার বিরক্ত এমনকি ক্ষুব্ধ হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
ইসরাইল এমনটি করছে কেন, এই প্রেক্ষিতে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। পর্যবেক্ষকরা লক্ষ্য করেছেন, এর পেছনে রয়েছেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। কট্টর ইহুদিবাদের সমর্থক ট্রাম্প ইসরাইলের পেছনে হাওয়া ও মদদ দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আগে যেমন বলেছেন, ২০ জানুয়ারির পর পরিস্থিতি ভিন্ন ধাপে রূপ নেবে তেমনি ইসরাইলকে শক্ত থাকতে উসকানি দিয়েছেন। ইসরাইলও মনে করছে, ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় এলে পরিস্থিতি তার পক্ষে ঘুরে দাঁড়াবে। জাতিসংঘে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ইসরাইল আশা করে, যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রশাসন এবং জাতিসংঘের নতুন মহাসচিব এসে নতুন কিছু করবে।
ট্রাম্প প্রশাসন দায়িত্ব নেয়ার পর কী করবে সেটা অবশ্যই দেখার বিষয়। যদি জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান নির্দিষ্ট করে তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের অশান্তি ও যুদ্ধ বিস্তার লাভ করতে পারে। সেই সঙ্গে ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও সঙ্কুচিত হয়ে পড়তে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে এখন মার্কিনবিরোধী একটি শক্তিশালী পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে। এমত ক্ষেত্রে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেতাই করবে এমনটি সহজ নাও হতে পারে। বলাবাহুল্য, ইসরাইলকে অবনমিত ও বাধ্য না করলে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান যেমন হবে না তেমনি মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠাও সম্ভব হবে না। বিশ্ব সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাই শান্তির পক্ষে দাঁড়াতে হবে শক্তভাবে। এটা তাদের দায়িত্ব। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন