২০১৬ সালে কথিত বন্ধুকযুদ্ধে ১৫৭ জন নিহত, ২ হাজার ৪২৯ জন খুন
স্টাফ রিপোর্টার : বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল গুম খুন কথিত বন্ধুকযুদ্ধ নিহত এবং জঙ্গি হামলার ঘটনা। ২০১৬ সালে কথিত ক্রসফায়ারে মারা গেছে ১৫৭ জন এবং জঙ্গি হামলায় মারা গেছে আরো ৬৩ জন। বিভিন্ন ঘটনায় খুন হয়েছেন ২ হাজার ৪২৯ জন। গুম খুনের পাশাপাশি বছরের আলোচিত ঘটনা ছিল গুলশানে জঙ্গি হামলা এবং কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে জঙ্গি হামলা। এছাড়া রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় জঙ্গি আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান এবং অভিযানের সময় কমপক্ষে জঙ্গিসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। সেই সাথে আলোচনায় ছিল নিখোঁজ ও গুমের ঘটনা। রাজনৈতিক দলের কর্মী, পেশাজীবী, ছাত্র, শ্রমিক কেউ বাদ নেই নিখোঁজ ও গুমের তালিকায়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর এসব ব্যক্তির আর খোঁজ মেলেনি। আবার অনেকেই স্বেচ্ছায় বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়েছে এমন তথ্যও পাওয়া গেছে। নারী নির্যাতন, আত্মহত্যা পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সহিংসতা, কথিত ক্রসফায়ারে মানুষ হত্যার ঘটনাগুলো এ বছর বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে সন্ত্রাসীদের হাতে সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে ১০৫২টি। এরপরই রয়েছে পারিবারিক কোন্দলে নিহতের ঘটনা। বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৮৪ জন নারী-পুরুষ। ‘কথিত’ ক্রসফায়ারে এ বছরে মারা গেছে ১৫৭ জন। এর মধ্যে পুলিশের ক্রসফায়ারে ৯৬ জন, র্যাবের ৫৬ জন ও অন্যান্য বাহিনীর হাতে আরো ৫ জন। পুলিশ ও জেল হেফাজতে এ বছর মৃত্যু হয়েছে ৪৪ জনের। সামাজিক সহিংসতায় এ বছর নিহত হয়েছেন ২২০ জন, আহত হয়েছে আরো ৬৫৫৩ জন। সামাজিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ২২০ জন। এ ছাড়া শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৯৭টি। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত গুম হয়েছেন ৮৮ জন। এই ৮৮ জনের মধ্যে ৮ জনের লাশ পরবর্তীতে উদ্ধার হয়েছে। ফেরত এসেছে তিনজন ও গ্রেফতার হয়েছে ২০ জন। অপর ৫৭ জনের কোনো হদিস মেলেনি। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার গবেষণায় এমন চিত্র ওঠে এসেছে।
২০১৬-এর ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় স্মরণকালের নৃশংস হামলাকারী ৫ জঙ্গিও হামলার কয়েক মাস আগে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ ছিল। পুলিশ সদর দফতর থেকে জানানো হয়েছে নিখোঁজ ৪০ যুবকের তথ্য। এ ছাড়া রহস্যজনক নিখোঁজ ব্যক্তিদের ফিরে আসার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে আবেদন জানানো হয়েছে।
জানতে আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বলেন, বিদায়ী বছরে গুলশানে জঙ্গি হামলা হলেও এদের দমন করা সম্ভব হয়েছে। দেশে জঙ্গিদের নাশকতার তৎপরতা ও পরিকল্পনা বার বার নসাৎ করে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তিনি বলেন গুমের অভিযোগ সঠিক নয়। সারা দেশে নিখোঁজ যুবকদের বিষয়ে বিশদ খোঁজখবর নেয়া হয়েছে। পরিবারের সঙ্গে কথা বলে এবং তাদের সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তাদের মধ্যে ৪০ জঙ্গি কর্মকা-ে সম্পৃক্ত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নিখোঁজ আর গুম এক নয়।
সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে মারা গেছে ৩৪ বাংলাদেশি। এ ছাড়া ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ৬৩ জন নারী। এ তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্থবায়ন সংস্থা (বিএমবিএস) নামে একটি সংস্থা। এক বছরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে তৈরি করা এ প্রতিবেদনে মোট ৭১টি ক্যাটাগরিতে খুনের পাশাপাশি নানা ধরনের মৃত্যু ও আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়াদি তুলে ধরেছে তারা। সার্বিক মানবাধিকারের চিত্র তুলে ধরে সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতির বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি বরং কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতি গত বছরের তুলনায় আরো উদ্বেগজনক। শিশু হত্যা ও নির্যাতন ছিল বছর জুড়েই। পারিবারিক কোন্দলে আহত ও নিহতের সংখ্যাও এ বছর তুলনামূলক বেশি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিচালক নূর খান বলেন, গুম একটি ভয়ঙ্কর উদ্বেগের বিষয়। নাগরিকদের নিরাপত্তা দেয়া রাষ্ট্রের বা সরকারের দায়ীত্ব। কোন নাগরিক গুম হলে তাদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের। এক্ষেত্রে সরকার একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করতে পারে। ওই কমিশন নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে গুমের রহস্য উদঘাটন করতে পারে। আর এ কাজটি সরকারকেই করতে হবে। তিনি বলেন, ভিক্টিমের পরিবার, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মীসহ সবাই ওই কমিশনে সাক্ষ্য দেবেন এবং প্রয়োজনী তদন্ত করে এসব গুমের জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করা একান্ত জরুরী।
এসব গুম-অপহরণের ক্ষেত্রে র্যাব, পুলিশ কিংবা ডিবি পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেছে ভিক্টিমদের স্বজনেরা। এই অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, র্যাবের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। র্যাব সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আসামি গ্রেফতার করে। কোনো আসামিকে গ্রেফতারের সময় র্যাব সদস্যরা নিজেদের পরিচয় দেন এবং গ্রেফতারের পর আসামিকে সংশ্লিষ্ট থানায় সোপর্দ করেন। এক্ষেত্রে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটে না। দুর্বৃত্তরা অনেক সময় র্যাব বা ডিবি পরিচয় দিয়ে অপহরণ করে থাকতে পারে। তিনি বলেন,আবার অনেকেই নিখোঁজ হয়ে জঙ্গি কর্মকান্ডে জড়িত হচ্ছে।
সংস্থটি বলছে, মানুষের পারিবারিক, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় বাড়ছে যা দেশের উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। সংস্থাটির গবেষণা সেলের পাওয়া তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, ২০১৬ সালে সারা দেশে সন্ত্রাসীর হাতে নিহত হয়েছে ১০৫২ জন। এ ছাড়া আহত হয়েছে আরো ৮৩৯ জন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে ছিল ফেব্রুয়ারিতে পঞ্চগড়ে মঠ পূজারীকে নৃশংসভাবে গলা কেটে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। মে মাসে টাঙ্গাইলে নিখিল জোয়ার্দার নামে এক দর্জি, বান্দরবানে বয়স্ক বৌদ্ধকে, জুন মাসে রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকায় আবদুল বারেক সরদারকে নিজ ঘরে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। দিনে দুপুরে চট্টগ্রামে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খাতুন মিতুকে নির্মমভাবে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। অক্টোবরে রাজধানীর বনানীতে একটি বহুতল ভবনে ইডেন কলেজের সাবেক অধ্যাপককে হাত-পা বেঁধে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। গত বছর সন্ত্রাসীর হাতে হত্যার ঘটনা ঘটে ৮২০টি। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে এ বছর শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। ১৯৭ জন শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৯৯ শিশু। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে হবিগঞ্জের সুদ্রাটিকি গ্রাম থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ ৪ শিশুর মাটিচাপা লাশ উদ্ধার, চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে মায়ের হাতে শিশুকন্যা, আগস্টে রাজধানীর বাসাবো এলাকায় আরেক মায়ের হাতে দুই শিশু সন্তানকে গলা কেটে হত্যার ঘটনা উলেøৈখযোগ্য। মা-বাবার হাতে সন্তান হত্যার বিষয়টি এ বছর আলোচিত ঘটনাগুলোর অন্যতম। এ বছর ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪০৭ জন নারী ও শিশু। এদের মধ্যে গণধর্ষণের শিকার ৭৭ জন এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জনকে। এ বছর ১৫৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত যৌতুকের জন্য প্রাণ গেছে ৬১ নারীর এবং যৌতুকের কারণে নির্যাতনে আহত হয়েছেন আরো ৯৪ জন নারী। সংস্থাটির মতে, যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতন ও হত্যার বিষয়টি বেশ উদ্বেগের। চলতি বছর পারিবারিক কলহে নিহত হয়েছেন ৩৮৪ জন ও আহত হয় ৩১৩ জন। এর মধ্যে ২৯১ জন নারী নিহত এবং আরো ২১৭ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো- ফেব্রুয়ারিতে বেয়ালমারিতে ভাইয়ের হাতে বোন খুন। পাবনায় এক মা ও তার সন্তানের বিষপানে মৃত্যু। সেপ্টেম্বরে ফরিদপুরে নতুন মডেলের মোটরসাইকেল না পেয়ে নিজের মা বাবার শরীরে আগুন দিয়ে বাবাকে হত্যা।
সংস্থাটি বলছে, প্রলম্বিত বিচার পদ্ধতি, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব এই সবকিছু মিলেই দেশের আপামর জনসাধারণের মানসিক ও মানবিক চিন্তা চেতনার অবক্ষয়ের কারণে বেড়ে গেছে সামাজিক অসন্তষ। আর এই বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটেছে জমিজমা, দুই গ্রামের খেলা নিয়ে বা আরো তুচ্ছে ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ২০১৬ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৬৪ জন। এ ছাড়া আরো আহত হয়েছেন ২৪২৪ জন। আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডার বাণিজ্য, এলাকা দখল, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতার দাপট প্রদর্শনের জন্য আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দলে আহত ১২৩৯ জন বিএনপির অন্তর্কোন্দলে আহত হয়েছেন ৯৪ জন। এসব হত্যার পাশাপাশি বিএমবিএস আরো কিছু মৃত্যুর পরিসংখ্যান ও তার কারণ তুলে ধরেছে।
সংস্থাটির দেয়া তথ্য মতে, ২০১৬ সালে আত্মহত্যা করেছে মোট ৫১৪ জন। এদের মধ্যে ১৭৮ জন পুরুষ ও ৩৩৬ জন নারী। পারিবারিক দ্বন্দ্ব, প্রেমে ব্যর্থতা ও যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। মাদকের প্রভাবে বিভিন্নভাবে আহত হয়েছে ৯২ জন ও নিহতের সংখ্যা ৪৫ জন। এসিড নিক্ষেপের শিকার ৩০ জন। পানিতে ডুবে, অসাবধানবশত, বিদুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছে ১২৫০ জন। এ বছর চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হয় ৬৫ জনের। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৪৯৬৭ জন ও নিহত ২৪০৩ জন। গণপিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে ৫০ জনের। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো ১০০ জন। চলতি বছর বিরোধী রাজনৈতিক দলের ১৩৭৯৭ জনেরও বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া সং¯’াটি বলছে, এসিড নিক্ষেপে আহত হয়েছেন ৩০ জন, বিএসএফ এর নির্যাতনে আহত ৩৩ জন, বিএসএফ এর হাতে অপহরণ ৮ জন, বোমা হামলায় ১৮ জন নিহত এবং ৩৪ জন আহত, ৪ সাংবাদিক নির্যাতনে নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরো ৩৬। এ বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২৪০৩ জন আহত ৪৯৬৭ জন। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন¯’ান থেকে ৫৭ নারী ও ৯৪ পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গৃহপরিচারিকা নির্যাতনে নিহত হয়েছেন ১১ জন। আহত হয়েছেন ১৩ জন। চলতি বছর ২০০ জন পুরুষ এবং ৩৭ জন নারী অপহরণের শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে। একইসঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে তাদের পরিচালনা করার পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
অপরদিকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ক্রমাগতভাবেই আসছে। ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ২৮৪ জন গুম হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে। দিনের পর দিন মাসের পর মাস এমনকি বছর গড়িয়ে গেলেও তাদের খোঁজ মেলেনি। প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হয়নি স্বজনদের।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ২৮৪ জন গুম হয়েছে। এদের মধ্যে ২০১৩ সালে ৫৩ জন, ২০১৪ সালে ৮৮ জন, ২০১৫ সালে ৫৫ গুম হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও নিজস্ব অনুসন্ধানের বরাত দিয়ে আসকের ডকুমেন্টেশন বিভাগ জানিয়েছে, নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র একজন, জামায়াতে ইসলামীর একজন, ছাত্র শিবিরের দুইজন, ব্যবসায়ী ছয়জন, আইনজীবী একজন, গৃহকর্মী একজন, চাকরিজীবী দুইজন, যুবলীগের তিনজন, বিআইডবিউটিসির ওয়ার্কার ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক একজন, ছাত্র ১৫ জন, কৃষক একজন, সাবেক সেনা কর্মকর্তা একজন, আওয়ামী লীগের একজন, ছাত্রলীগের একজন, শ্রমিক লীগের একজন, মসজিদের মোয়াজ্জিন একজন, শ্রমিক আটজন, মাদ্রাসা শিক্ষক ছয়জন, বিদ্যুৎ মিস্ত্রি একজন, কাঠমিস্ত্রি একজন, অটোরিকশাচালক একজন, পরিচয় জানা যায়নি ৩০ জনের।
এদিকে অপর মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৩ সালে ৫৩ জন, ২০১৪ সালে ৩৯ জন, ২০১৫ সালে ৩৮ জন ও চলতি বছরের ১১ মাসে ৪৮ জন গুম হয়েছে। চলতি বছর গুম হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে জানুয়ারিতে সাত, ফেব্রুয়ারিতে এক, মার্চে নয়, এপ্রিলে ১০, মে মাসে ১৩, জুনে ১৪, জুলাইতে চার, আগস্টে সাত, সেপ্টেম্বরে চার, অক্টোবরে সাত ও নভেম্বরে আটজন গুম হয়েছে।
গত ৬ নভেম্বর দিনাজপুর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন কোলাবাড়ি দাখিল মাদরাসার নবম শ্রেণির ছাত্র মোহাম্মদ আকতারুজ্জামান (১৫) ও দশম শ্রেণির ছাত্র মোহাম্মদ হাফিজুর রহমানের পরিবার। আকতারুজ্জামানের বাবা সারোয়ার হোসাইন ও হাফিজুরের বাবা জিল্লুর রহমান দাবি করেন তাদের সন্তানকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য পরিচয়ে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গুম করা হয়েছে। সারোয়ার হোসেন জানান, ২৮ সেপ্টেম্বর রাত ১টার সময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য পরিচয় দিয়ে তার ছেলে ও কোলাবাড়ি দাখিল মাদরাসার নবম শ্রেণির ছাত্র আক্তারুজ্জামানকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ মেলেনি। থানায় জিডি করার পরও পুলিশ আকতারুজ্জামানের কোনো সন্ধান দিতে পারেনি। একইভাবে হাফিজুরের বাবা জিল্লুর রহমান অভিযোগ করেন ৪ অক্টোবর তার ছেলেকে অপরিচিত কিছু ব্যক্তি তুলে নিয়ে যায়। সে কোলাবাড়ি দাখিল মাদরাসার দশম শ্রেণির ছাত্র। এক মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও তাদের কোনো সন্ধান মেলেনি।
গত ১৪ অক্টোবর রাত আনুমানিক ৩টা ১০ মিনিটের দিকে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় থেকে সাদা পোশাকে একদল যুবক ডাক্তার ইকবাল মাহমুদকে তুলে নেয়। সিসিটিভি ফুটেজে সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি গাড়ি দেখা যায়। ঘটনার ২ মাস পেরিয়ে গেলেও ডাক্তার ইকবাল মাহমুদের কোনো খোঁজ মেলেনি বলে দাবি করেন তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা নূরুল আলম। বরাবরই তার দাবি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা ছেলেকে আটক করেছে। কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে বরাবরই বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে।
গত ১৪ এপ্রিল শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার গারো পাহাড়ের গজনী গ্রাম থেকে প্রভাত মারাক, বিভাস সাংমা ও ওরাজেস মারাককে ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এখন পর্যন্ত এই তিন ছাত্রের কোনো হদিস মেলেনি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘পুলিশ সবসময় নিজেদের পরিচয় ব্যবহার করে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে আসামি গ্রেফতার করে। গুম-অপহরণ জাতীয় অভিযোগের সঙ্গে কোনোভাবেই পুলিশ বা গোয়েন্দা পুলিশ সম্পৃক্ত নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সন্ত্রাসীরা অপকর্মের কৌশল হিসেবে ডিবি বা পুলিশের পরিচয় ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে।
এদিকে স্বেচ্ছায় বা রহস্যজনক নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে ১ জুলাই গুলশান হামলার পর। গুলশানে হামলাকারী যুবকরা রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ ছিল। একইভাবে নিখোঁজ ছিল শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার সময় পুলিশের গুলিতে নিহত তরুণও। রাজধানীর কল্যাণপুর, রূপনগর, আজিমপুর, নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়া ও গাজীপুরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযানে নিহত জঙ্গিরাও নিখোঁজ ছিল। ‘নিখোঁজ’ থেকেই তারা বড় ধরনের হামলা ও নাশকতার চেষ্টা করে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, এ বছর দেখা গেছে দেশের নব্য জেএমবির সদস্যরা কথিত হিজরতের নামে গৃহত্যাগ করে ও দেশান্তরি হয়। এসব নিখোঁজ ব্যক্তি জঙ্গি কর্মকা-ে জড়িত বলেও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তাদের অনেকেই এখনও নিখোঁজ আছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন