শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

দুধের নামে বিষ বিক্রি

| প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু নোমান : দুধ আবার বানায় কীভাবে? সব সম্ভবের এই বাংলাদেশে দুধ তৈরির কর্মটি গাভী না পুষেও সম্ভব! তাহলে টিভিতে যে খাঁটি দুধের বিজ্ঞাপন দেখি? ওইসব বিজ্ঞাপনের সুন্দর মুখগুলোর সুন্দর হাসির আড়ালে কি তবে শুধুই ধোঁকাবাজি? প্রকৃতপক্ষে আমরা ভেজাল দুধ-ই কিনে খাচ্ছি। এতে প্রমাণ হলো- বাংলাদেশের প্রচলিত খাদ্য-সংস্কৃতি আমাদের মেধা ও স্বাস্থ্য রক্ষার পথে পর্বতপ্রমাণ বাধা। এতদিন জানতাম দুধে পানি মেশানো হয়। কিন্তু এবার জানা গেল, দুধ থেকে যন্ত্র দিয়ে ছানা বের করে নেওয়ার পর, পড়ে থাকা পানিতে মেশানো হচ্ছে কস্টিক সোডা, ইথাইল অ্যালকোহল, হাইড্রোজেন ও পারঅক্সাইডসহ সামান্য গুঁড়ো দুধ। এর সাথে থাকে দুধের গন্ধযুক্ত রাসায়নিক এবং আরও কিছু পদার্থ, যা পান করছে শিশু, বয়স্ক থেকে শুরু করে রোগীরাও। চিকিৎসকদের মতে, শিশু তো বটেই, এই দুধ মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে বয়স্কদের ওপরও।
ফলফলাদি ও মাছে ফরমালিন মেশানোর খবর তো পুরনো, কার্বাইড দিয়ে কলা পাকানোর ঘটনাও নতুন কিছু নয়। ফার্মের মুরগির ডিমকে বিভিন্ন কেমিক্যাল দিয়ে সাদা হাঁসের ডিম বানানোর গল্পও শুনেছি। অর্থাৎ খাদ্যদূষণ, পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণের অভিশাপে জর্জরিত এ দেশের মানুষের জীবন। চালে ইউরিয়া, সবজিতে কীটনাশক, মরিচে ইটের গুঁড়া, হলুদে সিসার গুঁড়া। এভাবে মানুষের জীবন নীরবে ধ্বংস করা হচ্ছে। কে দেবে জনগণের স্বাস্থ্যরক্ষার নিশ্চয়তা? তাহলে খাব কি আমরা? বাঁচব কীভাবে আমরা? যা-ই খাই, তা-ই যদি হয় বিষাক্ত। আমাদের বাতাস বিষাক্ত, পানিতে আর্সেনিক, মাছে ফরমালিন, ফলমূল-সবজিতে ডিডিটি।
আমাদের দেশের নামিদামি কিছু দুধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নাকি এই ভেজাল দুধের ক্রেতা। তারা তো পয়সা দিয়ে এমন ভেজাল দুধ ফেলে দেয়ার জন্য কেনেন না। অবশেষে নানা হাত ঘুরে আমাদের মতো নিরীহ ভোক্তাদের গাঁটের টাকা খরচ করে কেনা সেই ভেজাল দুধ মা পরম মমতায় তুলে দেন ছেলে-মেয়েদের মুখে। সকলেরই কামনা থাকে আমার শিশু যেন থাকে দুধে-ভাতে। অসুস্থ মানুষের দুর্বলতা কাটাতে খাওয়ানো হয় সেই দুধ। বাড়িতে মেহমান এলে বা কোনো অনুষ্ঠানে সেই দুধে তৈরি মিষ্টান্ন দেয়া হয় আপ্যায়নে। দুঃখ এখানেই যে, আমার দেশের উর্বর মস্তিষ্কগুলো থেকে কি ভালো কিছু বের হতে পারে না? তারা কি তাদের মস্তিষ্কের কিছু অংশও ভালো কাজে ব্যয় করতে পারে না?
পৃথিবীর সব খাদ্যের সেরা খাদ্য দুধ। সর্বোচ্চ পুষ্টিমানের জন্যই দুধের শ্রেষ্ঠত্ব। দুধের অপরিহার্য উপাদান ল্যাকটোজ, যা দৈহিক গঠন, বিকাশ ও মেধা বৃদ্ধিতে সহায়ক। বাংলাদেশের জনগণের একটি বৃহৎ অংশ তরল দুধের ওপর নির্ভরশীল। এতে আছে অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড, বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, খনিজ পদার্থ যেমনÑ ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রণ, কোবাল্ট, কপার, জিংক, আয়োডিন ও সেলিনিয়াম। গরুর দুধ সব পুষ্টির আধার ও শক্তির উৎস। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ক্যান্সার ও হৃদরোগ প্রতিরোধে দুধের শক্তিশালী ভূমিকা প্রমাণিত হয়েছে। দুধ কেবল একটি পানীয় নয়, এটি সুষম খাদ্য। কেননা এতে আমিষ, চর্বি, শর্করা ও নানা ধরনের ভিটামিন, খনিজ পর্যাপ্ত পরিমাণে মেলে। একটিমাত্র পানীয়ে এত ধরনের পুষ্টি-উপাদান বোধ হয় আর পাওয়া যাবে না। অথচ অতি প্রয়োজনীয় ও শিশুদের পছন্দের এই দুধে ভেজালের বেড়াজালে আমরা এমনভাবে আটকে গেছি যে, এখন আসল দুধ চেনাই দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে এই অপকর্মটি করে আসছে বগুড়ার সোনাতলা উপজেলায় কিছু দুগ্ধ ব্যবসায়ী। সম্প্রতি জেলা গোয়েন্দা পুলিশ সেখানে অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। জব্দ করেছে নকল দুধ ও দুধ তৈরির বিভিন্ন রাসায়নিক উপকরণ। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে গত ২৫ ডিসেম্বর উপজেলার শিহিপুর মধ্যপাড়া গ্রামের আবদুল মান্নান নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে অভিযান চালিয়ে নকল দুধ তৈরির কারখানার সন্ধান পায় গোয়েন্দা পুলিশ। সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ নকল দুধ এবং এই দুধ তৈরিতে ব্যবহৃত সয়াবিন তেল, কেমিক্যাল মিশ্রিত হোয়াইট পাউডার, মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডসহ নানা রাসায়নিক উপকরণ জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় কারখানার তিন কারিগরকে।
বগুড়ার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান তার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানান, মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের সঙ্গে পানি মিশিয়ে তৈরি করা হতো তরল দুধ। নকল এই দুধ গরুর খাঁটি দুধ বলে বিক্রি করা হতো খুচরা ও পাইকারি বাজারে। তরল দুধ বাজারজাতকারী বিভিন্ন কোম্পানিতেও সরবরাহ করা হতো এই নকল দুধ। দীর্ঘদিন ধরে কারখানাটিতে ভেজাল দুধ তৈরি করা হচ্ছিল বলে পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে গ্রেপ্তার হওয়া তিন কারিগর। তারা বলেছে, সেখানে বছরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ থেকে চার লাখ লিটার দুধ তৈরি করত তারা। দুধে ননি আনতে মেশানো হতো সয়াবিন তেল। আর বেশি দিন সংরক্ষণ করতে মেশানো হতো হাইড্রোজেন, পারঅক্সাইড ও ফরমালিন। ঘনত্ব বাড়াতে মেশানো হতো অ্যারারুট।
সব রকম খাদ্যপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের কথা বাদই দিলাম। অতি প্রয়োজনীয় ও শিশুদের পছন্দের দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করা হয় না যথাযথভাবে। কেউ এর মান নিয়ন্ত্রণে ভরসা পায় না। ইতোপূর্বে বিএসটিআইর সার্টিফিকেট নিয়ে খাদ্যসামগ্রী বিদেশে রফতানির পর নানা অভিযোগ এসেছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঝে-মধ্যে একটু-আধটু সক্রিয়, সংবাদ সম্মেলন, ক্যামেরা ট্রয়াল, ক্যামিক্যাল জব্দ, শুধু আর্থিক জরিমানা করেই ক্ষ্যান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ভেজাল বা দূষিত খাবারে প্রতিবছর ৫ বছরেরও কম বয়েসী প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার শিশুর মৃত্যু হচ্ছে।
পাবনা জেলার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া ও সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুর উপজেলা নিয়ে গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান দুধ উৎপাদনকারী এলাকা। দিনে ৬ লাখ লিটারের উপরে দুধ উৎপাদন হয় এখানে। এ এলাকা থেকে মিল্ক ভিটা, আড়ং, প্রাণ, ফার্ম ফ্রেশ, আফতাবসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দুধ সংগ্রহ করে থাকে। অবশ্য কয়েকটি বেসরকারি দুধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করলে তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের সংগৃহীত দুধ শতভাগ ভেজালমুক্ত বলে দাবি করেন।
এসব এলাকায় অনুসন্ধানে অর্ধশতাধিক ঘোষের কথা জানা যায়, যারা ভেজাল দুধ তৈরি ও কারবারের সঙ্গে জড়িত, তাদের বেশির ভাগই এখন নতুন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে আগের চেয়েও বেশি হারে ভেজাল দুধ তৈরি হচ্ছে। পাল্টানো হয়েছে পদ্ধতিও। আগে তারা নিজেদের বাড়িতে এ কারবার চালালেও অনেকে এখন অন্যের বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। গোপন ব্যবসার জারিজুরি ফাঁস হওয়ার ভয়েই মূলত এ পথ তাদের। অতি সম্প্রতি বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে ভেজাল দুধ তৈরির নতুন এই চিত্রসহ আরও বেশ কিছু তথ্য জানা যায়। দুধে আগের মতো শুধু ছানার পানিতে ননি ও রাসায়নিক মিশিয়ে নয়, এখন আরও নতুন পদ্ধতিতে তৈরি করা হচ্ছে এই ভেজাল দুধ।
ইতোপূর্বে বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত দুগ্ধ উৎপাদনকারী সংস্থা মিল্ক ভিটার প্যাকেট নকল করে ভেজাল দুধ বিক্রি করা হচ্ছে বলে স্বীকার করেছিলেন সমবায় মন্ত্রী। এ ছাড়াও মিল্ক ভিটার চেয়ারম্যান বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘ভেজাল দুধ তৈরির কিছু অভিযোগও তাদের কাছে এসেছে। মিল্ক ভিটার প্যাকেটের ডিজাইন প্রায় ৯০ শতাংশ নকল করে বাজারে দুধ বিক্রি হচ্ছে এ সংক্রান্ত অভিযোগ আছে। তিনি বলেন, ঘোষরা ছানা তৈরি করার পর যে পানি থাকে সে পানির সাথে শ্যাম্পু, সয়াবিন, চিনি, ভেজিটেবল ফ্যাট ব্যবহার করে ভেজাল দুধ উৎপাদন করে। মিল্ক ভিটার চেয়ারম্যান বলেন, ‘এক লিটার ভেজাল দুধ তৈরিতে হয়তো ১০-১৫ টাকা খরচ হয়, কারণ পানিটা তো তারা বিনা পয়সায় পাচ্ছে। কিন্তু এই ভেজাল দুধ তারা ৪০-৪৫ টাকায় বিক্রি করতে পারছে।’
গবেষণায় দেখা গেছে, ভেজাল দুধ পানে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে মানুষের রোগব্যাধির হার বেড়ে যায়। এতে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে মস্তিষ্কের গঠন-প্রক্রিয়া ব্যাহত করাসহ আইকিউ কমে যায়। এমনকি হাড়ের গঠন দুর্বল হয়ে হাড় ভঙ্গুর হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে কেমিক্যাল মিশ্রিত দুধ পান করলে মানবদেহে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। ফরমালিন মেশানোর ফলে হেপাটোটক্সিকিটি বা লিভার ও কিডনি রোগ, ক্ষতিকর মিল্ক পাউডারে মানবদেহে হাড়ের মধ্যকার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ফলে শরীরের পেছনের অংশে ব্যথা অনুভব, চর্মরোগ, হজমে সমস্যা, পেটের পীড়াসহ নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এ ছাড়াও ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, চোখের অসুখ ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।
বিশ্বের যে কোনো সভ্য দেশে অন্তত নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য আইনকানুন ও তার সুষ্ঠু প্রয়োগের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। সরকারের ন্যূনতম দায়িত্ব হলো নাগরিকদের খাদ্যপ্রতারকদের হাত থেকে রক্ষার ব্যবস্থা করা। এ জন্য মানুষ কর দেয়। তারপরও যদি খাদ্যের বাজার কিছু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে মানুষ ভরসা পাবে কোথায়? শুধু আইন করে বা পাহারা বসিয়ে এসব ঠেকানো যাবে না, টুপাইসে ছোট প্রহরী, আর বড় প্রহরীকে ফোর-পাইস দিলে পকেটে ঢোকানো যায়। অতএব, এসব ঠেকানোর কার্যকর উপায় হলো, আমাদের নৈতিকতার পরিবর্তনসহ ভেজাল নিয়ন্ত্রণের আইন সমন্বয় করে তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। কৃষি, খাদ্য ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নয়, মৎস্য, বাণিজ্য, শিল্প, এমনকি সংস্থাপন মন্ত্রণালয় পর্যন্ত এসব আইনের কোনো না কোনোটার ব্যাপারে দায়িত্ববান। একই কড়াইয়ে রান্নার কাজে যখন এত পাচক ব্যস্ত, তখন সে রান্না কেমন হতে পারে, আন্দাজ করা অসম্ভব নয়। বাস্তবে হচ্ছেও তা-ই। সে কারণে খুব জরুরি হলো সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের পাশাপাশি সে আইন বাস্তবায়নের দায়দায়িত্ব কেন্দ্রীভূত করা। মানুষকে অন্তত এটুকু নিশ্চয়তা দিতে হবে যে বাজারের খাদ্য নিরাপদ।
abunoman72@ymail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন