শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

শিক্ষকতা একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা

প্রকাশের সময় : ২০ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু নোমান : বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজকে যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার অঙ্গীকার নিয়ে ২০০৩ সাল থেকে প্রতিবছর ১৯ জানুয়ারি পালিত হচ্ছে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’। একজন সফল মানুষের পেছনে শিক্ষকের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। শিক্ষক শুধু সফল নয়, একজন ভালো মানুষ হতে শেখান। শিক্ষকদের ভূমিকার স্বীকৃতিস্মারক হিসেবে দিবসটি গুরুত্বপূর্ণ। মানবিক বিপর্যয় বা বৈশ্বিক, অর্থনৈতিক সংকটে আক্রান্ত হয়েও সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিনির্মাণে শিক্ষকরা অবিরাম ভূমিকা রেখে চলেছেন। শিক্ষক হচ্ছেন সভ্যতার ধারক-বাহক। শিক্ষক শুধু শিক্ষাদানই করেন না, তিনি মানুষ গড়ার কারিগরও।
মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের সর্বপ্রথম বাণী ‘পড়! তোমার রবের নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’। শিক্ষার গুরুত্ব যে কত অপরিসীম তা মহান আল্লাহ ঐশী গ্রন্থের মাধ্যমে মানব জাতিকে অবহিত করেছেন বহুকাল পূর্বে। প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন- ‘আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে শিক্ষক হিসেবে’। এখানে শিক্ষা ও শিক্ষক শব্দদ্বয় একটি অপরটির সঙ্গে ওতোপ্রতভাবে জড়িত। শিক্ষাগ্রহণ করতে হলে শিক্ষক বা ওস্তাদের প্রয়োজন। গারে হেরা নামক বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ছাত্র মহামানব হযরত মুহাম্মাদ (সা.), আর তাঁর শিক্ষক ছিলেন সৃষ্টি জগৎসমূহের স্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়ালা। আর রাসূল (সা.) হচ্ছেন মানব জাতির সর্বোত্তম শিক্ষক। শিক্ষাই আলো, শিক্ষা ছাড়া সকল পথ বা মত অন্ধকার। নৈতিক শিক্ষাই জাতির একমাত্র পাথেয়। জ্ঞানতাপস ভাষা বিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন-‘যার মধ্যে ইসলামের জ্ঞান নেই সে যত বড় শিক্ষিতই হউক না কেন; সেতো মূর্খ পÐিত’। নৈতিক মূল্যেবোধসম্পন্ন শিক্ষক ও শিক্ষাই পারে একজন মানুষকে সঠিক ও সুন্দর পথ দেখাতে। এজন্যই প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করতে হলে প্রকৃত খোদাভীরু, আদর্শ ও নৈতিকতাধারী শিক্ষকের বিকল্প নেই।
সাম্প্রতিককালে শিক্ষকদের বাস্তবিক অবস্থানের যে পরিবর্তন হয়েছে তা অকল্পনীয়, অভাবনীয়। এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকদের শতভাগ বেতন স্কেল পূর্বেই দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি ২৮ হাজার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় ৫ লক্ষ শিক্ষক জাতীয় পে-স্কেলের অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। তারপরেও বলতে হয়, সময়, সরকারি চাকরির তুলনায় যা এখনো আশাব্যঞ্জক হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রয়েছে অসম বৈষম্য। এক সময় শিক্ষকদের অবস্থা এমন ছিল না। ছিল চরম অর্থ কষ্ট। তাই বলে শিক্ষক কখনো অর্থলোভী হতেন না, খালি পায়ে দীর্ঘ পথ হেঁটে স্কুলে আসতেন। তবে আজ সেই ব্রিটিশ রাজের লাটসাহেবের ৩ পা বিশিষ্ট কুকুরের ৭৫ টাকা মাসিক ভাতা আর পাঠশালার পÐিত মশাইয়ের মাসিক বেতন ২৫ টাকার গড়মিলের তুলনা করার সুযোগ আর নেই। নতুন স্কেলে এমপিওভুক্ত মাদ্রাসা ও কলেজের একজন সিনিয়র সহকারী শিক্ষক ও প্রভাষকের বেতন ২২ হাজার টাকা, যা পূর্বে ছিল ১১ হাজার। সহকারী অধ্যাপক ৩৫,৫০০ টাকা, যা পূর্বে ছিল ১৮,৫০০ টাকা। হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষকের ১৬ হাজার টাকা, যা পূর্বে ছিল ৮ হাজার। অধ্যক্ষের বেতন প্রায় ৫০ হাজার টাকা। এত দিন তারা পাচ্ছিলেন ২৫,৭৫০ টাকা, ইত্যাদি
এত সুবিধার পরও একজন শিক্ষকের যোগ্যতার অভাবে শিক্ষাদানের কার্যটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। বলা হয় : ‘গায়ের জোরে আর যাই হওয়া যাক না কেন, গুরু হওয়া যায় না’। তাই শিক্ষাকে সার্থক করার জন্য প্রয়োজন যথাযোগ্য ও আদর্শবান সুশিক্ষক। শিক্ষকদের ভুলে গেলে চলবে না, তারা জনগণের টাকায় গড়া স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। এখন তারা কর্মজীবী হিসেবে জনগণের টাকায় মাসিক বেতন-ভাতা নিচ্ছেন। তাই এখন শিক্ষকদের নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করতে হবে।
আজ শিক্ষকতাকে চ্যালেঞ্জিং পেশা ও জবাবদিহিতার মানদÐে আনতে হবে। প্রবীণ দক্ষ শিক্ষকরা বিদায় নিচ্ছেন। এসব শূন্যস্থান পূরণ সবরকম অনৈতিকতা পরিহার করে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। শিক্ষকতায় মেধাবীদের না আসা এবং এলেও বেশি দিন না থাকার কারণ বিশ্লেষণ করতে হবে। তাই আজ বেশি প্রয়োজন শিক্ষার সকল স্তরে উচ্চতম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের আগমন। শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাসহ শিক্ষার উন্নয়নে আধুনিক ধ্যান-ধারণার প্রয়োগ সময়ের দাবি। এখন অতি জরুরি শিক্ষকদের মৌলিক ও অব্যাহত প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি, চাকরির নিরাপত্তা, পেশাগত স্বাধীনতা, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন, শিক্ষা সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, কার্যকর শিক্ষাদান ও শিখনের পরিবেশ এবং সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা।
কোন জাতির মান নির্ভর করে সমাজের প্রতিটি নাগরিকের মানের উপর। আর নাগরিকের মান বহুলাংশে নির্ভর করে শিক্ষার মানের উপর, আর শিক্ষার মান সম্পূর্ণই নির্ভর করে শিক্ষকের যোগ্যতা ও গুণাবলীর উপর। আদর্শ শিক্ষকই জাতিকে উপহার দিতে পারেন- সৎ, যোগ্য, আদর্শ ও চরিত্রবান নাগরিক। মানব সন্তানকে মনুষ্যত্ববোধে জাগিয়ে তুলতে হয় একজন শিক্ষককে। এইজন্য সকল স্তরের শিক্ষকদের করতে হয় অক্লান্ত পরিশ্রম। নরম কোমল হাতে চক-খড়ির মাধ্যমে শ্লেটে বর্ণ লিখতে শিখানো থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান দান করতে শিক্ষকদের অনেক বেশি কষ্ট করতে হয়। যে কাজটি মোটেই সহজ নয়। শিক্ষকের লব্ধজ্ঞান সুন্দরভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মাথায় ঢুকিয়ে দেয়ার নামই শিক্ষকতা। এজন্য শিক্ষক যতই জানুন না কেন, যদি তিনি ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতে না পারেন, তবে তার জানাটা এখানে অনর্থক ও মূল্যহীন হয়ে যায়। একটি উন্নত দেশ ও জাতি গঠনে শিক্ষার ভূমিকা, গুরুত্ব এবং তার প্রমাণ লিখে বা বলে শেষ করা যাবে না। যে জাতি বা দেশের শিক্ষার অবকাঠামো ও শিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশ যত উন্নত, দেশ ও জাতি হিসেবে সে জাতিই উন্নত ও স্বয়ংসম্পন্ন।
শিক্ষক ও মা-বাবার অবদান অস্বীকার করে, এমন একজনকেও পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। মা-বাবা যেমন সন্তানদের ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা দিয়ে বড় করেন, ঠিক তেমনি শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার আলো দিয়ে ভবিষ্যৎ গড়ে দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে যান। স্নেহ, মমতা, ভালবাসা তো বটেই। তাদের শিক্ষার আলো যেমন শিক্ষার্থীদের সামনের পথ চলাকে সুদৃঢ় করে, তেমনি তাদের স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা তাদের অনুপ্রাণিত করে।
সবাই ভালো ছাত্র হয় না, তবে সবাই ভালো মানুষ হতে পারে। শিক্ষার লক্ষ্য হলো ভালো মানুষ তৈরি করা। শিক্ষক নিজে মানুষ হিসেবে কতোটা আদর্শবান ও ভালো তার ওপর নির্ভর করে শিক্ষার্থীরা ভালো মানুষ হয়ে উঠবে কিনা। শিক্ষকতার পেশায় নৈতিকতা খুবই জরুরি। নীতি-নৈতিকতা বোধ জাগ্রত না হলে কারো পক্ষে এ মহান পেশায় থাকা ঠিক নয়। আসলে ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্কটা হলো আত্মিক। ছাত্রের দেহ, মন ও আত্মার বিকাশ সাধনে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আর এজন্য শিক্ষকের সাথে ছাত্রের সম্পর্ক হবে গড়ৎব ঃযধহ ধ ভধঃযবৎ, সড়ৎব ঃযধহ ধ ভৎরবহফ. শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীর পরমবন্ধু, উপযুক্ত পথ প্রদর্শক এবং বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ দার্শনিক। এক কথায় শিশুর ঋৎরবহফ, চযরষড়ংড়ঢ়যবৎ ধহফ মঁরফব। কোন কঠিন বিষয়কে সহজভাবে ছাত্রদের সামনে উপস্থাপন করা শিক্ষকের একটা বড়গুণ। শিক্ষার্থীর উপর সাধ্যের অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি না করা; শিশুকে তার ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী পাঠদান করানোসহ নিজেকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার পাশাপাশি ছাত্র/ছাত্রীদের নিজের সন্তান মনে করে সবার সাথে সমান আচরণ করতে হবে।
একটি জাতির, সভ্যতার প্রধান মাপকাঠি শিক্ষা। শিক্ষাকে তাই যুগে যুগে জাতির মেরুদÐ হিসেবে সকলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, ‘শিক্ষকরাই’ জাতির মেরুদÐ। কথাটি যথার্থ, সময়োপযোগী ও ন্যায়সঙ্গত মনে হলেও প্রশ্ন থাকে কোন শিক্ষক? অবশ্যই আদর্শ শিক্ষক। যার লক্ষ্য হবে আদর্শ মানুষ তৈরি, আদর্শ নাগরিক তৈরি; যার লক্ষ্য হবে শিক্ষার্থীর দেহ, মন ও আত্মার পূর্ণ বিকাশ সাধন করা। নিজেকে সত্য ও সঠিক পথে চলার যোগ্য করে তোলার পাশাপাশি নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার জন্য প্রস্তুত করতে হবে এবং ছাত্র/ছাত্রীদেরও বলতে হবে। একজন আদর্শ শিক্ষকই জাতির মেধা গড়ার কারিগর। তাই তাকে হতে হবে আর দশটি মানুষের তুলনায় সেরা।
একজন আদর্শ শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য হবে- ছাত্র-ছাত্রীদের যেকোনো সমস্যায় ভালোভাবে বোঝানোর ক্ষমতা বা দক্ষতা। সব ধরনের পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়া। ছাত্র-ছাত্রীদের সত্যের পথে চালিত করা। ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে আত্মিক বন্ধন তৈরি করা। আনন্দের সাথে পড়ানো, যাতে করে ছাত্র-ছাত্রীরা পড়ায় মনোযোগী হয়। শিক্ষাক্রম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা। উপস্থাপনের দক্ষতা। পরিবর্তনশীল মনোভাব। মিষ্টভাষী ও সদালাপী হওয়াও। কথায় ও কাজে, পোশাক ও রুচিতে, পেশায় ও কর্তব্য পালনে শিক্ষক হবেন আদর্শবান, ধর্মপ্রাণ, সত্যপ্রিয় অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। শিক্ষক হবেন রোল মডেল বা আদর্শ, জ্ঞানের উৎস, আনন্দের ভাÐার ইত্যাদি
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী
abunoman72@ymail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন