শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

প্রধান বিচারপতির বক্তব্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ

| প্রকাশের সময় : ৩ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুজিবুর রহমান মুজিব : প্রধান বিচারপতির দায়িত্বভার নিয়েই বিচারপতি এস কে সিনহা বহুবিধ প্রতিকূলতা, সংশ্লিষ্ট অনেকের অসহযোগিতা সত্ত্বেও বিচার ব্যবস্থায় বিদ্যমান সমস্যা ও সংকট নিরসনে বিভিন্ন গণমুখী কার্যক্রম ঘোষণা ও গ্রহণ করেন। দেশে প্রচলিত ব্রিটিশ আমলের গণবিরোধী আইন ও বিধি পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংশোধনের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম ঘোষণা করেন। বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের পর মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার অহেতুক বিলম্বে অসন্তোষ প্রকাশ করে এই অহেতুক বিলম্বের বিরোধিতা করেন। এই নিয়ে একজন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির অহেতুক সমালোচনার সম্মুখীন হন। তবুও তিনি তার দায়িত্ব, কর্তব্য ও বক্তব্য থেকে পিছু হটেননি।
স্বল্প সময়ে অল্প ব্যয়ে বিচার প্রার্থীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বদ্ধপরিকর, ওয়াদাবদ্ধ। মামলার জট নিরসনেও তিনি আন্তরিক। সম্প্রতি ঢাকায় বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ-আইনসভা, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক এবং মূল্যবান বক্তব্য দিয়ে তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। বিচার বিভাগের প্রধান ব্যক্তি এবং অভিভাবক হিসেবে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য দিতেই পারেন। এটা তার সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতা এবং সাংবিধানিক অধিকার বলে তিনি সে দায়িত্ব পালনে একান্তই আন্তরিক, দায়িত্ববান, কর্মতৎপর।
একটি কল্যাণকামী আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ-আইন, বিচার ও প্রশাসন সম্পূর্ণ স্বাধীন। সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্রের এই তিনটি স্তম্ভ স্বতন্ত্র স্বাধীন, একে অন্যের সহায়ক-পরিপূরক, সাংঘর্ষিক নয়। নামে স্বাধীন হলেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও পৃথকীকরণ (ইন্ডিপেনডেন্স এন্ড সেপারেশন)-এর জন্য আইনজীবী সমাজ দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। আইনজীবী সমাজের নেতা মরহুম এডভোকেট সামশুল হক চৌধুরীকে এরশাদ সরকারামলে কারা যাতনা ভোগ করতে হয়েছে। অবশেষে মাজদার হোসেন মামলার রায়ের প্রেক্ষিতে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন হয় ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারামলে। মামলার রায়ে আদালত কতিপয় দিক-নির্দেশনাও প্রদান করেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও পৃথকীকরণের ফলে নি¤œ আদালত জেলা ম্যাজিস্ট্রেসিতে কাঠামো ও গুণগত মৌলিক পরিবর্তন আসে। ইতোপূর্বে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষে একজন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং তার কিংবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেসির অধীনে প্রথম শ্রেণির ক্ষমতাসম্পন্ন একাধিক আমল আদালত বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। বিচারকগণ বিচারিক দায়িত্ব পালন ছাড়াও নির্বাহী বিভাগের প্রশাসনিক কার্যক্রম চালাতেন। এতে সময় মত বিচারকার্যে মনোযোগ দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হত না। অনেক সময় অনেক ক্ষেত্রে বিচারকার্য তাদের গৌণ কাজে পরিণত হত এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমকেই তারা মুখ্য কর্ম বলে বিবেচনা করতেন।  ফলে বিচারপ্রার্থীদের বাড়তি খরচ ও হয়রানির সম্মুখীন হতে হত।
মজাদার হোসেন মামলার রায়ের প্রেক্ষিতে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসি ব্যবস্থা প্রবর্তন হয়। অতিরিক্ত জেলা ও দায়রাজজের মর্যাদাসম্পন্ন একজন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং তার অধীনে একাধিক প্রথম শ্রেণির ক্ষমতাসম্পন্ন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে প্রায় এক দশক পূর্বে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট প্রথা চালু হলে এখনও নানাবিধ সংকটের সম্মুখীন। স্বতন্ত্র আদালত ভবন না থাকার কারণে কালেক্টারেট ভবনসমূহে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের কার্যক্রম দেখা। এই নিয়ে জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের একটি মনস্তাত্বিক বৈরিতা শুরু থেকেই দেখা দেয়। কোথাও কোথাও বাধা ও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসিকে। নতুন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেও শুরু হয় দীর্ঘসুত্রিতা ও কালক্ষেপণ। ভবন নির্মাণের মালিক-রক্ষণাবেক্ষক গণপূর্ত বিভাগ। সাইট সিলেকশনের মালিক জেলা প্রশাসক। তিনি ভূমি দেখা কমিটির কনাভেনার ও বটেন। প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতার কারণে ভবন নির্মাণ ঝুলে আছে। ইতোপূর্বে জেলা প্রশাসকগণ তাদের কগনিজান্স পাওয়ার ফিরে পাবার জন্য সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে দাবিদাওয়া পেশ করেছিলেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেসি বর্তমানে কাঃ বিঃ আইনের ১৪৪, ১০৭, ১৩৩, ৯৮, ১০০, ধারায় হালকা মামলা মোকদ্দমার বিচারকার্য এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়। মোবাইল কোর্টে কতেক বিধিবিধান থাকার কারণে জেলা ম্যাজিস্ট্রেসিও সন্তুষ্ট নয়। এছাড়া একটি কুচক্রীমহল জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসিকে বিতর্কিত এবং জনপ্রিয়তা হ্রাসের হীন পরিকল্পনায় লিপ্ত আছেন।
বিচার বিভাগ,  সংবিধান মোতাবেক স্বতন্ত্র ও স্বাধীন হলেও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও স্বতন্ত্র স্বাধীন সচিবালয় না থাকা এবং আমলাতান্ত্রিক অসহযোগিতার কারণে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ সাঁতারুকে হাত-পা বেঁধে পানিতে ফেলে দিলে তার পক্ষে সাঁতার কাটা তো দূরের কথা, প্রাণ রক্ষাই কঠিন হয়ে পড়ে। ক্ষেত্রবিশেষে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন বিচার বিভাগ বর্তমানে হাত-পা বাঁধা সাঁতারুর মতো। এই প্রেক্ষিতে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের গতি, মর্যাদা ও ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য প্রধান বিচারপতির অভিমত ও উক্তি প্রাসঙ্গিক, প্রনিধানযোগ্য। দেশের আইনজীবী সমাজ এবং অসহায় বিচারপ্রার্থী জনগণের মনের কথাই বলেছেন তিনি।
লেখক : সিনিয়র এডভোকেট, হাইকোর্ট। মুক্তিযোদ্ধা। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেস ক্লাব।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন