শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

জুয়া ও মাদকের বিরুদ্ধে

| প্রকাশের সময় : ৪ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু নোমান : বগুড়া জেলা যুবলীগের জুয়া, হাউজি, লটারি, অশ্লীল নৃত্যসহ মাদকের আসর বন্ধের আন্দোলনের সাথে শান্তি ও সভ্যপ্রিয় সমগ্র দেশবাসী সহমত পোষণ করে। বগুড়া জেলা যুবলীগকে অভিনন্দন, মোবারকবাদ।
বগুড়ার বিভিন্ন স্থানে জুয়া, হাউজি, লটারি, অশ্লীল নৃত্যসহ মাদকের আসর বন্ধে প্রশাসনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে অবরোধ কর্মসূচি পালন করে জেলা যুবলীগ। গত ২৭ ডিসেম্বর শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথায় প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়। এর আগে জেলা যুবলীগ সভাপতির সভাপতিত্বে সাতমাথায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে বগুড়ার বিভিন্ন যুব সংগঠন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন ও কর্মসূচির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। সমাবেশ থেকে বক্তারা অবিলম্বে জুয়া, হাউজি, লটারি বন্ধ করার দাবি জানান। মেলার নামে জুয়ার আসর, অশ্লীল নৃত্যসহ বিভিন্ন স্থানে মাদকের আসর বন্ধে প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ দাবি করেন। বক্তারা আরো বলেন, সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের বুকে বীরের জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। গুটিকয়েক ব্যক্তি তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে জনতার পকেট উজাড় করাসহ যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয় ও বিপথগামী করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ। তারা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করাসহ সফলতা মøান করে দিচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরবর্তীতে সমৃদ্ধ দেশ গঠনের লক্ষ্যে মদ, জুয়া, হাউজি নিষিদ্ধ করেছিলেন। জেলা শহরের আশপাশসহ বিভিন্ন উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে মেলার নামে লটারি, ডাবু, চরকি, হাউজি, ওয়ানটেন, চরচরি, বউ, বেলপার্টি, ঘিন্নিসহ বিভিন্ন নামে জুয়া, নগ্ননৃত্য ও মাদকের আখড়া অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য আহ্বান জানান বক্তারা। অন্যথায় বগুড়া জেলা যুবলীগের পক্ষ থেকে বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। বক্তারা বগুড়ার নওদাপাড়ায় বিজয় মেলা, কাহালুর পাইকড় ইউপির পশ্চিম ভুগইল, শিবগঞ্জের কিচক, ভায়েরপুকুর, মাঝিহট্ট ইউপির ছাতুয়ার ল্যালপাগাড়ী, গাবতলী উপজেলার সোনারায়, গোলাবাড়ী, শেরপুরের সীমান্ত এলাকা রানীরহাট, রাজারদিঘির জুয়ার আসর অবিলম্বে বন্ধ করে বগুড়ার যুবসমাজকে নৈতিক অবক্ষয় ও সাধারণ মানুষকে নিঃস্ব হওয়ার পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেন।  
বর্তমানে পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়েও ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে বিশ্বে তামাকজাত ও মাদকদ্রব্য যা প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে দিচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ তরুণ-তরুণীদের জীবন ও পরিবার এবং ধসিয়ে দিচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল। জুয়াড়ি ব্যক্তির হাতে টাকা-পয়সা না থাকলে সে সম্পদ বিক্রি করে প্রয়োজনে ঘরের জিনিসপত্র এমনকি ঘর বিক্রি ও চুরি, ডাকাতি করে হলেও খেলায় অংশগ্রহণ করে থাকে। জুয়া খেলার সাথে চোর-ডাকাতের এবং খারাপ লোকদের সম্পৃক্ততাই সবচেয়ে বেশি। মোটকথা, এ খেলায় যেমন অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়, তেমনি এতে মানুষের চারিত্রিক ক্ষতিও হয় চরমভাবে। জুয়া খেলা এক প্রকার সামাজিক মারাত্মক অপরাধ যা ব্যক্তি চরিত্র হতে সমাজ চরিত্রকেও কলুষিত করে। পৃথিবীর কোন ধর্মই জুয়াকে সমর্থন করেনি। ইসলামের দৃষ্টিতেও মদ-জুয়া হারাম ও কবীরা গুনাহ।
জুয়াড়ির জীবন-সংসার কুরে কুরে বিনষ্ট হয়। জাহেলিয়াতের যুগে জুয়ার কার্যক্রম ব্যাপক আকারে প্রচলিত ছিল। তখন মানুষ এর প্রতি এমন আসক্ত ছিল যে, কখনো কখনো স্ত্রী-ছেলেমেয়েদেরও বাজির উপকরণ বানিয়ে ফেলত। মূলত জুয়া খেলা, মদপান সামাজিক অনাচারও অপরাধের মধ্যে অন্যতম। জুয়াড়ি ব্যক্তি সমাজ জীবনে অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতায় পশু জীবন হতেও অধঃপতনের নিচে নেমে যায়, ফলে সমাজে পারস্পরিক কলহ-বিবাদ, মারামারি ও হত্যা পর্যন্ত সংঘটিত হয়ে থাকে। জুয়াড়ি জুয়ার নেশায় মদখোর ব্যক্তির ন্যায় মাতাল অবস্থায়ই থাকে সর্বদা। এ কারণে সে ছেলেমেয়ে, স্ত্রী ও আত্মীয় কারো খবর রাখতে পারে না। ফলে জুয়াড়ি ব্যক্তি তার পরিবার-পরিজনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারে না, ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত বানাতে পারে না। বরং তারাও পিতার দেখাদেখি ঐ সর্বনাশা খেলায় আংশগ্রহণের প্রয়াস পায়। এমনি করে জুয়াড়ি ও নেশাখোর ব্যক্তির পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। মেজাজে সর্বদা রুক্ষতা ও নিষ্ঠুরতা বিরাজমান থাকে। এতে স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের সাথে বিবাদ, ঝগড়া ও অশান্তি সর্বদা লেগেই থাকে। বর্তমানে স্ত্রী কর্তৃক স্বামী হত্যা বা স্বামী কর্তৃক স্ত্রী হত্যা এ জাতীয় লোমহর্ষক ঘটনার পেছনে জুয়া ও নেশার প্রভাবকে খাটো করে দেখা যায় না। জুয়া ও নেশার সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতির দিকটি হলো এতে মানুষ আল্লাহ্ বিমুখ এবং নামাজ-রোজা তথা ইবাদত-বন্দেগীর ব্যাপারে চরমভাবে উদাসীন ও গাফিল হয়ে যায়।
এ জন্য জুয়াকে অর্থ উপার্জনের উপায় হিসেবে গ্রহণ করা যেমন কোন মুসলমানের জন্য জায়েজ নেই, তেমনি একে খেলা, মনের সান্ত¡না, তৃপ্তি ও অবসর বিনোদনের উপায়রূপে গ্রহণ করাও বৈধ হতে পারে না। মাদক ব্যবসা বর্তমান বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম ও সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসায়ে পরিণত হওয়ায় চোরাকারবারীরা এই ব্যবসায়ের প্রতি বেশী ঝুঁকে পড়েছে। তাছাড়া ভৌগোলিক কারণে এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে মাদক পাচারের আন্তর্জাতিক রুট। অধিকন্তু পার্শ্ববর্তী বৃহৎ রাষ্ট্রটি ইচ্ছাকৃতভাবে এদেশের উঠতি বয়সের তরুণদের ধ্বংস করার নীলনকশা বাস্তবায়নের জন্য তাদের সীমান্তে অসংখ্য হেরোইন ও ফেনসিডিল কারখানা স্থাপন করেছে এবং সেখানকার উৎপাদিত মাদকদ্রব্য এদেশে ব্যাপকভাবে পাচার করছে উভয় দেশের চোরাকারবারী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এছাড়া স্থল, নৌ ও বিমান পথের কমপক্ষে ৩০টি রুট দিয়ে এদেশে মাদক আমদানী ও রফতানী হচ্ছে। ফলে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বর্তমানকালে প্রাচীন পদ্ধতি ছাড়াও জুয়ার ক্ষেত্রে আরো বহু নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। যেমন হাউজি, টাকা বাজি রেখে ঘোড় দৌড় ও তাস খেলা ইত্যাদি। এগুলো সবই হারাম। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, শুধু নাম পরিবর্তনের কারণে বস্তুর হাকীকত (মূল প্রকৃতি) এবং হুকুম পরিবর্তন হয় না। কাজেই প্রাচীনকালে প্রচলিত জুয়া সম্পর্কে যে হুকুম প্রযোজ্য ছিল, আধুনিককালের জুয়ার ক্ষেত্রেও সে হুকুম প্রযোজ্য হবে। ইসলামী শরীয়াতে জুয়া হারাম। একাধিক আয়াত ও হাদীসে এ সম্পর্কে স্পষ্ট বিবরণ রয়েছে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তি পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণয়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন কর, তাহলেই তোমরা সফলকাম হতে পারবে। শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদের আল্লাহ্র স্মরণে ও নামাজ আদায়ে বাধা দিতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না (মাদিয়া)।
এ আয়াতে মদ ও জুয়াকে ঘৃণ্য বস্তু আখ্যায়িত করা হয়েছে। এগুলোকে শয়তানের কাজ বলা হয়েছে। মদ ও জুয়াকে একই পর্যায়ভুক্ত করে মূর্তি পূজার সাথে মিলিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। আয়াতে এগুলো থেকে দূরে থাকার হুকুম করা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে, এতে পরষ্পরের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। অধিকন্তু এর দ্বারা শয়তান মানুষকে নামাজ আদায় করা এবং আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ রাখে। কাজেই মদের ন্যায় জুয়াও হারাম। এর হারাম হওয়ার বিষয়টি কুরআন মাজীদের অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত। যদি কেউ এই হুকুমকে অস্বীকার করে, তবে সে কাফির বলে গণ্য হবে।
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘তারা আপনাকে (নবী) মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি বলে দিন, উভয়ের মধ্যেই রয়েছে মহাপাপ’ (বাকারা)। জাহেলিয়াতের যুগে ঘোড়া দৌড়েও জুয়ার প্রচলন ছিল। দু’ব্যক্তি ঘোড়া দৌড়ের প্রতিযোগিতায় নামত এবং পরস্পরে এ চুক্তিতে আবদ্ধ হতো, যে পরাজিত হবে সে বিজয়ীকে নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ দেবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) একেও জুয়ার অন্তর্ভুক্ত করে হারাম ঘোষণা করেছেন’ (আবু দাউদ)। রাসূলুল্লাহ (সা.) শুধু জুয়াকেই হারাম করেননি বরং জুয়ার ইচ্ছা প্রকাশকেও গুনাহ সাব্যস্ত করেছেন। সব ধরনের জুয়াবাজি অবৈধ এবং এর থেকে প্রাপ্ত সম্পদ হারাম। হারাম সম্পদ ভোগ করে ইবাদত-বন্দেগি করলে আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। তাই সব ধরনের জুয়াবাজি থেকে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।
ইমাম বুখারী (রহ.) বলেন, হযরত ইবনে ওমার (রা.) বলেছেন, মদপানকারীকে সালাম দিওনা। রাসূল (সা.) আরো বলেন, মদপানকারীদের সাথে ওঠাবসা করো না, তারা রোগাক্রান্ত হলে দেখতে যেও না। তাদের জানাজায় অংশ গ্রহণ করো না। হাশরের দিন মদখোর কালো কুৎসিত চেহারা নিয়ে উঠবে। তার জিহ্বা বুকের উপর ঝুলতে থাকবে যা থেকে লালা ঝরতে থাকবে। যে-ই তাকে দেখবে, সে-ই তাকে মদপানকারী হিসাবে চিনবে (ইবনে জাওসী)। ওলামায়ে কেরামের একদল অভিমত ব্যক্ত করেছেন মদখোর রোগাক্রান্ত হলে তাকে দেখতে যাওয়া ও সালাম দেয়া নিষিদ্ধ ঘোষণার কারণ, মদখোদ ফাসেক ও অভিশপ্ত। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) তার প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করেছেন। তবে তওবা করলে আল্লাহ তাকে মাফ করবেন।
মাদকের প্রভাবে মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে তার মধ্যে পাগলামি, অমনোযোগিতা, দায়িত্বহীনতা, অলসতা, উদ্যমহীনতা, স্মরণশক্তি হরাস, অস্থিরতা, খিটখিটে মেজাজ, আপনজনের প্রতি অনাগ্রহ এবং স্নেহ-ভালোবাসা কমে যাওয়া ইত্যাদি আচরণ প্রতিভাত হয়। এছাড়াও বন্ধুদের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ছোটদের প্রতি স্নেহ কমে আসে। অতঃপর সে ক্রমে নানাবিধ অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। সে যে কোন সুযোগে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে। হেন কোন অপকর্ম নেই যা তার দ্বারা সাধিত হয় না। দুষ্ট লোকেরা টাকার বিনিময়ে সর্বদা এদেরকেই ব্যবহার করে থাকে। এরা সর্বদা মানুষের ঘৃণা কুড়ায় ও সমাজে নিগৃহীত হয়।
মদ-জুয়াই সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অন্যতম উৎস। একমাত্র ইসলামী বিধানেই মদ-জুয়া নির্মূল করা সম্ভব। ব্যক্তি ও সমাজকে ধ্বংস করার জন্য কেবলমাত্র জুয়া ও মদই যথেষ্ট। অতএব ব্যক্তি জীবনে কঠোরভাবে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার সাথে সাথে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন করা অতীব জরুরি।
abunoman72@ymail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন