কে এস সিদ্দিকী : আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পথের খাঁটি অনুসারীদের মধ্যে পীর-মাশায়েখ ও ওলামায়ে কেরামের বিপুলসংখ্যক ব্যক্তি আজও বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু স্থানে ইসলামের পতাকা বহন করে চলেছেন। স্বদেশ-বিদেশে ইসলাম ও ইসলামের শিক্ষা বিস্তারে এবং আধ্যাত্মিক ফয়েজ বিস্তার-প্রসারে তাদের অসামান্য অবদান স্বীকৃত। তাদের অনেকেই বাংলাদেশে প্রচলিত-প্রসিদ্ধ তরিকত সিলসিলাগুলোর সাথে সম্পৃক্ত এবং মাজহাবের দিক থেকে এদেশের মুসলমানদের সিংহভাগই হানাফী মাজহাবের অনুসারী। পূর্বের কথা বাদ দিলেও উপমহাদেশে হজরত শাহ ওয়ালি উল্লাহ (রহঃ) হতে তরিকতের যেসব সিলসিলার প্রচলন হয়েছে মোটামুটিভাবে সমগ্র উপমহাদেশের প্রায় সর্বত্র এ সিলসিলাগুলোর সকল অনুসারীই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতভুক্ত। হজরত শাহ পরবর্তী যুগে হজরত সৈয়দ আহমদ বেরলভী (রহ.) থেকে হানাফীপন্থী তরিকতের যে ধারার সূত্রপাত, তা প্রধানত হজরত সৈয়দ সাহেবের তিন বাঙালি খলিফাকে কেন্দ্র করে এবং তারা হচ্ছেন যথাক্রমে হজরত শাহসুফী নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী (রহ.), মওলানা ইমাম উদ্দীন (রহ.) এবং শাহ মওলানা কারামত আলী জৈনপুরী (রহ.)। আমাদের এ নিবন্ধের প্রতিপাদ্য মওলানা জৈনপুরী (রহ.)-এর তরিকতের অনুসারী খলিফাদের সূত্র পরম্পরায় ফুরফুরায় বাংলাদেশী খলিফাদের কথা, যাদের অন্যতম শাহ মাওলানা ইয়াছীন (রহ.) যিনি ছিলেন মরহুম মাওলানা এম এ মান্নানের মহান পিতা।
এদেশে ইসলাম প্রচারে মাওলানা শাহ কারামত আলী জৈনপুরী (রহ.) ছিলেন উৎসর্গকৃতপ্রাণ। তার জবানী ও কলমী জেহাদ সমান্তরালভাবে চালু ছিল। এদেশে এমন এক সময় ছিল যখন ধর্মপ্রাণ প্রায় ঘরানায় সন্তানদের প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা ঘরে-মকতবে ‘রাহনাজাত’ ও ‘মেফ্তাহুল জান্নাত’ নামক কিতাব দ্বয়ের মাধ্যমে প্রদান করা হতো এবং এ দুটি মাসলা-মাসায়েল সংক্রান্ত কিতাবই রচনা করেছিলেন মাওলানা কারামত আলী জৈনপুরী। তিনি শেষ পর্যন্ত পিতৃভূমি জৈনপুরকে চিরবিদায় জানিয়ে এদেশের রংপুরেই স্থায়ী অধিবাসী হয়ে যান এবং সেখানে তার মাজার অবস্থিত।
‘হাদিয়ে বাঙালা’ নামে ইতিহাসে খ্যাত মাওলানা কারামত আলী (রহ.) সম্পর্কে খবরাখবর তেমন নজরে না পড়লেও গত ৩ জানুয়ারি (মঙ্গলবার) শাহ কারামত আলী জৈনপুরী (রহ.)-এর ওফাত বার্ষিকীতে ইসলামী মহাসম্মেলন শীর্ষক প্রকাশিত খবরটি উল্লেখযোগ্য। খবরটিতে বলা হয়েছে ‘অত্যন্ত সাফল্যজনকভাবে হাদিয়ে বাঙালা শাহ কারামত আলী জৈনপুরী (রহ.)-এর ওফাত বার্ষিকী উপলক্ষে রংপুরে ১৪৮তম ইসলামী মহাসম্মেলন শেষ হয়েছে। ইসলামী মহাসম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হাদিয়ে বাঙালা শাহ কারামত আলী জৈনপুরী (রহ.)-এর উত্তরসূরি বাংলাদেশের আমির আল্লামা মুফতি ড. সাইয়্যেদ মুহাম্মদ এনায়েতুল্লাহ ওয়া সিদ্দিকী পীর সাহেব জৈনপুরী। তিনি বলেন, হাদিয়ে বাঙালা শাহ কারামত আলী জৈনপুরী (রহ.) যে আসলেই একজন আল্লাহর ওলী এবং হাদিয়ে বাঙালি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল তার মাজার। কেননা তার মাজার সম্পূর্ণ শিরক-বেদাতমুক্ত আর তাঁর বংশের কেউই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পথ থেকে সরে যায়নি। (সূত্র ঃ ইনকিলাব)
বর্তমানে এরূপ খাঁটি কথা বলার লোকের অভাব নেই বলে দাবি করা কঠিন। কেননা, দেশে পীর-মাশায়েখের মাজারের সংখ্যা রয়েছে প্রচুর এবং অভিযোগও কম নয়। শিরক-বেদাত তথা কুসংস্কারের ব্যাপকতা অনেক পবিত্র মাজারকে বাজারে পরিণত করেছে। শাহ কারামত আলী জৈনপুরী (রহ.)-এর সম্মানিত উল্টরসূরির দাবির প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, হজরত শাহ কারামত আলী জৈনপুরী (রহ.)-এর সিলসিলার খলিফাগণ এবং তাদের খলিফাগণ তাদের জৈনপুরী পীর-মর্শিদের তরিকার খাঁটি অনুসারী ছিলেন। তারা শিরক-বেদাতকে কখনো প্রশ্রয় দেননি এ বিশ্বাস অনেকেরই। হাদিয়ে বাঙালার বঙ্গীয় খলিফাদের মধ্যে ফুরফুরার শাহ আবু বকর সিদ্দিকী এবং তাঁর বাংলাদেশী খলিফাগণও শিরক-বেদাতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গিয়েছেন এবং তারা নিজ নিজ এলাকার ভক্ত-অনুসারীদের সঠিক পথে পরিচালিত করেন।
তৎকালীন বাঙলায় শাহ ‘ওয়ালি উল্লাহী আন্দোলনকে জোরদার করার ক্ষেত্রে যার ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়, তাঁর নাম শাহ মাওলানা কারামত আলী জৈনপুরী (রহ.)। আল্লামা সৈয়দ সুলায়মান নদভীর ভাষায়, বাঙলায় ইসলামের প্রচার ও মুসলমানদের সংস্কার কাজ তাঁর চেয়ে অধিক আর কেউ করতে পারেননি। তিনি ১৮ মোহাররম ১২১৫ হিঃ মোতাবেক ১২ জুন ১৮০০ খৃঃ মোল্লাটোলা জৈনপুরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২ রবিউস সানি ১২৯০ হিঃ মোতাবেক ৩০ মে ১৮৭৩ খৃঃ রংপুরে ইন্তেকাল করেন। মুনশীপাড়া মহল্লায় তাঁর মাজার অবস্থিত। দূরদূরান্ত থেকে হাজার হাজার মুসলমান সেখানে জিয়ারত করতে আসেন। জৈনপুরে উমরখান মহল্লায় হোসেনশাহ শারবী প্রতিষ্ঠিত বিশাল জামে মসজিদে তাঁর প্রতিষ্ঠিত কোরআনিয়া মাদ্রাসা চালু রয়েছে। তিনি শতাধিক ছোটবড় গ্রন্থের লেখক। বাকরগঞ্জ, ফরিদপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ঢাকা, রংপুর এবং দিনাজপুরে তার মুরিদ-ভক্তদের সংখ্যা এক লাখেরও অধিক। তিনি বাঙলার মুসলমানদের নিকট খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। আর জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম আবদুল আউয়াল, মেঝো পুত্র হাফেজ আহমদ, যার মাজার ঢাকার চকবাজার মসজিদের এক কোণে। মাওলানা কারামত আলী জৈনপুরী (রহ.) ফেকা শাস্ত্রের কিতাবাদি হজরত শাহ আবদুল আজীজ (রহ.)-এর নিকট পাঠ করেন। মাওলানা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহ.) ছিলেন তাঁর একই বিষয়ের ওস্তাদ। শাহ কারামত আলী (রহ.) বায়াত হয়েছিলেন আমিরুল মোমেনিন হজরত সৈয়দ আহমদ বেরলভী (রহ.)-এর নিকট। তিনি হস্তলিপি শাস্ত্রে বিশারদ ছিলেন এবং এ শাস্ত্রে নাস্তালীক ও তোগরা লিপিতেও ছিলেন অসাধারণ দক্ষ। তিনি ‘সপ্ত কেরাত’ শিখেছিলেন। এসব যোগ্যতা-দক্ষতার পাশাপাশি তিনি ব্যক্তি জীবনে ছিলেন অতি উঁচুস্তরের মোত্তাকী, পরহেজগার, অসাধারণ যোগ্য, সমজদার এবং বুদ্ধিমান বুজর্গ। কর্মজীবনে তিনি একান্ন বছরব্যাপী তৎকালীন বাঙালার অর্থাৎ বঙ্গ প্রদেশের সর্বত্র আনাচে-কানাচে দ্বীন ইসলামের প্রচার, ইসলামী শিক্ষায় মানুষের আত্মশুদ্ধি, সংস্কার, কুপ্রথা-কুসংস্কারের মূলোচ্ছেদ এবং মানবতার সেবা ইত্যাদি কর্মতৎপরতায় আতিবাহিত করেছিলেন। পরবর্তীকালে দেখা গিয়েছে তার খলিফা এবং তাদের খলিফাগণ হজরত শাহ কারামত আলী (রহ.)-এর সেই একই মিশনকে সমুন্নত রেখে চলেছেন এবং ইসলামকে ভেজালমুক্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন যা এখনো অব্যাহত আছে।
আরো একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা এই যে, মোগল সা¤্রাজ্যের পতনের পর মুসলমানদের অধিকারসমূহ যেভাবে পদদলিত করা হয়, ইংরেজরা যে নিষ্ঠুরভাবে মুসলমানদের ওপর অকথ্য নির্যাতন-নিপীড়ন চালায়, তাদের অর্থনীতিকে যেভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয় এবং মামলা-মোকাদ্দমা ও জেল-জুলুমের মাধ্যমে এবং ইংরেজ সরকারের প্ররোচনা-প্রতারনা এবং নানা প্রকারের সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টির জাল বিস্তার করে সরলপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করা হতে থাকে এ চরম ও করুণ পরিস্থিতি সম্পর্কে মাওলানা কারামত আলী জৈনপুরী (রহ.) সম্যক অবহিত ও চিন্তিত-মর্মাহত ছিলেন। উদ্ভূত পরিস্থিতির শিকার হয়ে মুসলমানদের একটি বিশেষ শ্রেণী ভারতবর্ষকে ‘দারুল হরব’ (যুদ্ধক্ষেত্র) মনে করে হিজরতের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। এরূপ ধারণা পোষণকারী মুসলমানদের সংখ্যা বাঙলায়ও কম ছিল না। এহেন নাজুক পরিস্থিতিতে ফরিদপুরের কৃতীসন্তান নওয়াব আবদুল লতিফ (খান বাহাদুর সিআই) ছিলেন সেক্রেটারি মোহামেডান লিটরেরি এসোসিয়েশন কলিকা; তা তাঁরই আপ্রাণ প্রচেষ্টা ও মাওলানা কারামত আলী জৈনপুরী (রহ.)-এর ফতোয়া এবং ওয়াজ-নসিহতের বদৌলতে সাধারণ মুসলমানদের সন্দেহ-সংশয় দূর হয়ে যায় এবং তারা অনুভব করতে পারে যে, ইসলামী ফরজগুলো আদায় করার ক্ষেত্রে কোনো নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিবন্ধকতা-জটিলতা থাকতে পারে না এবং এদেশকে ‘দারুল হরব’ বা যুদ্ধক্ষেত্র বলে আখ্যায়িত করা যায় না। মাওলানা জৈনপুরী (রহ.)-এর এ ফতোয়ার ফলে মুসলমানদের আস্থা ফিরে আসে এবং তারা এ ব্যাপারে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে এবং নিরাশা হতে তারা মুক্তি লাভ করে। পরিস্থিতির উন্নতি কিভাবে সাধিত হতে থাকে তাও লক্ষ্যণীয়।
১৮৫৭ সালের সাধীনতা সংগ্রামের ১২ বছর পর লর্ড মাউ (১৮৬৯-১৮৭২) ভারতবর্ষের গভর্নর হয়ে আসেন। তাঁর পূর্বে গভর্নর ছিলেন লর্ড লরেন্স (১৮৬৪-৬৯)। প্রথমোক্ত গভর্নর জেনারেল আসার পর মুসলমানদের সাথে ইংরেজদের সদ্ভাব ও আচরণের উন্নতি হতে থাকে এবং মুসলমানদের নির্মূল ও খতম করার নীতির পরিবর্তন হয় এবং তাদের সাথে সহানুভূতি ও কোমল নীতির অনুসরণ করা হতে থাকে। লর্ড মাউ মুসলমানদের সাথে সদ্ভাব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। তাঁর শাসনামলে, তারই উৎসাহ-প্রেরণায় স্যার উইিয়াম হান্টার ‘আওয়ার মোহামেডান অব ইন্ডিয়া’ নামক পুস্তক রচনা করে মুসলমানদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন। মাওলানা কারামত আলী জৈনপুরী (রহ.)কে বর্ণিত পরিস্থিতির আলোকে বিচার-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করতে হবে। তার অবিস্মরণীয় অবদানগুলোকে বিস্মৃত হয়ে যাওয়ার ফলে এদেশে ইসলাম প্রচার ও মুসলমানদের কুসংস্কারমুক্ত করার সঠিক ইতিহাস বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যাচ্ছে। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন