মোহাম্মদ আবু তাহের : ৮ ডিসেম্বর ২০১৬। এদিন বিআইবিএমের সেমিনার হলে ‘আপনজন’ নামক একটি স্মরণিকার প্রকাশনা অনুষ্ঠান হয়। এ ধরনের প্রকাশনা অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা খুবই গতানুগতিক হলেও আপনজন-এর প্রকাশনা অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা ছিল একটি ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজন। এই লেখকের সভাপতিত্বে বিআইবিএমের এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিআইবিএমের প্রশিক্ষণ পরিচালক অধ্যাপক ড. শাহ্ মোঃ আহসান হাবিব। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিআইবিএমের অনুষদ সদস্য মোঃ নাজির হোসেনসহ আরও তিনজন অনুষদ সদস্য। ৪ অক্টোবর ২০১৫ থেকে পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তাদের মধ্য থেকেও কিছুসংখ্যক ব্যাংক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বিআইবিএম কর্তৃপক্ষ আরও দুটি প্রশিক্ষণ কোর্সের সনদ ও অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠান এই অনুষ্ঠানের সাথে একীভূত করায় প্রকাশনা অনুষ্ঠানটি ভিন্নমাত্রা পেয়ে সমৃদ্ধ হয় এবং অনুষ্ঠানটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
প্রকাশনা অনুষ্ঠানকে ব্যতিক্রমধর্মী আখ্যায়িত করছি এই কারণে যে, এর আগে বিআইবিএমের প্রশিক্ষণার্থী কর্তৃক কোন স্মরণিকা বা ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়নি। প্রকাশনা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ড. আহসান হাবিবের বক্তব্য আমাদের সকলকে উদ্দীপ্ত করেছে। বিশেষ অতিথি অনুষদ সদস্য মোঃ নাজির হোসেনের বক্তব্যও প্রশিক্ষণার্থী সকল কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রাণশক্তি সঞ্চার করেছে। Financial crime and compliance issues in Bank Ges Working Capital Financing case based Analysis বিষয়ক কোর্সের কো-অর্ডিনেটর ও বিআইবিএম অনুষদ সদস্য শেখ নাজিবুর রহমান এবং মোহাম্মদ রুহুল আমীনও বক্তব্য রাখেন। শেখ নাজিবুর রহমান স্মরণিকা প্রকাশনার মতো সৃজনশীল উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি অর্থ সংক্রান্ত অপরাধ ও ব্যাংকের পরিপালনীয় বিষয়াবলী সম্পর্কে ব্যাংক কর্মকর্তাদের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে এ জাতীয় প্রশিক্ষণের উপর গুরুত্বারোপ করেন।
আসলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যাংক কর্মকর্তাদের এ জাতীয় প্রশিক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। এ ধরনের প্রশিক্ষণে ব্যাংক কর্মকর্তাদের দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশেও ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমান দুর্নীতির কারণে আর্থিক খাত ঝুঁকির সম্মুখীন। এ ধরনের প্রশিক্ষণ ব্যাংকসমূহকে আর্থিক ঝুঁকি থেকেও বাঁচাতে সহায়তা করতে ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমি মনে করি। ব্যাংকিং সেক্টর শৃঙ্খলাবদ্ধ সেক্টর। এখানে অনিয়ম, অসাধুতা, দুর্নীতি, অনৈতিকতা যে কোন মূল্যে প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। রাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য হলো, সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে সমাজ ও রাষ্ট্রকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনাকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা করতে ফিনান্সিয়াল ক্রাইম এন্ড কমপ্লায়েন্স ইসুজ ইন ব্যাংক বিষয়ক কোর্স কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, লাগামহীন দুর্নীতির কারণে ব্যাংকিং খাতে মন্দঋণের পরিমাণ বেড়েই যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ ৬৫ হাজার ৭৩১ কোটি ১১ লাখ টাকা। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ খেলাপি ঋণ রয়েছে ৫৪ হাজার ১৭৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেছেন, দুর্নীতি ও বড়লোকদের যোগসাজশে দেয়া ঋণ বেশিরভাগই এখন ঝুঁকিপূর্ণ খেলাপির তালিকায়। এ ধারা বন্ধ করতে হলে দুর্নীতি ও অদক্ষতা দূর করতে হবে। বলা বাহুল্য ব্যাংকিং খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য এ ধরনের প্রশিক্ষণ ব্যাংক কর্মকর্তাদের জন্য জরুরি।
যে কোন সৃজনশীল কাজ মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। এই স্মরণিকা প্রকাশ করাও সৃজনশীল একটি কাজ। উদ্যোগটি দেখতে অনেক ক্ষুদ্র মনে হলেও এর ব্যাপ্তি অনেক। এ প্রসঙ্গে মাদার তেরেসার একটি উক্তি হলো : we can not always do the great thing we can do small thing with great love. সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হয়। আর এই মূল্যবোধ ধারণ করেই আমরা এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। আমরা বিশ্বাস করি প্রযুক্তির বিকাশের কারণে সাহিত্য ম্যাগাজিন, স্মরণিকা, কবিতা, সংবাদপত্র ইত্যাদি আক্রান্ত হতেই পারে। কিন্তু এ সমস্ত সৃজনশীল কর্মকা-ের মূল্য কখনো কমবে না। আদর্শ সংস্কৃতি চর্চা জ্ঞানকেও সমৃদ্ধ করে। মানুষের চিন্তাচেতনা এবং অর্জিত জ্ঞান ও বুদ্ধিকে বিকশিত করতে সাহায্য করে আদর্শ সংস্কৃতি চর্চা। কর্মক্ষেত্রে ভাল করার জন্য লাগে সৃষ্টিশীলতা, কর্মদক্ষতা, সমস্যা সমাধান বা মানসিক চাপ সামলানোর ক্ষমতা, সবার সঙ্গে মিলে মিশে কাজ করার ও শেখার দক্ষতা। নিজেকে রিচার্জ করার ক্ষমতা মানুষকে অর্জন করতে হয়। বিআইবিএমের প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে ব্যাংক কর্মকর্তারা এ সমস্ত গুণাবলী অর্জন করতে পারে। জ্ঞান অর্জন করতে, দক্ষতা অর্জন করতে স্বাপ্নিক মানুষ হতে বিআইবিএম ব্যাংক কর্মকর্তাদের অনুপ্রাণিত করে। তরুণ কর্মকর্তাদের অনেক বড় হতে হলে সফল ও সার্থক হতে হলে বড় স্বপ্নও দেখতে হবে। গুগলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লেরি পেইজ বলেছেন, ঘুমের ঘোরেও যদি একটা দারুণ স্বপ্ন দেখো সেটিও আকড়ে ধরো। পেশাগত সফলতার জন্য চারটি গুণ বিশেষভাবে দরকার। প্রথম হলো উদ্যম বা নতুন কিছু করা, দ্বিতীয় পেশাগত জ্ঞান বৃদ্ধি করা, তৃতীয় পেশার প্রতি ভালবাসা, আন্তরিকতা ও দায়িত্ব পালনে বিশ্বস্ততা, চতুর্থ হলো জনসংযোগ বা ব্যাপক পরিচিতি। মানুষ হিসাবে জন্মগ্রহণ করলেই যেমন সত্যিকারের মানুষ হওয়া যায় না, মানবসম্পদ হওয়া যায় না, ঠিক চাকরিতে যোগদান করলেই সফল পেশাজীবী হওয়া যায় না। পেশাদারিত্বে সফল হতে হলে অনেক গুণাবলী অর্জন করতে হয়। বর্তমান যুগ প্রতিযোগিতার যুগ। দিন দিন প্রতিযোগিতা বেড়েই চলছে। কেবল পেশাগত দায়িত্ব পালন করলেই হবে না সেই সঙ্গে তরুণ কর্মকর্তাদের তুখোড় হতে হবে, অন্যের কাছে নিজেকে প্রকাশ করতে হবে আকর্ষণীয়ভাবে। চৌকস মানুষ হিসেবে সঠিক ব্যক্তিত্ব ও রুচিবোধ যেন যে কোন পেশাজীবীর কথাবার্তা ও চালচলনে ফুটে উঠে শতভাগ সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হবে। নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক না থাকলে প্রতিষ্ঠান কখনো উন্নতি করতে পারে না। একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য, সমাজের জন্য যেমন দরকার সফল মানুষ, ঠিক তেমনি দরকার সার্থক মানুষ। সফল মানুষ ও সার্থক মানুষের মধ্যে রয়েছে অনেক পার্থক্য, ফুলের রং হলো সফলতা এবং সৌরভ হলো সার্থকতা। বিআইবিএমের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দেখলাম সফল ও সার্থক মানুষ হওয়ার জন্য বিআইবিএমের প্রশিক্ষণ এক কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
এ প্রসঙ্গে প্রধান অতিথি ও অনুষদ সদস্যবৃন্দের সদয় বিবেচনার জন্য কিছু যৌক্তিক প্রস্তাবনা তুলে ধরছি, বিআইবিএমের হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজম্যান্ট রিভিউ ২০১৪ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নে দেশের ৮৫ শতাংশ ব্যাংকের নীতিমালা আছে। ৭৫ শতাংশ ব্যাংকের বছরজুড়ে প্রশিক্ষণের নিয়মিত ক্যালেন্ডার রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর ৫২ শতাংশই প্রশিক্ষণ-পরবর্তী কোনো মূল্যায়ন করে না। ৫০ শতাংশ ব্যাংক কর্মীদের মূল্যায়ন প্রশিক্ষণের মূল্যায়ন প্রতিবেদনকে বিবেচনায় নেয় না। প্রচলিত বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই ব্যাংক কর্মীদের মূল্যায়ন করা হয়। কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্যই সরকারি ও বেসারকরি ব্যাংকগুলোতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। কর্মকর্তা মূল্যায়নে প্রশিক্ষণ যাতে যথাযথ গুরুত্ব পায় সে ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।
প্রশিক্ষণার্থীগণ প্রশিক্ষণ কোর্সের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতার জন্য অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে যারা বক্তব্য রেখেছেন সকলেই বিআইবিএমের অসাধারণ কর্মযজ্ঞের প্রশংসা করেছেন। আসলে দেশের যে কোন উন্নয়নের মূল শক্তি হলো জনগণ, ঠিক তেমনি বিআইবিএমের উন্নতির মূল শক্তি হলো সর্বস্তরের ব্যাংক কর্মকর্তাবৃন্দ। বিআইবিএমের প্রশিক্ষণ পরিচালকের অসাধারণ দক্ষতা ও জ্ঞানের ফলে বিআইবিএম উপকৃত হচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রশিক্ষণার্থী কর্তৃক প্রকাশিত ‘আপনজন’ নামক স্মরণিকাকে সৃজনশীল উদ্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তিনি প্রকাশনাকে অসাধারণ তাৎপর্যময় করেছেন। তিনি বিআইবিএমের ওয়েবসাইটে ‘আপনজন’ নামক স্মরণিকা প্রকাশ করার ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর এই স্বীকৃতি ‘আপনজন’ স্মরণিকাটি এর প্রকাশনার সাথে জড়িত সকলকে উৎসাহ জোগাবে। পাশাপাশি বিআইবিএমের অন্যান্য প্রশিক্ষার্থীদের সৃজনশীল কর্মকান্ডে জড়িত হতে অনুপ্রেরণা জোগাবে।
লেখক : সভাপতি, ব্যাংক অফিসার্স এসোসিয়েশন
মৌলভীবাজার জেলা কমিটি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন