বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

শিশু নির্যাতন বন্ধ হোক

| প্রকাশের সময় : ৯ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল : আমাদের সমাজে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মানুষকে ভাবলেও কর্তাব্যক্তিদের তা কতটুকু নাড়া দিচ্ছে তা বুঝা বড় কঠিন। আমরা আজ এমন এক কঠিন সময় অতিক্রম করছি যখন আড়াই বছরের শিশু থেকে বৃদ্ধ নারী পর্যন্ত কেউ নিরাপদ নয়। সবাই একটা আতঙ্কের মধ্যে আছে। সবার মনের মধ্যে একটা ভয় কাজ করছে। কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না, আমি সব দিক থেকে নিরাপদ আছি। যে সমাজে পচন ধরে, সেই সমাজের মানুষজনের কিছু অংশ ভাল থাকলেও বৃহৎ অংশই থাকে শঙ্কিত। কোন ধরনের নিশ্চয়তা তখন আর তাদের মধ্যে কাজ করে না। অনেক সময় মনে হয়, কিছু কিছু অঘটন যেন পরিকল্পিতভাবেই কিংবা ইচ্ছে করেই একশ্রেণীর মন্দ লোক ঘটিয়ে থাকে। একদল মানুষ সমাজে বাস করে যারা চায়, অস্থিরতা সৃষ্টি করে নিজের জন্য লাভজনক কিছু একটা করতে। এই শ্রেণীর মানুষেরা সকল সময়ে সক্রিয় থাকে চলমান সমাজে আলোর ঝলকানিটুকু নিভিয়ে দিয়ে চারদিক গাঢ় অন্ধকার নামিয়ে আনতে। অন্ধকারে আলোর পাখিরা বাস করতে পারে না। অন্ধকারে সেই সব প্রাণীই বাস করে যেসব প্রাণী তছনছ করে দেয় সমাজের শুভ চিন্তাভাবনাকে। আমার এসব কথা নতুন নয়। এমন কথা সমাজ এবং রাষ্ট্রের বিজ্ঞজনেরা প্রায়ই বলে থাকেন। কিন্তু আমরা এতটাই স্থবির হয়ে গেছি যে, ভালমন্দের পার্থক্যটাকে সবার সামনে তুলে ধরতে পারছি না। আজকাল কেন জানি মনে হয়, আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রের একটা অংশ এখন নীতিকথা শুনতে আগ্রহী নয়। কেউ নীতি কথা বলুক, এটাও পছন্দ করে না। লাভ-লোকসানের হিসেবে করে আমরা অনেকেই ভাবছি আগে নিজের লাভের অংশটাকে ঘরে তোলা যাক। তারপর অন্য কথা। অথচ একবারও ভাবছি না, আমরা কোন অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি। কোথায় আমাদের নৈতিক মূল্যবোধটুকু ভূলুন্ঠিত হচ্ছে, তারও খোঁজখবর রাখছি না। মুখে মুখে আমরা যতই বলি না কেন, বেশি ঝলমল করা জিনিস সোনা হয় না। কিন্তু বাস্তবটা হচ্ছে অন্যরকম। বাস্তবে আমরা ঘুরে ফিরছি ঝলমল করা নকল জিনিসের পেছনে। অনেকে মনে করে নগদ পেলেই বুঝি জীবনে সবকিছু পাওয়া হয়ে গেল। অথচ আমাদের ভাবনায় একবারও আসে না যে, নগদের ঠেলায় আমরা সবাই কেমন যেন রোবট মানুষ হয়ে যাচ্ছি। রক্ত-মাংসের মানুষ তখনই রোবট হয়ে যায়, যখন সে প্রকৃতির মানুষ থেকে দূরে সরে যায়। মানুষ যখন প্রকৃতির মানুষ থেকে যান্ত্রিক মানুষ হয়ে যায় তখন তার মাঝে সামাজিক দায়িত্ববোধ একেবাইে থাকে না। তখন সে আর মানুষকে নিয়ে ভাববার সময় পায় না। কারো ভিতর থেকে যখন মানবিক গুণাবলী একেবারে লোপ পেয়ে যায় তখনই সে আড়াই বৎসরের শিশুকে ধর্ষণ করতে দ্বিধাবোধ করে না।
আজ যদি আমরা দেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, আমাদের মধ্যে মানুষরূপী একধরনের নরপশু রয়েছে তাদের হাত থেকে শিশু থেকে কোন বয়সের নারীই রক্ষা পাচ্ছে না। এই শ্রেণীর মানুষরূপী নরপশুরা দেশের মধ্যে যেন ধর্ষণ, বখাটেপনা, ইত্যাদির তা-ব শুরু করেছে। একটা কোমলমতি শিশু আজ কোন কিছু বোঝার আগেই হারাচ্ছে তার মনের কোমলতা অর্থাৎ জীবনের সবকিছু। সজীব মনের মাঝে যখন কালো দাগের চিহ্ন পড়ে তখন সে বড় হয়েও তার মন থেকে সেই দাগের চিহ্ন মুছতে পারে না। আমাদের এই সমাজের মানুষ সম্পর্কে তার মনের মধ্যে একটা নেতিবাচক ধারণা জন্ম নিয়ে থাকে। একটা শিশু যখন অ, আ, ক, খ, শেখার আগেই সমাজের কিছু অমানুষ দ্বারা নির্যাতিত হয় তখন একথা বুঝে নিতে হবে যে আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থায় অসুস্থ মানুষের রাজত্ব চলছে। একথাও বুঝে নিতে হবে যে, একটা সমাজে যখন বিকৃত মনমানসিকতাসম্পন্ন মানুষের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায় তখন সে রাষ্ট্রও কোন না কোনভাবে বিকলাঙ্গতার দিকে এগোতে থাকে। সেই রাষ্ট ও তার মধ্যে বসবাসরত জনগণকে সুচারুরূপে নিরাপত্তা দিতে পারে না। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তার সামাজিক কাঠামোকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে রাখে। এখন বখাটেদের দৌরাত্ম্য এতটাই বেড়েছে যে, একজন পরিবারের কর্তা তার মেয়ে সন্তানকে স্কুল-কলেজে পাঠাতে সাহস পাচ্ছে না। বখাটেরা স্কুল-কলেজে গিয়েও মেয়েদের সাথে অশালীন আচরণ করছে। প্রায়ই দেখা যায়, কোন একটা মেয়ে বখাটে ডাকে সাড়া না দিলে প্রকাশ্যে তাকে রাস্তাঘাটে মারধর করা হচ্ছে। যদি কোন অভিভাবক তার প্রতিবাদ করতে যায় তখন এমনও দেখা যায়, সেই বখাটে তার দলবল নিয়ে আক্রান্ত মেয়েটির পরিবারের ওপর হামলা চালাচ্ছে। এমনও শোনা যায়, অসভ্য বখাটের সাথে তার পরিবারের লোকজনও ছুটে আসে তার বখাটে ছেলেকে রক্ষা করার জন্য। তখন আমরা ভদ্র লোকেরা সাময়িকভাবে বখাটেপনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করি ঠিকই। হয়ত মানববন্ধন, মিটিং-মিছিল কিছু দিন হয়। তারপর আমরা এক সময় সব ভুলে যাই। আমরা সব ভুলে যাই বলেই বখাটেরা এত ক্ষমতা ও সাহস দেখাতে পারে।
আজ আমাদের চারদিকের অসভ্যতার চিত্র এতটা ভয়াবহ হয়েছে যে, ঘরের বাইরে না গিয়ে ঘরের ভিতর দরজা লাগিয়ে বসে থাকাটাকেই অনেকে শ্রেয় মনে করে। আর একটা মেয়ে যখন নির্যাতিত হয়ে কোথাও বিচার পায় না এমনকি সমাজপতিরা উল্টো সব দোষ মেয়েটির ওপরই ফেলেন তাখন নির্যাতিত মেয়েটি আত্মহত্যা করে নিজেকে সব কলঙ্ক থেকে রক্ষা করতে বাধ্য হয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সংবাদে জানা গেছে, একটি স্কুলের ছাত্রী বখাটের দ্বারা ধর্ষিত হলে মেয়েটিকে প্রথমে নাকি স্কুলে যেতে দেয়া হয়নি। এমনকি শেষ পর্যন্ত তাকে স্কুলের পরীক্ষাতেও অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয়নি। আমরা মুখে মুখে বলে থাকি আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সর্বক্ষেত্রে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। এখন আমাদের রপ্তানি আয় বাড়ছে। আবার বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছে। আমরা মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হচ্ছি। কথাগুলো হয়তো মিথ্যে নয়। আমাদের অনেক ক্ষেত্রে উন্নয়নের ছোঁয়া অবশ্যই লেগেছে। কিন্তু সেই উন্নয়নের জোয়ারে যদি আমাদের মানবিক মূল্যবোধটুকু তলিয়ে কিংবা বিনষ্ট হয়ে যায় তাহলে আমাদের সব ক্ষেত্রের সচল উন্নয়নের ধারা একশ্রেণীর মানুষকে আনন্দের ঝর্ণাধারায় ভাসালেও দেশের দরিদ্র মানুষ থেকে যাবে চরম অন্ধকারে। বৈষয়িক উন্নয়নের সাথে সাথে যদি মানুষের মনের উন্নয়ন না ঘটে তাহলে আমাদের সকল উন্নয়নের প্রাপ্তি কেবল একশ্রেণীর মানুষই উপভোগ করবে। একজন মানুষ বলতেই পারে, রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের ধারা আমাদের ছেলেমেয়েদের ধর্ষণকারীদের কিংবা হত্যাকারীদের যদি আইনের আওতায় এনে আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে না পারে তাহলে সেই উন্নয়ন কি আমাদের সমাজের আসল উন্নয়ন, তখন মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ হবে না। দেশের সর্বোচ্চ পদে যারা আছেন তাদের একটা কথা বুঝতে হবে যে, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আড়াই বৎসরের একটি শিশু বিকৃত মনের অধিকারী মানুষ নামের কলঙ্ক নরপশুর দ্বারা ধর্ষিত হয় সেই সমাজ ব্যবস্থায় ভাল মানুষেরা ভাল থাকতে পারে না। তারা অসহায়ের মতো জীবনযাপন করে থাকে। চিন্তা করে দেখুন, একটা প্রতিবন্ধী মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলো কিংবা ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করা হলো, তারপর যদি তার পরিবার বিচার না পায় কিংবা ধর্ষণকারী-খুনী যদি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায় তখন ধর্ষিতা, হত্যাকা-ের শিকার মেয়েটির পরিবারের লোকজনের মনের অবস্থা কেমন হতে পারে। তার মধ্যে যদি মূল আসামীকে বাদ দিয়ে ঘটনাকে অন্যদিকে প্রবাহিত করার জন্য অন্য একজনকে আটক করে নির্যাতনের মাধ্যমে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি আদায় করার অভিযোগ পাওয়া হয় তাহলে মানুষের আইনকানুনের প্রতি কি বিশ্বাস থাকবে? সংবাদপত্রে এমন সংবাদ যখন আমরা পাঠ করি তখন আমরা বুঝে নিতে পারি, আমরা দেশবাসী কতটা ভাল আছি। আমাদের সমাজ সংসার কতটা ভয়াবহ অস্তিরতার মধ্যে আছে, তা-ও আমরা ধরে নিতে পারি। আমাদের কর্তাব্যক্তিরা যে এসব বুঝতে পারেন না তা আমরা বিশ্বাস করব কি করে? কর্তাব্যক্তিরা মনে করেন, তারা ভাল আছেন। তাদের ছেলেমেয়েরা নিরাপদে থেকে দেশের ভেতরের এবং বাইরের ভাল স্কুল-কলেজগুলোতে লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হচ্ছে। অনেকে মন্তব্য করে থাকেন, কর্তাব্যক্তিদের এসব মানুষের মতো মানুষ হওয়া ছেলেমেয়েরা অনেক সময় যেমন তাদের বাপ-মায়ের কোন কাজে আসে না, তেমনি করে আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রেরও কোন কাজে লাগে না। তারা হয়ে যায় বড় বড় মানুষের ড্রয়িং রুমের ফুলদানিতে সাজানো কাগজের ফুলের মতো নিষ্প্রাণ ও গন্ধহীন। তাই বলছিলাম, আমাদের সমাজে এই যে, শিশু ধর্ষণ কিংবা নারী হত্যা কিংবা অন্যান্য অব্যবস্থা চলছে তা কি এমনভাবে চলতে দেয়া যায়? সবাই বলবেন, চলতে দেয়া যায় না। সবকিছুর একটা সীমা আছে। দুর্বৃত্ত, ধর্ষণকারী, হত্যাকারী এবং দুর্নীতিবাজরা যেন আজ সকল সীমারেখা অতিক্রম করে যাচ্ছে। তাই আজ দায়িত্বরত কর্তাব্যক্তিসহ সমাজের সকল স্তরের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিঃশর্তভাবে এগিয়ে আসতে হবে সকল ধরনের অন্যায় প্রতিরোধের মন্ত্রে বলীয়ান হয়ে। আমরা চাই না, আমাদের এই দেশটা শিশু ধর্ষণকারী, নারী হত্যাকারী, খুনি এবং দুর্নীতিবাজদের নিরাপদ চারণভূমিতে পরিণত হোক।
লেখক: কবি, গল্পকার, আইনজীবী
কালীবাড়ী রোড, হবিগঞ্জ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন