মোহাম্মদ আবু নোমান : পুলিশের বদলি, প্রোমোশন, পোস্টিং মানেই বড় অংকের টাকার লেনদেন। একশ্রেণির পুলিশ যখন অনিয়ম, দুর্নীতি, চাঁদাবাজিসহ বহুবিধ অনাচারে জড়িত, ঠিক তখন সততা আর আদর্শের ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ফেনীর পুলিশ সুপার রেজাউল হক। কোনো অর্থ, উৎকোচ বা সুবিধা নিয়ে তিনি কাউকে পোস্টিং (পদায়ন) করেননি। ৪ জানুয়ারি পদোন্নতি পাওয়া ৪৮ এসআই ও এএসআইকে বিভিন্ন থানায় পোস্টিং দিয়েছেন প্রকাশ্য লটারির মাধ্যমে। এর আগেও শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তাকে এভাবে পদায়ন করেছেন তিনি। পদায়নে সন্তোষ প্রকাশ করে এক সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) বলেছেন, ‘স্যার ভালো মানুষ হওয়ায় আজ আমি সদরের একটি থানায় পোস্টিং পেয়েছি। কারণ, আমার টাকাও নেই, লবিং করার মতো মামা-খালুও নেই।’ উপস্থিত সাংবাদিকদের একজন বলেছেন, ‘ফেনীর এসপি সততার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। ইচ্ছে করলে পোস্টিং-বাণিজ্য করে অর্ধকোটি টাকা কামাতে পারতেন। ওনার মতো সারাদেশে আরও কিছু পুলিশ সুপার থাকলে পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে আসত।’
পদোন্নতিপ্রাপ্তদের উদ্দেশে ফেনীর পুলিশ সুপার রেজাউল হক বলেছেন, ‘পুলিশ হচ্ছে মানুষের আশ্রয়স্থল। একটা মানুষ বিপদে পড়লে পুলিশের কাছে আসে। আপনারা তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করবেন। পোস্টিংয়ের জন্য তদবির করাকে আমি পছন্দ করি না। আপনার কাজ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো রাখা। আপনার ওপর অর্পিত দায়িত্ব আপনি যথাযথভাবে পালন করুন, সেটি যেখান থেকেই হোক। বর্তমান সরকারের আমলে পুলিশ অনেক বেশি সুবিধা পেয়েছে। পুলিশ সদস্যরা পদোন্নতি পেয়েছেন। সে জন্য সরকারকে ধন্যবাদ। ফেনী জেলায় ২৪৬টি পদ সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে সাধারণ মানুষ আরও বেশি সেবা পাবে।’
মানুষ বিপদে পুলিশের কাছে যাবে, কিন্তু এখন ঘটছে উল্টো ঘটনা! পরিস্থিতি এমন যে, মানুষ পুলিশকেই ‘বিপদ’ মনে করে থাকে। পুলিশের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা অনেক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু কর্মকর্তা ও সদস্যের অতি বাড়াবাড়ি যেমন লক্ষণীয়, তেমনি তাদের একের পর এক অনৈতিক ও অপ্রীতিকর কর্মকা-ের কারণে গোটা বাহিনীকে বিতর্কের মুখে পড়তে হয়। ইতিপূর্বে নারায়ণগঞ্জের একটি উপনির্বাচনে এমপি শামীম ওসমানের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে এসআই বসিরউদ্দিন দায়িত্ব পালনে যে সাহসিকতা দেখান তা গোটা বাহিনীর জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। ঢাকার যানজটে স্কুলের শিশুদের ট্রাফিক পুলিশের হাত ধরে রাস্তা পার হওয়ার দৃশ্য অহরহ দেখা যায়। পুলিশ বাহিনীতে রেজাউল হক ও বসিরউদ্দিনের মতো কর্মকর্তা আর স্কুলগামী শিশুদের রাস্তা পার করে দেয়া ট্রাফিক সদস্যদের সংখ্যা বাড়ছে না কেন?
দেশে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় সাধারণ মানুষ বিপদে পড়লেও পুলিশের কাছে যেতে ভয় পায়। অনেক সময় তারা নির্যাতিত ও দুর্বলের পাশে না দাঁড়িয়ে চোর, ডাকাত থেকে শুরু করে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী, অপহরণকারীদের হাতকে শক্তিশালী করে। আমজনতার কথা বাদই দিলাম। ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবীদেরও পুলিশের হাতে নাজেহাল হতে হয়। অপরাধ দমন করা যাদের দায়িত্ব, তারা নিজেরাই যখন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে, তখন আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হবে কীভাবে?
থানায় সাধারণ ডায়েরি করতেও পুলিশকে টাকা দিতে হয়। সাধারণ মানুষ যখন নিরুপায় হয়ে পুলিশের কাছে আশ্রয় নেয়, তখন পুলিশ তাদের সহায়তায় এগিয়ে না এসে উল্টো হয়রানি করে, আইন, নীতি, নৈতিকতা তাদের কাছে কোনো গুরুত্ব পায় না। অনেক পুলিশ সদস্য বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার চেয়ে পকেট ভারী করতে ব্যস্ত।
ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীর ওপর পুলিশি নির্যাতন, সিটির পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র দাসকে পেটানো, আশা ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ফারহানা আক্তারকে তল্লাশির নামে ‘ইয়াবা’ ব্যবসায়ী বানানোর চেষ্টা ও অনৈতিক প্রস্তাব, চাঁদা না পেয়ে ফুটপাতের চা বিক্রেতা বাবুল মাতব্বরের কেরোসিনের চুলায় লাথি মারায় কেরোসিন ছিটকে বাবুলের গায়ে লেগে আগুন ধরে যাওয়া, সিদ্ধেশ্বরী থেকে ৫৪ ধারায় রুবেলকে আটক ও রিমান্ডের ভয়াবহ নির্যাতনে তার মৃত্যু হওয়া ইত্যাদি কারও ভুলে যাওয়ার কথা নয়।
পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে যখন চুরি, ডাকাতি, গ্রেফতার বাণিজ্য, ব্লাকমেইলিং, নারীর প্রতি অপ্রীতিকর আচরণ এবং তল্লাশির নামে ‘ইয়াবা অস্ত্র’ ব্যবহার করে পথচারীদের অর্থ লুটের অভিযোগ ওঠে, তা নাগরিকের জন্য দুর্ভাগ্যজনক, সরকারের জন্য বিব্রতকর। আবার পুলিশ কর্মকর্তা ও দু-চারজন পুলিশ সদস্যের অপকর্মের দায় গোটা বাহিনীর ওপর চাপিয়ে দেয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর প্রতি অবিচারের নামান্তর।
দুই.
লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার ফলকন উচ্চ বিদ্যালয়ে বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণে অর্থ আদায়ের অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় প্রধান শিক্ষক মো. জাকিরকে শোকজ করেছেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আহসান উল্যাহ চৌধুরী তিন কার্যদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছেন ওই শিক্ষককে। ১ জানুয়ারি ফলকন উচ্চ বিদ্যালয়ে বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে। সেশন ফি’র অজুহাত দেখিয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি ৬৮০ টাকা করে এ অর্থ আদায় করছেন প্রধান শিক্ষক। আর যেসব শিক্ষার্থী এ টাকা দিতে পারেনি ‘বই উৎসবের’ দিন তাদের হাতে ওঠেনি বিনামূল্যের বই। ২ জানুয়ারি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাসুদুর রহমান মোল্লা বিষয়টি নজরে এনে মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রধান শিক্ষককে কারণ দর্শানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আমাদের শিশু শিক্ষার্থীরা বছরের প্রথম দিনে খালি হাতে বিদ্যালয়ে গিয়ে নতুন বই নিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরবে, নতুন বই পেয়ে পড়াশোনায় আরো বেশি মনোযোগী হবে, অনুপ্রাণিত হবে এমনটাই প্রত্যাশা। এ জন্য ‘বই উৎসব’ এখন সকলের কাছে বড় উৎসবে পরিণত হয়েছে। বই পড়ার প্রতি শিশুদের আগ্রহ বাড়ানোর জন্যই এই আয়োজন। অথচ বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণে অর্থ আদায় ও খোলা বাজারে বিক্রির শিরোনাম প্রতিবছরই আমাদের চোখে পড়ে। কতিপয় শিক্ষক নামধারী অসৎ ও নীতি-নৈতিকতাহীন শিক্ষকের কারণে গোটা শিক্ষক সমাজকেই লজ্জিত হতে হয়।
শিক্ষক মো. জাকির ও তার মতো শিক্ষকদের ভুলে গেলে চলবে না, তারা জনগণের টাকায় গড়া স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। এখন তারা কর্মজীবী হিসেবে জনগণের টাকায় মাসিক বেতন-ভাতা নিচ্ছেন। তাই এখন তাদের নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করতে হবে। আজ শিক্ষকতাকে চ্যালেঞ্জিং পেশা ও জবাবদিহিতার মানদ-ে আনতে হবে। শিক্ষক নিজে মানুষ হিসেবে কতটা আদর্শবান ও ভালো তার ওপর নির্ভর করে শিক্ষার্থীরা ভালো মানুষ হয়ে উঠবে কিনা। নীতি-নৈতিকতাবোধ জাগ্রত না হলে কারও পক্ষে এ মহান পেশায় থাকা ঠিক নয়।
একজন সফল মানুষের পেছনে শিক্ষকের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। শিক্ষক শুধু সফল নয়, একজন ভালো মানুষ হতে শেখান। জ্ঞানতাপস বহু ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেনÑ ‘যার মধ্যে ইসলামের জ্ঞান নেই সে যত বড় শিক্ষিতই হোক না কেন; সে তো মূর্খ প-িত’। নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষক ও শিক্ষাই পারে একজন শিক্ষার্থীকে সঠিক ও সুন্দর পথ দেখাতে। এ জন্যই প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করতে হলে প্রকৃত খোদাভীরু, আদর্শ ও নৈতিকতাধারী শিক্ষকের বিকল্প নেই। আদর্শ শিক্ষকই জাতিকে উপহার দিতে পারে সৎ, যোগ্য, আদর্শ ও চরিত্রবান নাগরিক। শিশুদের মনুষ্যত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে হয় শিক্ষকদের। এ জন্য সকল স্তরের শিক্ষকদের অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়। শিক্ষাকে যুগে যুগে জাতির মেরুদ-, আবার কেউ কেউ বলছেন, ‘শিক্ষকরাই’ জাতির মেরুদ-। কথাটি যথার্থ, সময়োপযোগী ও ন্যায়সঙ্গত মনে হলেও প্রশ্ন থাকে, কোন শিক্ষক? অবশ্যই আদর্শ শিক্ষক।
আগে তো শিক্ষা এতটা বাণিজ্যিক ছিল না, শিক্ষকরা এত নীতিভ্রষ্ট ছিলেন না। তারাও অর্থকষ্টে ভূগতেন, তাই বলে কখনো অর্থলোভী হতেন না। তারা ছিলেন আদর্শ ও নীতিনৈতিকতার মূর্ত প্রতীক। তাদের পায়ে জুতা ছিল না; খালি পায়ে দীর্ঘ পথ হেঁটে স্কুলে আসতেন। তাদের ছিল শিক্ষায় উৎসাহ, উদ্দীপনা, একাগ্রতা, শেখানোর দৃঢ় প্রত্যয় ও প্রত্যাশা। শিক্ষকদের মননে আজ জ্ঞানার্জনের পরিবর্তে অর্থার্জনই বড়। সাধনা, জ্ঞানচর্চা, শিক্ষাদান সবই এখন অপ¯্রয়িমাণ। শিক্ষকদের লক্ষ্য হবে আদর্শ মানুষ তৈরি, আদর্শ নাগরিক তৈরি, লক্ষ্য হবে শিক্ষার্থীর দেহ, মন ও আত্মার পূর্ণ বিকাশ সাধন করা। তাই তাকে হতে হবে আর দশটি মানুষের তুলনায় সেরা। কথায় ও কাজে, পোশাক ও রুচিতে, পেশায় ও কর্তব্য পালনে শিক্ষক হবেন আদর্শবান, ধর্মপ্রাণ, সত্যপ্রিয় অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। শিক্ষক হবেন রোল মডেল বা আদর্শ, জ্ঞানের উৎস, আনন্দের ভান্ডার।
abunoman72@ymail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন