রোববার, ২৬ মে ২০২৪, ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৭ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

মহানগর

বাড়ছে পারিবারিক সহিংসতা চট্টগ্রাম নগরীতে এক বছরে ৯১ খুন

| প্রকাশের সময় : ১১ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

চট্টগ্রাম ব্যুরো : সাত বছরের শিশু ইয়াছিনের মুখ চেপে ধরে দেয়ালে মাথা থেতলে খুন করে তার মামা মোহাম্মদ জুয়েল (৪০)। মধ্যরাতে খুনের পর লাশ বাড়ির পাশে আবর্জনার নীচে লুকিয়ে রাখা হয়। ঘুম থেকে উঠে বাবা-মা হারা ইয়াছিনকে বিছানায় না পেয়ে খুঁজতে গিয়ে লাশ পান নানী।
চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহরের মধ্য রামপুরা ধোপাপাড়া এলাকায় গত বছরের ২১ নভেম্বর নির্মম হত্যাকাÐটি ঘটে। ইয়াছিন স্থানীয় আনন্দপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র ছিল। এতিম নাতিকে খুনের অভিযোগে পুত্র জুয়েলকে পুলিশে দেন রহিমা খাতুন।
অনাথ শিশু ইয়াছিনের মতো চট্টগ্রামে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে আরও অনেকে। পারিবারিক নিষ্ঠুর সহিংসতার প্রধান শিকার হচ্ছেন নারী ও শিশুরা। স্বামীর হাতে স্ত্রী, স্ত্রীর হাতে স্বামী, সন্তানের হাতে পিতা-মাতা, ছোট ভাইয়ের হাতে বড় ভাই, শ্যালকের হাতে দুলাভাই, বন্ধুর হাতে বন্ধু খুনের ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত।
পুলিশের হিসাবে গেল ২০১৬ সালে নগরীর ১৬টি থানা এলাকায় ৯১ জন খুন হয়েছে। এদের মধ্যে কতজন পারিবারিক সহিংসতার শিকার তার কোন পরিসংখ্যান পুলিশের কাছে নেই। তবে তাদের দাবি এদের বিরাট অংশ পারিবারিক সহিংসতার শিকার।
তার আগের বছরে নগরীতে ১০৫টি খুনের ঘটনা রেকর্ড হয়। গেল বছর আগের বছরের তুলনায় খুনের ঘটনা কমলেও পারিবারিক সংহিসতায় স্বজনের হাতে খুনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়, পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাওয়াই এর মূল কারণ বলে মনে করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
নগরীর আগ্রাবাদ মৌলভীপাড়ায় ৬ অক্টোবর খুন হন পোশাক শ্রমিক সোহানা আক্তার (২৯)। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে পোশাক কারখানায় যাওয়ার জন্য তৈরি হতেন সোহানা আক্তার ওই দিন সকাল সাতটা বেজে গেলেও মেয়েকে ঘুম থেকে উঠতে না দেখে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েন বাবা। ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া না পেয়ে ঘরে ঢুকে দেখেন মেয়ের শরীর নিথর। মুখ দিয়ে ঝরছে রক্ত।
সোহানাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। পিতার দাবি স্বামী পরিবহন শ্রমিক মো. রাজীব গলাটিপে হত্যার পর লাশ বিচানায় রেখে পালিয়ে গেছে। বিয়ের পর স্বামীকে নিয়ে নগরীর ডবলমুরিং থানার মৌলভীপাড়ায় বাবার বাড়িতেই থাকতেন সোহানা। এই ঘটনায় বাবা আবদুল কুদ্দুস বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন।
২৪ অক্টোবর রাতে নগরীর ইপিজেড এলাকায় দাম্পত্য কলহের জেরে স্ত্রী আশামনিকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করেন স্বামী খালেক শাহ। স্ত্রীকে হত্যার কথা তিনি স্বীকারও করেছেন পুলিশের কাছে। তাদের সাত বছর বয়সী একটি মেয়েও আছে। এর আগে ১৯ অক্টোবর নগরের পাহাড়তলী রেলওয়ে স্টাফ কোয়ার্টারের একটি ভাড়া বাসায় রোজিনা আক্তার নামের এক পোশাককর্মী খুন হন। এ ঘটনায় তার কথিত স্বামী রুবেলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ জানায় বিয়ের প্রলোবনে ওই তরুণীকে বাড়ি থেকে এনে স্বামী স্ত্রী পরিচয়ে ওই বাসায় উঠে রুবেল। বিয়ের জন্য চাপ দিতেই তাকে খুন করা হয়।
১০ অক্টোবর মাদকের টাকা না পেয়ে স্ত্রী মরিয়মকে পাথর ছুড়ে হত্যার অভিযোগে স্বামী মো. রুবেলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, মাদকের টাকা না পেয়ে স্ত্রীকে পাথর ছুড়ে হত্যা করেন রুবেল। তার আগে সীতাকুন্ডে কাভার্ডভ্যান চালক স্বামীকে শিল-পাটা দিয়ে মাথা থেতলে খুনের পর থানায় হাজির হন স্ত্রী। স্ত্রীর অভিযোগ মাদকাসক্ত স্বামী তার উপর নির্যাতন করেন। আর এ নির্যাতন থেকে বাঁচতে তিনি স্বামীকে খুন করেন।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর হাটহাজারী উপজেলার পশ্চিম মেখলের কাছিমার বটতলা এলাকায় বাবা মো. মুছাকে হত্যার অভিযোগে পুলিশ ছেলে মো. সারেককে (১৮) গ্রেফতার করে। দুই দিন পর ১৮ সেপ্টেম্বর নগরীর বারিক বিল্ডিং এলাকায় একটি ফ্ল্যাটে কুমকুম চৌধুরীর (৪২) খুন হন নিজের পুত্রের হাতে। তার ছোট ছেলে সুমিত নগরীর ব্যারিস্টার সুলতান আহমেদ চৌধুরী ডিগ্রি কলেজের ছাত্র। আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে সুমিত মাকে হত্যার কথা স্বীকার করেন।
১৭ অক্টোবর নগরীর টেরিবাজার এলাকার আফিনি গলির বাসা থেকে অঞ্জন ধরের লাশ উদ্ধার করা হয়। হাজারি গলির একটি সোনার দোকানের কারিগর ছিলেন তিনি। শ্যালক বাবলু ধরও একই দোকানে কাজ করতেন। বাবলু ধর তার বোনকে নির্যাতনের জন্য ভগ্নিপতিকে হত্যার কথা স্বীকার করে থানায় হাজির হন।
নগর পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, পারিবারিক কলহ বিরোধে ঘরের ভেতর খুনের ঘটনা ঘটছে। পুলিশের পক্ষে এসব বন্ধ করা সম্ভব না। এ জন্য পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বাড়ানো জরুরী। পারিবারিক কলহে খুনের ঘটনায় আসামিরা ধরা পড়ছে দ্রুত মামলায় তদন্তও শেষ হচ্ছে। তবে এ ধরনের অপরাধ বন্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরী বলে মনে করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং হতাশার কারণে পারিবারিক কলহ-বিরোধ বাড়ছে। তরুণদের সামনে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক আদর্শ নেই। প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষা থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছে। এগুলো সংস্কারে রাষ্ট্রকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনও সুদৃঢ় করতে হবে। বিকৃত মানসিকতা, মানসিক বিষণœতা, আত্মকেন্দ্রিকতার কারণে প্রিয়জনের হাতে প্রিয়জনের হত্যার ঘটনা বাড়ছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন