আহমেদ নূর : প্রায়ই পত্রিকায় যৌতুকের জন্য স্ত্রী খুনের সংবাদ চোখে পড়ে। মাঝে মাঝে একই দিন দেশের একাধিক স্থানে যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে খুন করার ঘটনাও ঘটে। বিগত ১৮ সেপ্টেম্বর যুগান্তরে প্রকাশিত এ রকম তিনটি ঘটনার শিরোনাম দেখুন : ‘যৌতুক দাবিতে স্বামী-শাশুড়ি মিলে তাহেরাকে পিটিয়ে হত্যা’ (পৃষ্ঠা-২); ‘যৌতুকের দাবিতে সাভারে স্ত্রী হত্যা : স্বামী আটক’ (পৃষ্ঠা-১৫) এবং ‘ফুলপুরে যৌতুকের জন্য প্রাণ গেল গৃহবধূর’ (পৃষ্ঠা-১৮)। শুধুমাত্র যৌতুকের জন্য এভাবে দেশে কত স্ত্রী নিহত হচ্ছে কেউ নিশ্চয়ই হিসাব রাখে না। কত মানুষ তার জীবনসঙ্গিনীর জীবন কেড়ে নিচ্ছে শুধুমাত্র যৌতুকের জন্য, তা ভাবার মতো কোনো দায়িত্বশীল মানুষ এদেশে আছে বলে মনে হয় না। যাহোক, এতদিন যৌতুক-লোভী অমানুষদের হাতে যৌতুকের শিকার হতে দেখতাম শুধু তাদের অভাগা স্ত্রীদের। কিন্তু এবার যে সংবাদ দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম তা হলো- ‘সখীপুরে যৌতুকের দাবিতে শাশুড়িকে পিটিয়ে হত্যা।’ মেয়ের বিয়ের যৌতুকের জন্য এখন শাশুড়িও খুন হতে শুরু করেছে! কোন সমাজে আমরা বাস করছি! কত নিচে নেমে গেছে আমাদের সমাজ!
যৌতুক আমাদের সমাজে বিয়ের একটি ‘মহাগুরুত্বপূর্ণ’ অংশ বলে যেন মনে করা হয়। তা না হলে যৌতুকের জন্য স্ত্রী বা শাশুড়িকে খুন দূরের কথা, যৌতুকজনিত কোনো অঘটন আমাদের সমাজে ঘটারই কথা নয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, যৌতুকের জন্য যারা তাদের স্ত্রীকে শুলিতে চড়ায়, তাদের বিয়ের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে যৌতুক; জীবনসঙ্গী পাওয়া বা বংশ বৃদ্ধি করা এদের বিয়ের কোনো উদ্দেশ্য নয়। বিয়ে হচ্ছে এদের কাছে অন্য কারো সম্পদে ভাগ বসানোর একটা উপায়। এরা হচ্ছে ডাকাত, যারা কারো কাছে টাকা চেয়ে না পেলে তাকে খুন করতে দ্বিধা করে না। এসব ডাকাত থেকে সমাজকে সুরক্ষার জন্য আমাদের দেশে কারো মাথাব্যথা নেই। নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত সবাই। নিরীহ মানুষরা যে এসব ডাকাতের খপ্পরে পড়ে অহরহ প্রাণ হারায়, কেউ নিজেকে এজন্য দায়ী মনে করছে না।
ঢাকা শহরের যানজট দূর করার জন্য নজরকাড়া সব ফ্লাইওভার নির্মিত হচ্ছে, পদ্মা নদীতে বহু কাক্সিক্ষত দীর্ঘ সেতু তৈরি হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনা রোধের জন্য দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোকে একাধিক লেনে উন্নীত করা হচ্ছে, দেশ দিন দিন ডিজিটাল হচ্ছে। কিন্তু যে মানুষদের জন্য এসব করা হচ্ছে তারা যে খুবই নাজুক জীবনযাপন করছে সেদিকে মনোযোগের বিশাল ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশে আইন, আদালত, বিচারব্যবস্থা সবই আছে তবু মানুষ এভাবে মরছে কেন? এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন সেদিন পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের চেয়ারপারসন ও মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল। সম্প্রতি নিজের মেয়েকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করতে গিয়ে দু’পা হারানো কৃষক শাহানুর বিশ্বাসকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘অপরাধীর শাস্তি দেয়ায় রাষ্ট্র দুর্বল।’
অপরাধীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্র যদি কঠোর হতো, দেশে অপরাধের সংখ্যা দিন দিন কমে যেত, সন্দেহ নেই। দেশে প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ খুন হচ্ছে কিন্তু মামলার দীর্ঘসূত্রিতা এবং আইনের নানা ফাঁক-ফোকর দিয়ে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। আছে ঘুষ আদান-প্রদানেরও অবারিত সুযোগ। তাই দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি না হওয়ায় দেশের অনেক মানুষ পশুতে পরিণত হচ্ছে। তুচ্ছ ঘটনার জন্যেও, সামান্য টাকার জন্যেও কাউকে খুন করতে মানুষ দ্বিধা করছে না।
আমাদের দেশের প্রকৃতি মানুষ বাসের জন্য বেশ উপযোগী এবং ভারসাম্যপূর্ণ হলেও আমরা অনেকেই জানি এদেশের অনেক মানুষ অন্য দেশে থাকার সুযোগ পেলে অন্য দেশে বাস করাকেই প্রাধান্য দেয় বেশি। অনেকেই এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিবারসহ বসবাস করেন, দেশে আসতে চান না। কেন? এখানকার মানুষ বেশ বর্বর, লোভী এবং অমানুষ বলে। দেশের প্রকৃতি জীবনবান্ধব হলেও মানুষগুলো জীবনবান্ধব নয়। পৃথিবীর অনেক দেশ আছে, যেখানে প্রকৃতি মানুষের জীবন-বিরুদ্ধ হলেও মানুষগুলো শান্ত বলে সেসব দেশের মানুষ নিজেদের দেশে বাস করাকে মোটেই অপছন্দ করে না। সুমন লাহিড়ী নামক নরওয়ে প্রবাসী একজন লেখক বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় সেদেশ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘নরওয়েতে ঠা-ার তীব্রতা এত বেশি, অনেক মানুষ পথ চলতে গিয়ে বরফে পিছলে পড়ে পা ভেঙ্গে ফেলে।’ আর ইতালীর অবস্থা এমন, সেখানে শীতকালে কখনো কখনো এত বেশি শীত পড়ে, মানুষ থুতু ফেললে তা মাটিতে পড়তে পড়তেই বরফ হয়ে যায়! তবু এসব দেশের মানুষ সভ্য-শান্ত বলেই সবাই বেশ শান্তিতে বসবাস করছে। কিন্তু এসব দেশের তুলনায় আমাদের দেশের প্রকৃতি খুবই জীবন-ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও মানুষগুলোর আচরণ হিং¯্র হবার কারণে এখানে মানুষের জীবনে শান্তি নেই। প্রতিদিনই এখানে একজন আরেকজনের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। এমন একদিন পাওয়া যাবে না, যেদিন পত্রিকায় খুন-খারাবীর সংবাদ নেই। এদেশের মানুষের নিকট মানুষ খুন একেবারেই সাধারণ ব্যাপার। যারা জাপান গিয়েছেন তারা জানেন, না গেলে জাপান-প্রবাসী কারো সাথে আলাপ করে জানতে পারবেন, জাপানীরা মানুষ খুনকে কত মারাত্মকভাবে ঘৃণা করে। সেখানে খুনের ঘটনা একেবারেই বিরল। বিষয়টা যাদের জানার উপায় নেই, তাদের জন্য ‘জাপান কাহিনি’ (দ্বিতীয় খ-; লেখক: আশির আহমেদ; প্রকাশনায় : ঐতিহ্য) নামক একটি বই থেকে এ সম্পর্কিত একটা লেখার অংশবিশেষ উল্লেখ করছি: ‘(জাপানে) ফাঁসির রায় হওয়া আর ফাঁসি কার্যকর হবার মাঝখানে বিরাট লম্বা সময় থাকে। কারো ১ বছর কারো ২০-৩০ বছর। ...গড়িমসিটা করেন কারা কর্তৃপক্ষ। কারা প্রধানরা নিজের আমলে এই অপ্রিয় কাজটা করতে চান না। জাপানের মাত্র ৭টি কারাগারে ফাঁসির মঞ্চ আছে। এই সব কারাগারে আসার পরপরই বদলির জন্য তদবির করতে থাকেন কারা প্রধানরা। ...জাপানে কেউ জল্লাদ হতে চান না। সুস্থ মস্তিষ্কে আরেকটা মানুষ খুন করার দায়িত্ব এড়াতে চান। সারা জীবন নাকি একটা প্রশ্ন জীবন্ত খোঁচাতে থাকবে “তুই খুনি, তুই মানুষ মেরেছিস, তুই মানুষ মেরেছিস, তুই খুনি”।’ [পৃ-৩৬-৩৮]
বইটি থেকে আরও জানা যায়, জাপানে ক্রাইমের সংখ্যা এমনিতেই কম। মৃত্যুদ- কার্যকরের সংখ্যা এক ডিজিটের কোটায়- ২০১৪ সালে ফাঁসি হয়েছে মাত্র ৩ জনের। একেকজন আসামীকে ফাঁসির জন্য জল্লাদ রাখা হয় ৫ জন। ৫ জন পাঁচটা বাটন টেপার পরই আসামীর ফাঁসি নিশ্চিত হয়। একজন লোকের মৃত্যুদ- কার্যকরের জন্য পাঁচজন লোক কেন? যাতে কেউই নিজেকে এজন্য এককভাবে দায়ী মনে না করে, সর্বোচ্চ ৫ ভাগের ১ ভাগ দায়ী মনে করতে পারে। একেকটি বাটন টেপার জন্য ফি হলো বিশ হাজার ইয়েন। এই অর্থও নাকি তারা নেন না, সরাসরি মন্দিরে দিয়ে দেন। [পৃ-৩৮]
জাপানে যেখানে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে একজন ফাঁসির আসামীর মৃত্যুদ- কার্যকর করার পারিশ্রমিকটাও মানুষ ভোগ করতে দ্বিধা করেন, সেখানে আমাদের দেশে বিয়ের মতো পবিত্র একটি সম্পর্কের পর আমরা শ্বশুরবাড়ির সামান্য সম্পদ লাভে ব্যর্থ হয়ে নিজের স্ত্রীকে বা শাশুড়িকে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করি না! মোগল স¤্রাট শাহজাহান নিজের স্ত্রীর নামকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তাজমহল নির্মাণ করেছেন, আর আমরা কাপুরুষরা সামান্য অর্থ-সম্পদের লোভে নিজের স্ত্রীর প্রাণ পর্যন্ত কেড়ে নিই! আমাদের এ ঘৃণ্য প্রবণতার বিরুদ্ধে এ রাষ্ট্র পরিচালকদের তেমন কথা বলতে শুনি না। দেশে যে প্রতিদিন অসংখ্য নারী যৌতুকের শিকার হচ্ছে, কখনো আমাদের কর্তাব্যক্তিদের এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখি না। শুধু রাস্তাঘাট, পুল-সেতু নির্মাণ করাই কি সরকারের কাজ? দেশকে শুধু ডিজিটাল করলেই হবে? মানুষের জীবনকে নিরাপদ রাখার দায়িত্বও অবশ্যই সরকারকে নিতে হবে।
আমাদের দেশের নারী নেত্রীরাও দেখি যৌতুকের ব্যাপারে তেমন সরব নয়। সমাজকে ধ্বংস করে ফেলছে যৌতুক, সেজন্য তাদের মাথাব্যথা তেমন দেখা যায় না। যৌতুকের জন্য নারীরা প্রতিনিয়ত খুন হচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে, নানারকম হেনস্থার শিকার হচ্ছে। কিন্তু তারা দেখেও না দেখার ভান করছেন। কেন? এর কোনো সদুত্তর নেই। মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর নির্ধারণের জন্য এসব নেত্রীকে দেখি বেশ তৎপর। অথচ এটা একটা অযৌক্তিক বিষয়। ১৮ বছর বয়সের আগেই নারীরা বিয়ের জন্য উপযুক্ত হয়ে যায়। সে জন্য জাপানে নারীর বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৬ বছর। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় সব রাজ্যেই ১৮ বয়সের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে কোর্ট বা তাদের অভিভাবকের সম্মতিতে হতে পারে। কোনো কোনো রাজ্যে এ বিয়ে সর্বনি¤œ ১২ বছরে হয়ে থাকে। এমনকি একটি রাজ্যে বিয়ের কোনো সর্বনি¤œ বয়সসীমা নেই! নারী বা পুরুষের বিয়ের ক্ষেত্রে এটাই হওয়া উচিত কোনো দেশের স্বাভাবিক নিয়ম। কারণ একজন অভিভাবক তার সন্তানকে কখন বিয়ে দেবে তা সম্পূর্ণ তার এখতিয়ারে থাকাটাই ব্যক্তিস্বাধীনতা। এখানে রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি হবার প্রশ্নও জড়িত নেই। তবু আমাদের নারী নেত্রীরা এ নিয়ে বেশ সোচ্চার। কিন্তু তাদেরই মতো অসংখ্য নারী যে প্রতিদিন যৌতুকের শিকার হচ্ছে তারা মনে হয় তা জানতেই পারেন না!
আমাদের পাঠ্যবইগুলোতেও যৌতুক সম্পর্কে তেমন কোনো গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা নেই। কোনো কোনো পাবলিক পরীক্ষায় মাঝে মাঝে দায়সারাভাবে যৌতুক প্রথা সম্পর্কে রচনা লিখতে বলা হয় শুধু। মানুষ খুনকে নিরুৎসাহিতকরণ সম্পর্কেও আমাদের পাঠ্যবইগুলো নিশ্চুপ। এটা, আমি মনে করি, যারা পাঠ্যবই প্রণয়ন করেন, আমাদের সমাজ সম্পর্কে তাদের অসচেতনতার পরিচায়ক।
লেখক: শিক্ষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন