নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে প্রেসিডেন্ট মো: আব্দুল হামিদের সঙ্গে আলোচনায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তরফে আইন প্রণয়ন ও ই-ভোটিংসহ প্রধান চার দফা এবং সব মিলে ১১ দফা প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ১৯ সদস্যের প্রতিনিধিদল গত বুধবার বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেয়। আওয়ামী লীগের প্রধান চার দফা প্রস্তাব হলো : ১. সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা ও অন্য কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন। ২. প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা ও অন্য কমিশনারদের নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট যা উপযুক্ত বিবেচনা করবেন সে প্রক্রিয়ায় তিনি নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন। ৩. প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা ও অন্য কমিশনারদের নিয়োগের লক্ষ্যে সম্ভব হলে এখনই একটি উপযুক্ত আইন প্রণয়ন অথবা অধ্যাদেশ জারি করা যেতে পারে। সময় স্বল্পতার কারণে ইসি পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে তা সম্ভব না হলে পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠনের সময় যেন এর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়, সংবিধানের নির্দেশনার আলোকে এখন থেকেই সেই উদ্যোগ গ্রহণ করা। ৪. অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বিরাজমান সব বিধিবিধানের সঙ্গে জনগণের ভোটাধিকার অধিকতর সুনিশ্চিত করার স্বার্থে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ই-ভোটিং চালু করা। প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, প্রেসিডেন্ট প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দানের সিদ্ধান্ত নেবেন। এ ক্ষেত্রে তিনি যেরূপ উপযুক্ত বিবেচনা করবেন সেই প্রক্রিয়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ প্রদান করবেন। এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের উদ্যোগের প্রতি আওয়ামী লীগের সার্বিক সমর্থন থাকবে। তিনি আরো বলেছেন, ভবিষ্যতে নির্বাচন নিয়ে কোনো বিতর্ক হোক, আওয়ামী লীগ তা চায় না। বিজ্ঞপ্তিতে প্রেসিডেন্টের বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট বলেছেন, নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অবাধ নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা খুবই জরুরি। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, সব রাজনৈতিক দলের সহযোগিতায় একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন সম্ভব।
শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্য নিয়ে প্রেসিডেন্ট বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার যে উদ্যোগ নিয়েছেন সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে এ যাবৎ বিএনপি ও আওয়ামী লীগসহ ২৩টি দলের সঙ্গে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব আলোচনা অত্যন্ত ইতিবাচক বলে প্রতিভাত হয়েছে। আগামী সপ্তাহে আরো কয়েকটি দলের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে বলে জানা গেছে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যে আলোচনা হয়েছে, তাতে অধিকাংশ দল সংবিধান নির্দেশিত নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে সে আইন প্রণয়ন সম্ভব হবে কি না সেটা একটা বড় প্রশ্ন। সেক্ষেত্রে অনুসন্ধান কমিটি গঠন ও তার মাধ্যমে আসা নামগুলোর মধ্য থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনারদের নিয়োগের পক্ষে অভিমত দেয়া হয়েছে। সঙ্গতকারণেই নিরপেক্ষ ও সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের বিকল্প নেই। বর্তমান নির্বাচন কমিশন বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে যে ব্যর্থতা, বিতর্ক, অক্ষমতা ও পক্ষপাতমূলক ভূমিকার পরিচয় দেয়, তা কারো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। সেই প্রেক্ষাপটে সব দলই এমন একটি নির্বাচন কমিশন চাইছে যে নির্বাচন কমিশন অবিতর্কিত ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম হবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও চায় না ভবিষ্যতে কোনো নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক উঠুক। প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার এ বিষয়টির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এ থেকে বোঝা যায়, প্রধানমন্ত্রীও চান আগামী নির্বাচন সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হোক। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, ই-ভোটিংয়ের প্রস্তাব কেবলমাত্র আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেই দেয়া হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট মো: আব্দুল হামিদ বরাবরই এ আশাবাদ ব্যক্ত করে আসছেন যে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তার এই আলোচনা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনে সহায়ক হবে। কার্যত একটি বিশাল দায়িত্ব তার ওপর অর্পিত হয়েছে। সব রাজনৈতিক দল তার ওপর গভীর আস্থা স্থাপন করেছে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে তার পূর্ণ সফলতা প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। যদি তিনি সফল হন, তাহলে বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কট মোচনে বড় ধরনের একটি অগ্রগতি হবে। শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠিত হলেও নির্বাচনকালীন সরকার ও তার ভূমিকার বহুল আলোচিত বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। সরকার নিরপেক্ষ না হলে এবং নির্বাচন কমিশনকে সার্বিক সহযোগিতা না দিলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা খুবই কঠিন। এমতাবস্থায়, শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের সঙ্গে নির্বাচনকালীন সরকার ও তার ভূমিকার বিষয়টিও বিবেচনায় আনতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে কাক্সিক্ষত নির্বাচন হতে পারে যদি নির্বাচনকালে সরকারের ভূমিকা নিরপেক্ষ ও তত্ত্বাবধায়কের হয়। এ সম্পর্কে ‘গণতন্ত্র ও নির্বাচন : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ শীর্ষক প্রস্তাবে নির্বাচনকালীন প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ নির্বাচন পরিচালনার জন্য আবশ্যকীয় সব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে ন্যস্ত ও নির্বাচনকালীন সরকারের কর্মপরিধি কেবল আবশ্যকীয় দৈনন্দিন কার্যাবলির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কথা বলা হয়েছে। এটি একটি ইতিবাচক বক্তব্য। তবে বাস্তবে তা কতটা কার্যকর হবে, সেটাই প্রশ্ন। এ নিয়ে রাজনেতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হতে পারে। আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে, তার ভূমিকা নিয়ে যে প্রশ্ন, সন্দেহ ও সংশয় রয়েছে তার অবসান ঘটতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন