মো. নুরুজ্জামান তালুকদার : নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হবে তা গণতন্ত্র চর্চাকারী সকল মানুষেরই প্রত্যাশা। অভিধানে হাজার হাজার বিশেষণ থাকতেও শুধু এই তিনটি বিশেষণই কেন নির্বাচনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে আছে তা বিবেচ্য ও প্রণিধানযোগ্য বিষয়।
ইংরেজি ঋধরৎ শব্দেরই বাংলা রূপ হচ্ছে সুষ্ঠু যা ন্যায্য বা বৃহত্তর পরিসরে আইনানুগভাবে দায়িত্ব পালন করা বুঝায়। নির্বাচন একটি বিশাল কর্মকা-, কিন্তু ধাপে ধাপে আইন ও বিধি-বিধান অনুসরণ করতে হয় এবং অবশ্যই তা অতি সতর্কভাবে। আমরা জানি, প্রধানত দুটি পক্ষ নির্বাচনে প্রাথমিকভাবে জড়িত হয়। প্রথম পক্ষ নির্বাচন কমিশনের আওতাধীন নির্বাচন পরিচালনাকারী এবং এইরূপ পরিচালনায় সহায়তাকারী কর্মকর্তা/কর্মচারীগণ। আর দ্বিতীয় পক্ষ সংশ্লিষ্ট নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীগণ এবং তাদের সমর্থকগণ। এই দুই পক্ষ যখন নির্বাচনের আইন ও বিধি-বিধানগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে মেনে চলবে তখন ঋধরৎ বা সুষ্ঠু নির্বাচনের শর্ত প্রায় শতভাগ পূরণ হবে। বিশেষ করে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীগণের জন্য প্রণীত নির্বাচন, আচরণ বিধিমালা প্রার্থীগণ কর্তৃক অনুসৃত হলে নির্বাচন পূর্ব পরিবেশ শান্তিপূর্ণ থাকে, ভোটারদের মনে আনন্দ বিরাজ করে এবং নির্বাচন পরিচালনাকারীদের গলদ্ঘর্ম হতে হয় না।
এবার আসি অবাধ শব্দটির বিষয়ে। অবাধ হচ্ছেন সম্মানিত ভোটারগণ, তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে কোনো বাধা দেওয়া যাবে না, প্রলোভন দেখানো যাবে না, লুঙ্গি, শাড়ি বা টাকা দিয়ে ভোট কেনা যাবে না, ভীতি প্রদর্শন করা যাবে না এবং বলা যাবে না যে, কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণি, পেশা, ধর্ম, বর্ণ বা লিঙ্গের ভোটার ভোটকেন্দ্রে না গেলেও প্রার্থী তার/তাদের ভোট পেয়েছেন। ভোটের দিনে প্রার্থীর নিজস্ব বা ভাড়া করা যানবাহনে ভোটারগণকে ভোটকেন্দ্রে আনা-নেয়ার ব্যাপারে যে কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে সেটিরও মূল উদ্দেশ্য ভোটারগণকে শেষ মুহূর্তে তাদের “অবাধ” সত্ত্বায় আপোসহীন রাখা। ভোটারগণ ছাড়া নির্বাচন কর্মকর্তা, প্রার্থী, এজেন্ট, নিরাপত্তা বাহিনী এবং নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে জড়িত অন্য কারো “অবাধ” হওয়ার বা এরূপ ভাবার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। পদে পদে এবং ধাপে ধাপে আইন মান্য করাই নির্বাচন পরিচালনা কর্তৃপক্ষের/কর্তৃপক্ষসমূহের দায়িত্ব।
নিরপেক্ষ শব্দটি বহুমাত্রিক, কখনও কখনও আপেক্ষিক এবং কেউ প্রমাণ চাইলে সহজভাবে প্রমাণ দেওয়া যায় না। নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে জড়িত সকলকেই নিরপেক্ষ থাকা অতি আবশ্যক। নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাখ্যার জন্য দুটি বিষয় সহজভাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। (ক) নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে জড়িত সকলেরই (মাননীয় নির্বাচন কমিশন ব্যতীত) পরিচয় বা এক নামে ডাকা হয় নির্বাচন কর্মকর্তা হিসাবে। সেখানে কোনো বিভাগ বা কোনো পদবি বিবেচ্য বিষয় নয়। (খ) নির্বাচন কর্মকর্তাগণ সংশ্লিষ্ট নির্বাচনের প্রার্থীদের পক্ষেও থাকবেন না এবং বিপক্ষেও থাকবেন না। কথায়, কাজে বা ইশারা-ঈঙ্গিতে এমন কিছু করা যাবে না যাতে করে নির্বাচনে বিন্দুমাত্র অন্যায্য প্রভাব বিস্তার হয়। প্রার্থীগণ নির্বাচন কর্মকতাগণকে সাধারণত সন্দেহের চোখে দেখে থাকেন। এ জন্য শুধু কাজে নয় কথাবার্তায়, ইশারা-ঈঙ্গিতেও সমূহ সাবধানতা অবলম্বন করতে হয় নির্বাচন কর্মকর্তাগণকে।
বেশি ওজনের কোনো সামগ্রী যদি একাধিক কাঁধে বহন করতে হয় তবে বহনকারীদের কাঁধের উচ্চতা মোটামুটি সমান হলে ভার সমানভাবে পড়বে এবং কাজটি করা সহজ হবে। কাঁধের উচ্চতা কম বেশি হলে বাহিত সামগ্রী দোল খাবে এবং বহনকারীগণ অস্বস্তিতে ও কষ্টে ভুগবেন। নির্বাচনের দায়িত্ব এক, একাধিক বা শত কাঁধে নয় বরং হাজার হাজার কাঁধে বহন/পালন করতে হয়। কাঁধ বদলানোর কোন সুযোগ নেই। যে যার দায়িত্ব পালন না করলে অথবা আংশিক পালন করলে লক্ষ্যে পৌঁছান খুব কঠিন। নির্বাচন ছোট কি বড় সেটি কথা নয়, মূল কথা হচ্ছে নির্বাচনটি সুন্দরভাবে অনুষ্ঠান করা গেল কিনা। শুধুমাত্র একজন ভোটারও যদি তার ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হন তবে গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়াকে নিখুঁত বলা যাবে না। আজকের দিনে মোটামুটি ভালো নির্বাচন জনগণ মানতে চাইবেন না, সম্পূর্ণ সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই কেবল মানুষের মন ভরবে। আসুন সবাই কাঁধ উঁচু করি, আগামীদিনের নির্বাচনের দায়িত্ব আক্ষরিক অর্থে যার কাঁধে যতখানি থাকার কথা ততখানি গ্রহণ করি। দয়া করে মাঝপথে কেউ কাঁধ সরিয়ে নেবেন না। যার যার দায়িত্ব তার তার মত করে পালন করলে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সবসময়ই সম্ভব।
লেখক : উপসচিব, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, ঢাকা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন