বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

সব ধর্মই সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের কথা বলে

| প্রকাশের সময় : ১৮ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ ওহীদুল আলম : কোনো কিছুকে ধারণ করে রাখে। যা আমাদের জীবনকে ধারণ করে রাখে তা-ই আমাদের ধর্ম। পৃথিবীতে সৃষ্ট প্রতিটি বস্তুরই ‘ধর্ম’ আছে। ইংরেজিতে যাকে প্রপার্টি বা কোয়ালিটি বলা হয় তাই বস্তুর ধর্ম। বিজ্ঞানীরা বস্তুর অন্তর্নিহিত গুণ বা ধর্মকে আবিষ্কার করেছেন। তারা বস্তুর এ ধর্মের মধ্যে আশ্চর্যরকম শৃঙ্খলার সন্ধান পেয়েছেন। এতে বস্তুর ধর্মকে তারা যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ পেয়েছেন। বস্তুর ধর্ম যদি নিরেট নির্ভেজাল ও সামঞ্জস্যপূর্ণ না হতো তাহলে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা অসম্ভব হয়ে পড়ত। বস্তুর ধর্মকে জানতে পেরেছেন বলেই উপযোগিতা সৃষ্টির মাধ্যমে বস্তুর ব্যবহার মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়েছে। বস্তুর ধর্মকে অনুসরণ করেই বস্তুর নানা উপযোগিতা সৃষ্টি হতে পেরেছে। বৈজ্ঞানিকরা সাধারণভাবে একে প্রাকৃতিক আইন নামে অভিহিত করেছেন। বলা হয়ে থাকে, বিজ্ঞান প্রকৃতিকে জয় করেছে। আসলে প্রকৃতিকে জয় করা যায় না। তাকে জানা যায়। প্রকৃতিকে জেনেই প্রকৃতিকে ব্যবহার করা যায়। পানির ধর্মকে জেনেই পানিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়। পানির ধর্মকে অগ্রাহ্য করে পানির উপযোগিতা উপভোগ করা সম্ভব নয়। আগুনের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। বস্তুর ধর্ম তথা প্রাকৃতিক আইনকে কাজে লাগিয়েই বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উন্নতি ঘটতে পেরেছে।
কিন্তু বস্তু স্বসৃষ্ট কোনো উপাদান নয়। এর নিয়মগুলোও বস্তু নিজে সৃষ্টি করেনি। বিশ্বাসী মানুষ মাত্রেই জানে, প্রকৃতির প্রতিটি বস্তু ও এগুলোর ধর্ম, নিয়মকানুন ও আইন সবই আল্লাহর সৃষ্টি। যাকে প্রাকৃতিক আইন বলা হয় তা আল্লাহরই আইন। যারা এ কথা মানে না তাদের এ না মানার স্বাধীনতা আল্লাহই দিয়েছেন। এর রহস্য হচ্ছে মানুষকে পরীক্ষা করা। বলেই দেয়া হয়েছে, একদিন মানুষের ভালোমন্দ সকল কাজের বিচার হবে। বিচারে শুধু দ- দেয়া হবে না পুরস্কারও দেয়া হবে। মানুষকে দুনিয়ার জীবনে স্বাধীনতা দেয়া না হলে আখিরাতে বিচারের কোনো যুক্তি থাকত না। বস্তুর স্বাধীনতা নেই। তাই বস্তুর কোনো বিচার হবে না। যেহেতু তার স্বাধীনতা নেই তাই সে নিজের ধর্ম (প্রপার্টি বা কোয়ালিটি) বদলাতে পারে না।
মানুষের স্বাধীনতা আছে। তাই সে যে কোনো ধর্ম গ্রহণ করতে পারে, পালন করতে কিংবা পালন নাও করতে পারে। এটা হচ্ছে সাধারণ নিয়ম। কিন্তু আল্লাহর অভিপ্রায় হচ্ছে, মানুষ আল্লাহর বিধান মেনে চলুক। তাহলেই তার জীবনে শৃঙ্খলা থাকবে। যেমন করে প্রকৃতি তার নিয়ম মেনে চলে বলেই প্রকৃতিতে শৃঙ্খলা আছে। মানুষ চায়, সূর্য নিয়মিত উদয় হোক ও অস্ত যাক, দিনের পর রাত্রি আসুক, মাটির উৎপাদন শক্তি বজায় থাক, আগুনের প্রজ্বলন শক্তি ও পানির তৃষ্ণা নিবারণ শক্তি বজায় থাক। উদ্ভিদের খাদ্যভা-ার অটুট থাকুক, চালু থাকুক তার অক্সিজেন উৎপাদনের প্রক্রিয়া। এক কথায় সে প্রকৃতির কাছ থেকে নির্ভেজাল আনুগত্য ও দায়িত্বশীলতাই কামনা করে। সে ভূমির উৎপাদনশীলতা চায় কিন্তু ভূমির প্রবল কম্পন চায় না, সে অগ্নির দাহিকা শক্তি চায় কিন্তু দাবানল চায় না। সে বায়ুর নির্মল প্রবাহ কামনা করে কিন্তু ঘূর্ণিঝড়, সিডর, সুনামি চায় না। সে চায় স্বাস্থ্যোজ্জ্বল জীবন, চায় না জীবনের মহামারী। তাহলে মানুষ কোন যুক্তিতে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে দায়িত্বশীল জীবনযাপন করবে না?
ধর্মের সাধারণ আবেদন হচ্ছে, মানুষ ¯্রষ্টার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবে ও একটি দায়িত্বশীল জীবনযাপন করবে। বলা বাহুল্য, একটি কেন্দ্রীয় শক্তির আনুগত্য ছাড়া মানুষ দায়িত্বশীল জীবনযাপন করতে পারে না। আল্লাহই সে কেন্দ্রীয় শক্তি। তিনি স্বাধীন ও সার্বভৌম। তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতা রাখেন। তিনিই জীবন দেন ও মৃত্যু ঘটান। তিনি রিজিকদাতাও। কারণ, যিনি জীবন দেন জীবন রক্ষার জন্য রসদ সরবরাহ করাও তাঁর ক্ষমতা ও দায়িত্বের আওতাধীন। যেমন একজন শিল্পপতি তার কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের বেতনের জোগান দেন। কিন্তু একজন শিল্পপতিও তার জীবন ও জীবিকার জন্য সৃষ্টিকর্তার মুখাপেক্ষী। এ সাধারণ বিশ্বাসেই মানুষ ধর্মীয় জীবনযাপন করে।
এ পৃথিবী কারো একার নয়। এখানে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী মানুষের বাস। আল্লাহ নিজেই বলেছেন, তার সৃষ্ট মানুষের মধ্যে যুগপৎ বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী রয়েছে। তেমনি রয়েছে ধার্মিক ও অধার্মিক মানুষ। মানুষের মাঝে ধর্মের বিভাজন ছাড়াও আরো অনেক বিভাজন আছে। আছে অনেক পার্থক্য। আছে জাতি গোত্র ও রঙের ভিন্নতা। এ বিভাজনের কারণে কোনো মানুষ অভাজন হয়ে যেতে পারে না। এ সবকিছুর মাঝেও রহস্য বিদ্যমান। অনেকে বলে থাকেন, ধর্ম মানুষের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে। সে হিসেবে রাজনীতিও তো মানুষকে বহু ভাগে বিভক্ত করেছে। প্রকৃত পক্ষে ধর্ম মানুষকে বিভক্ত করেনি বরং তাদের মাঝে ভক্তির উদ্রেক ঘটিয়েছে এবং মানুষকে সুনির্দিষ্ট পরিচিতি দিয়েছে। আল্লাহ মানুষকে বিভিন্ন জাতি গোত্রে বিভক্ত করেছেন, যাতে তারা পরস্পরের সাথে পরিচিত ও লেনদেনে শরিক হতে পারে। এর ফলে মানুষ নিজেদের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, জ্ঞান গরিমা, মেধা ও শ্রম পরস্পরের মাঝে বিনিময় করে নিজেদের অবস্থা ও অবস্থানকে আরো জোরালো ও টেকসই করতে পারে। ধর্মের দৃষ্টিতে মানুষে মানুষে সব পার্থক্য কিন্তু বাহ্যিক। মূলত মানুষের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। তাদের শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে একই হিমোগ্লোবিন। তারা একই আদি মাতাপিতার সন্তান। তাদের সকলের ¯্রষ্টা একজন। মানুষ সৃষ্টির উপাদানও একই। মাটি ও পানিই মানুষ সৃষ্টির প্রধান উপাদান। তাই সকল মানুষের অধিকার সমান। মানুষের মাঝে পার্থক্য শুধু কর্মদক্ষতায় ও চরিত্রে। যে মানুষ যত বেশি সৎকর্মশীল আল্লাহর কাছে সেই মানুষই তত বেশি মর্যাদাশীল।
এ দৃষ্টিকোণের ভিত্তিতেই মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক নিরূপণ করতে হবে। পৃথিবীতে ধর্মের অস্তিত্বের মতো ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের অস্তিত্ব বাস্তব সত্য। একইভাবে পৃথিবীতে অনেক ধর্মের অস্তিত্ব আছে। সেসব ধর্মের অনুসারীও কম-বেশি আছে। তাদের সবাইকে নিয়েই আবাদ আছে পৃথিবী। এ জন্যই পৃথিবী এত বৈচিত্র্যময়। এ বৈচিত্র্য রক্ষা করেই মানব জাতিকে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হবে।
প্রত্যেক ধর্মেই মানুষকে ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে। মানুষের জন্যই ধর্ম। ধর্ম পালন করতে হলে অবশ্যই মূল ধর্মগ্রন্থ পাঠ করতে হবে। জানতে হবে সংশ্লিষ্ট ধর্মপ্রচারকের জীবনী। ধর্মের কোনো নীতি বা নির্দেশ বুঝে না এলে যারা জানে তাদের কাছ থেকে তা জেনে নিতে হবে। কারণ, যারা জানে ও যারা জানে না তারা একে অন্যের সমান নয়। ধর্মের মর্মবাণী উপলব্ধির পথে অজ্ঞতা একটি বড় বাধা। অজ্ঞ মানুষ ধর্মের পক্ষ নিলে সে নিজের অজান্তে স্বীয় ধর্মেরই ক্ষতি করে। ধর্ম অনুসারী মানুষের ভুলের কারণেই অন্য মানুষ ধর্মবিরোধী হয়ে পড়ে। ধর্মের ফলিত রূপ যদি ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ইতিবাচক ফল বয়ে না আনে তা মানুষকে প্রভাবিত ও আকৃষ্ট করতে পারবে না। আপনার কাছ থেকে যদি অন্য মানুষ নিরাপদ থাকতে পারে তাহলে প্রমাণ হবে, আপনার ধর্মও অন্য মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারে। ধর্মের নিজস্ব কোনো হাত-পা নেই। এর রয়েছে কিছু মৌলিক বিশ্বাস ও নীতিমালা। ধর্ম অনুসারীরাই ধর্মের হাত-পা হয়ে কাজ করে। তাই বিশেষ কোনো মানুষের ভুল ধর্মের ভুল হতে পারে না। কেউ যদি কোনো অপরাধ করে তাকে অপরাধী হিসেবেই গণ্য করতে হবে। অপরাধীকে যদি তার ধর্মের পরিচয়ে চিহ্নিত করা হয় অবশ্যই তার বিচারে পক্ষপাত ঘটবে।
বিশ্বের সব বড় ধর্মেই সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের আশা ও আকাক্সক্ষা রয়েছে। কিন্তু এর অনুসারীরা কোনো কোনো সময় ধর্মের এ গৌরবময় অংশটুকু শনাক্ত করতে পারে না। ফলে তাদের পদস্খলন ঘটে। ধর্মবেত্তাদের দায়িত্ব হচ্ছে, মানুষকে পদস্খলন থেকে রক্ষা করা। কিন্তু উস্কানিমূলক রাজনীতি মানুষের মধ্যে বিভক্তিকে অনিবার্য করে তোলে তার আপন গোপন স্বার্থেই। মানুষ ক্রোধ ও হিংসাকে যদি স্বীয় সিদ্ধান্তের ভিত্তি করে নেয় তাহলে তার সে সিদ্ধান্ত ভুল হতে বাধ্য। তাতে সংঘাত অনিবার্য। ক্রোধকে দমন করা পৌরুষের লক্ষণ। এটা ধর্মেরও দাবি। আর হিংসা কোনো মানবিক গুণ নয়। আগুন যেভাবে কাঠকে পুড়িয়ে ফেলে হিংসাও সেভাবে মানুষের সকল সৎকাজকে পুড়িয়ে ফেলে। হিংসার শেষ পরিণতি তাই ছাই। ধর্ম মানুষকে সোনা হতে বলে, ছাই হতে বলে না। ছাইয়ের পরিণতি তাই ধর্মের অনুমোদন পায় না।
পৃথিবীতে প্রচলিত ধর্মগুলোর মধ্যে বিশ্বাস ও অনুশীলনের পার্থক্য রয়েছে। এ পার্থক্য আছে বলেই বিভিন্ন ধর্মের অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ধর্মের বিভিন্নতা সত্ত্বেও এগুলোর মধ্যে সাধারণ কতগুলো লক্ষণ ও বিষয় রয়েছে, যা সব ধর্মের মধ্যে একই রকম। উদাহরণস্বরূপ আমরা মিথ্যা ও প্রতারণার কথা বিবেচনা করতে পারি। কোনো ধর্মই মিথ্যাকে অবলম্বন ও প্রশ্রয় দেয়া অনুমোদন করে না। কোনো ধর্মই মানুষের সাথে প্রতারণা করতে বলে না। মিথ্যা ও প্রতারণার পক্ষে কোনো ধর্ম যদি তার অনুসারীকে ছাড়পত্র দেয় তাহলে সেটা ধর্মই হতে পারে না। এখন রইল সংঘাতের প্রশ্ন। কেউ আপনার ধর্মের অনুসারী নয় বলে আপনি তাকে ভিন্নধর্মী ভাবতে পারেন কিন্তু তাকে তার ধর্ম পরিত্যাগ করতে বাধ্য করতে পারেন না। জোর করে কাউকে কোনো ধর্মমতে দীক্ষিত করা যায় না। কারণ বিশ্বাস হচ্ছে, একান্তভাবে মনের ব্যাপার। ধর্ম শুধু নয়, যে কোনো মতবাদে বিশ্বাসের ব্যাপারেও মানুষকে বাধ্য করা যায় না। এটা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার সাথে সাংঘর্ষিক। আপনি মানুষের কাছে নিজের বিশ্বাসের কথা প্রচার করতে পারেন তা গ্রহণে কাউকে জোর করতে পারেন না। আর আপনি যদি সংঘাতে জড়ান আপনাকেও পাল্টা সংঘাতের ঝাপটা পোহাতে হবে। আপনি অন্যের শান্তি নষ্ট করলে আপনার নিজের শান্তিও বিনষ্ট হবে। আরেকজনকে তাড়া করতে গেলে নিজেকেও দৌড়াতে হয়। বুদ্ধিমান মানুষ কোনো সময়ই সে বোকামি করতে পারেন না। পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই শান্তিকামী, তারা সংঘাত চায় না। ধর্ম মানুষকে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলে, সংঘাত সৃষ্টির তাগিদ দেয় না।
প্রকৃতির মধ্যে সংঘাতের বদলে সহাবস্থানের প্রয়াসই মুখ্য। সহাবস্থানের পরিবর্তে সংঘাতের মনোভাব চাঙ্গা রাখা মূর্খতা। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় থাকলেই সহাবস্থানের পরিবেশ গড়ে উঠে। এ সম্প্রীতি বজায় রাখার দায়িত্ব প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মানুষের ওপরই বর্তায়।  
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক।
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন