মোঃ এনামুল হক খান : জীবনযাপনের জন্য শক্ত-মজবুত আবাস দরকার, আর এটা সকলেই চায় যেখানে নিশ্চিন্তে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করা যায়। এ চাওয়া ধনী-গরিব সকলের, যারা ভূমিহীন-টংঘরে বা বস্তিতে থাকে, তারাও আবাসটা মজবুত করতে চেষ্টা করে। এটা অতি প্রয়োজনীয়। নিরাপদ আবাস হলে মানসিক প্রশান্তি ও সুখনিদ্রা হয়। তাই এই আবাসস্থল সুন্দর ও স্বাস্থ্যসম্মত স্থানে হওয়া উত্তম।
গ্রামের মানুষ সঙ্গতি মোতাবেক আবাস বানায়। আর্থিক দিক বিবেচনায় তাদের অধিকাংশই নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত। যুগ যুগ ধরে এই সব পরিবারের বসতি গ্রামে। বেশি অর্থ খরচ করে বাড়ি বা আবাস বানাতে তাদের সাধ্য নেই। কিছু পরিবারের আবাস ছিল বাঁশের খুঁটি, টিনের ছাউনি-টিনের বেড়ার ঘরে। অধিকাংশের ছিল ছনের ছাউনির, বাতা বা চাটাইয়ের তৈরি ঘর। মানুষ ছন সংগ্রহ করত, এই ছন দিয়ে ঘর বানাত। আজ গ্রামের মানুষের সঙ্গতি কিছুটা বেড়েছে, ছনের ছাউনির ঘর আজ তেমন চোখে পড়ে না। অনেকে এখন টিনের ছাউনির ঘর, সেমিপাকা ইমারত বা পাকা ইমারত বানায়। মাঠে কাজ করে ফসল ফলানো, মাটি কাটা, রাস্তা বানানোর মতো কঠিন কাজের সাথে অনেকে জড়িত। যারা ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্য পেশায় নিয়োজিত তারাও পরিশ্রম করে। তবে গ্রামের অধিকাংশই কৃষিজীবী। তাদের প্রশিক্ষণ ও পড়াশোনা কম হওয়ার কারণে শ্রম মূল্যায়িত হয় না। দিন-রাত খেটে মরে কিন্তু আয় তেমন বাড়ে না। যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে এমনটা হচ্ছে। তবে এখন লেখাপড়া কিছুটা বেড়েছে বলে তাদের সচেতনতাও বাড়ছে। সন্তানের লেখাপড়ায় তারা মনোযোগী হচ্ছে। সংসার চালিয়ে যা সঞ্চয় করে তা দিয়ে মজবুত আবাস গড়তে চেষ্টা করে। আবার অনেকে ছেলেমেয়ের চাকরি বা ব্যবসার আয় থেকে আবাস বানায়। কিন্তু মজবুত আবাস তৈরিতে যথার্থ প্রশিক্ষণ বা ধারণা না থাকায় আবাস সে রকম মজবুত হয় না।
গ্রামের মানুষের পাকা-আধাপাকা ইমারত নির্মাণের ধারণা কম। রড-সিমেন্ট বা ইটের গাঁথুনির আবাস তৈরিতে তাদের অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। তাই ইচ্ছা থাকলেও সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধায় পড়ে। পরামর্শ নেয়, গ্রামের অনভিজ্ঞ রাজমিস্ত্রি ও রড-মিস্ত্রির সাথে, অভিজ্ঞ মিস্ত্রিরা গ্রামে থাকে না, ফলে অনভিজ্ঞদের পরামর্শ নেয়। তাদের বুদ্ধি ও চিন্তা মোতাবেক ইমারত বানিয়ে ফেলে, এটা ভুল সিদ্ধান্ত। মিস্ত্রিরা ইমারতের নকশা তৈরি, রডের ডিজাইন, সাইটের মাটির ভার বহন ক্ষমতা পরীক্ষা, ভূমিকম্পের প্রভাব, খরচের প্রাক্কলন তৈরি বিষয়গুলোতে অনভিজ্ঞ। এ বিষয়ে তাদের পড়াশোনার অভাব, প্রশিক্ষণের অভাব, তাই তারা ইমারত জ্ঞানে সমৃদ্ধ নয়। ভবন নির্মাণে রড ব্যবহারের পূর্বে তার মান যে পরীক্ষা প্রয়োজন তা তারা ভাবে না। ফলে ইমারত মজবুত হয় না। প্রকৌশলীর পরামর্শবিহীন বাড়ি নির্মাণ করা ঠিক নয়। একজন রোগীকে যেমন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হয়, অনুরূপভাবে ইমারত নির্মাণে প্রকৌশলীর পরামর্শ নেয়া উচিত। প্রকৌশলীগণ হলেন পরিবেশ উন্নয়নের ডাক্তার। স্বাস্থ্যসম্মত আবাস তৈরি, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, বর্জ্য পরিশোধন, স্যানিটেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিবেশ উন্নয়ন সবই প্রকৌশলীর ওপর নির্ভরশীল। তাই মূল আবাসটুকু যেন পরিকল্পনা মোতাবেক হয় এই সিদ্ধান্ত দরকার। কারণ টিনের বেড়া-টিনের ছাউনির ঘর নির্মাণে খরচ কম নয়। টিনের ঘর নির্মাণের জন্য যে পরিমাণ টিন ও কাঠ লাগে এর হিসাবও গ্রামের অনেকে করতে পারেন না। তারা মিস্ত্রির পরামর্শ নেন। টিনের ঘরে কাঠ বেশি লাগে, বর্তমান বাজারে ভালো কাঠের দাম অনেক। কম দামি কাঠ অল্প দিনে নষ্ট হয়, ঘুণে খায়, পচে যায়। এর সাথে নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। টিনের ঘরে চোর ডাকাত, সাপ, ইঁদুর, ব্যাঙ জাতীয় প্রাণীর যে ভয় থাকে ইমারত হলে সেই ভয় কমে যায়।
লক্ষ্য করা যায়, যাদের সন্তান লেখাপড়া শিখছে তারা চলে আসে নগর-বন্দরে। যোগ্যতা মোতাবেক চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত হয়। এক সময় দেখা যায়, গ্রামের বাড়িতে থাকার কোনো লোকই নেই, বাড়ি খালি থাকে। তাই বাসস্থান যেন শক্ত-মজবুত ও নিরাপদ হয় সেভাবে তৈরি করা উত্তম। আবাসটি হতে হবে মজবুত ভিতের ওপর পাকা, আধা পাকা বা বহুতল ভবন। দেশে জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে সেই বিবেচনায় বহুতল বাড়ি নির্মাণই যুক্তিযুক্ত। এ বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতা প্রয়োজন এবং দরকার প্রকৌশলীর পরামর্শ। প্রকৌশলীর পরামর্শ বা তদারকি না থাকলে অল্প সময়ের মধ্যে ইমারতে সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। যেমন : ইমারত নির্মাণের পর কয়েক বছরের মধ্যে ছাদের রড বেরিয়ে যাওয়া, আস্তর খসে পড়া, রডে মরিচা ধরা, দেয়ালে ফাটল ধরা ইত্যাদি। এই সমস্ত ভবন অল্প দিনের মধ্যেই বসবাস অযোগ্য হয়, ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পওয়ার জন্য ভেঙে ফেলার দরকার হয়, হয় অর্থের অপচয়।
আবাস নির্মাণে আলো-বাতাসের জন্য প্রয়োজনীয় দরজা-জানালার সংস্থান রাখা প্রয়োজন। থাকতে হবে মজবুত গেট, আরো থাকবে যাতায়াতের সু-ব্যবস্থা। যাতে মাঠের উৎপাদিত ফসল বাড়িতে আনা-নেওয়া করা সহজ হয়। সেই সাথে রিকশা, গাড়ি ও মানুষের চলাচলে সু-ব্যবস্থা থাকে। এ সমস্ত বিষয় নিশ্চিত করতে প্রতিবেশীর দিকেও নজর রাখতে হবে। যাতে তাদের কোনো সমস্য না হয়। আবাসের সাথে অবশ্যই থাকতে হবে বিশুদ্ধ পানি প্রাপ্তির ব্যবস্থা, সেপটিক ট্যাংক, সোকওয়েল ও পয়ঃপ্রণালীর সু-ব্যবস্থা। আবাসের সাথে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ স্থাপন প্রয়োজন। বিদ্যুৎ লাইন প্রাপ্তি সহজ না হলে বা সময় সাপেক্ষ হলে সৌর বিদ্যুতের সংস্থান করা যেতে পারে। আর গ্যাস লাইনের ব্যবস্থা না হলে সিলিন্ডার ব্যবস্থাই ভালো। তবে নির্মাণ কাজে ইট-সিমেন্ট-খোয়া মিশ্রণ, বালি-সিমেন্টের মিশ্রণ, গাঁথুনি, ঢালাই, আস্তর সবকিছুতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ রাজমিস্ত্রি-রডমিস্ত্রির প্রয়োজন। মিস্ত্রির গাফিলতির কারণে ইমারতে বড় ধরনের ত্রুটি থেকে যেতে পারে। ইমারতে ব্যবহৃত দরজা-জানালার কাঠ অবশ্যই সিজন করা ভালো মানের হওয়া চাই। দরজা-জানালা ও ইমারতের রংকরণ কাজটিতে ভালো মানের রং হলেও দরকার অভিজ্ঞ রং মিস্ত্রির। বিষয়গুলো ঠিক রাখতে প্রয়োজন প্রকৌশলীর তদারকি। মনে রাখতে হবে শক্ত-মজবুত আবাসটির চারপাশে যেন বেশ উন্মুক্ত স্থান থাকে। আবহাওয়া বিবেচনায় আবাসটি দক্ষিণমুখী হলে ভালো হয়। ইমারতের সামনে গড়ে তুলতে হবে ফুলের বাগান, তবে ইমারতটি হয়ে উঠবে নান্দনিক। বাড়ির পূর্ব পাশে পুকুর, শান বাঁধানো ঘাট। বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিমে থাকবে বিভিন্ন ফলের বাগান। আর সামনের খোলা জায়গায় শিশুরা খেলবে-দৌড়াবে, হাসি-আনন্দে থাকবে, তবেই তারা বেড়ে উঠবে সুস্থ-সবলভাবে। বড়দের উৎসাহ-উদ্দীপনায় ঘটবে মানসিক বিকাশ, আসবে তাদের মনে প্রশান্তি। যারা বয়স্ক-বৃদ্ধ তারাও থাকবে প্রাণবন্ত।
লেখক : প্রকৌশলী, বিশিষ্ট সংগঠক ও দক্ষিণ মুরাদনগর কল্যাণ সমিতি, ঢাকা-এর সাধারণ সম্পাদক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন