শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মহানগর

শিক্ষাবাণিজ্য ঠেকাতে মাঠে প্রশাসনের তদারকি দল

চট্টগ্রামে স্কুল ভর্তিতে অতিরিক্ত ফি আদায়, অভিভাবকরা জিম্মি

| প্রকাশের সময় : ২১ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর সরকারি নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে চট্টগ্রামের স্কুলগুলোতে অতিরিক্ত ভর্তি ফি নেয়া হচ্ছে। এতে করে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন অভিভাবকরা। 

সরকারি স্কুল বাদে অধিকাংশ বেসরকারি স্কুলগুলাতে ইচ্ছেমতো বেতনসহ আনুষঙ্গিক ফি নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোতে দ্বিগুণের বেশি ফি আদায় করা হচ্ছে।
উচ্চ বেতন-ফির কারণে স্বল্প আয়ের লোকজনের সন্তানরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে একপ্রকার জিম্মি অভিভাবকেরা এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও বাড়তি ফি দিয়েই ভর্তি করাতে হচ্ছে সন্তানদের।
শিক্ষা নিয়ে এমন বাণিজ্যের বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো সরব হয়ে ওঠায় মাঠে নেমেছে প্রশাসন। পাঁচজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছে ৫টি বিশেষ তদারকি দল। তারা ইতোমধ্যে নগরীর ১২টি স্কুল পরিদর্শন করে অতিরিক্ত ফি আদায়ের প্রমাণও পেয়েছেন।
এর আগে গত বছর অতিরিক্ত বেতন-ফি আদায়ের অভিযোগে অভিভাবকদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে ডেকে এনে ব্যাখ্যা চান জেলা প্রশাসক। তবে অতিরিক্ত বেতন-ফি আদায়ের ঘটনা তদারকি করতে এবারই প্রথম কমিটি গঠন করা হলো।
নতুন বছরের শুরু থেকে চট্টগ্রামে স্কুলে স্কুলে চলছে ভর্তি কার্যক্রম। নতুন শ্রেণিতে ভর্তি নিয়ে ব্যস্ত শিক্ষার্থী-অভিভাবকেরা। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও অভিযোগ, ভর্তিতে অতিরিক্ত ফি আদায়ের। এতে পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তি অর্থ নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন স্কুলে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে এ হার প্রায় দ্বিগুণ। ইচ্ছেমতো টাকা নেয়া হচ্ছে ছাড়পত্র দেয়ার ক্ষেত্রেও।
ভর্তি ফি নীতিমালায় মাধ্যমিকে তিন হাজার টাকা নেয়ার কথা থাকলেও স্কুলগুলোর বিরুদ্ধে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া পুনঃভর্তি ফি আদায় ও ছাড়পত্র নেয়ার সময় অভিভাবকদের কাছ থেকে পুরো বছরের বেতন নেয়ার অভিযোগও রয়েছে অনেক স্কুলের বিরুদ্ধে।
তবে ফি বেশি নেয়ার ব্যাপারে নানা যুক্তি দেখিয়ে স্কুলগুলোর দাবি, সরকারি নির্দেশনা মেনেই ভর্তি কার্যক্রম চালাচ্ছেন তারা। ভর্তিতে বাড়তি টাকা আদায় নিয়ে এরই মধ্যে সোচ্চার হয়ে উঠেছে বিভিন্ন সংগঠন। তাদের অভিযোগ, যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই মহানগরীতে বর্তমানে লোকসংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এই নগরীতে সরকারি স্কুলের সংখ্যা হাতেগোনা। ফলে সীমিত সংখ্যক শিক্ষার্থী সরকারি স্কুলে ভর্তির সুযোগ পায়। অন্যদের নির্ভর করতে হয় বেসরকারি স্কুলের ওপর। সরকারি স্কুলের স্বল্পতার সুযোগে নগরীতে ব্যাপক হারে বেসরকারি স্কুল-কলেজ গড়ে উঠেছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগের বিরুদ্ধে মানসম্মত শিক্ষাদানের বদলে শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে।
এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত বেতন-ফি আদায় করা হয়। নানা অজুহাতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়। সরকারি নিয়ন্ত্রণ শিথিল হওয়ায় শিক্ষাবাণিজ্য দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। সবচেয়ে বেশি বেতন-ফি আদায় করছে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলো। একটু ভালো মানের স্কুল মানেই অতিরিক্ত বেতন-ফিÑ এটা যেন এখন অনেকটা নিয়মে পরিণত হয়েছে।
এসব স্কুলে বেপরোয়া বেতন-ফি আদায়ের পেছনে কিছু ধনাঢ্য পরিবারের ভূমিকাকে দায়ী করছেন অনেকে। তাদের মতে, বেশি বেতন আর ফি দিয়ে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করানো কিছু মানুষের কাছে ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারা বেশি বেতনের স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করানোকে আভিজাত্যের অংশ মনে করেন। আর তাদের জন্যই কিছু স্কুল বেপরোয়া ফি আদায় করছে। এসব স্কুলে স্বল্প আয়ের লোকজনের সন্তানরা ভর্তি হওয়ার চিন্তাও করতে পারছে না।
বছরের শুরুতে প্রতিবারই স্কুলগুলোতে অতিরিক্ত বেতন ও ফি আদায় করা হয়। তবে এবার অতিরিক্ত হারে ফি আদায়ের অভিযোগ ওঠে। সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর পর অনেক স্কুলেও শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো হয়। আর এই অজুহাতে এবার অন্যবারের চেয়ে অতিরিক্ত হারে বেতন-ফি বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এবার বছরের শুরুতে স্কুলে স্কুলে অতিরিক্ত বেতন-ফি আদায়ের অভিযোগে তোলপাড় শুরু হয়। বিভিন্ন এলাকায় অভিভাবকেরা রাস্তায় নামে। তাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ক্যাবসহ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান।
অতিরিক্ত ভর্তি ফি আদায়সহ শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনায় নানা অনিয়ম বন্ধে নজরদারি বাড়ানোর দাবি ওঠে। আর তাতে নড়েচড়ে বসে জেলা প্রশাসনও। গঠন করা হয় ৫টি তদারকি দল। স্কুলে ভর্তিতে অতিরিক্ত ফি আদায়ের অভিযোগের প্রেক্ষাপটে ‘প্রকৃত চিত্র জানতে’ নগরীর স্কুলগুলোতে পরিদর্শন শুরু করে জেলা প্রশাসনের তদারকি দল।
বৃহস্পতিবার ৫টি দল নগরীর বারটি স্কুল সরেজমিন পরিদর্শন করে স্কুল কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের বক্তব্য গ্রহণ করে। সার্সন রোডে ইংরেজি মাধ্যমের চিটাগাং গ্রামার স্কুলে (সিজিএস) গিয়ে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিলুর রহমান ৬৩ হাজার টাকা ভর্তি ফি ও ১৯ হাজার টাকা মাসিক বেতন আদায়ের তথ্য পান।
তাহমিলুর রহমান জানান, অতিরিক্ত ভর্তি ফিসহ অন্যান্য ফির বিষয়ে তদারকির যে সিদ্ধান্ত জেলা প্রশাসন নিয়েছে তার ভিত্তিতেই আমরা কাজ করছি। নগরীকে পাঁচটি জোনে ভাগ করে মোট ৯৮টি স্কুলে এ তদারকির কাজ শুরু হয়েছে।
তাহমিলুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তদারকি দলটি চিটাগাং গ্রামার স্কুলে গিয়ে ভর্তি ফি, পুনঃভর্তি ফি, সেশন ফি, উন্নয়ন ফি এবং স্কুল পরিবর্তন (টিসি) ফি জানতে চায়। এর ভিত্তিতে বিভিন্ন শ্রেণিতে কি পরিমাণ ফি নেয়া হয় তার একটি তালিকা করে দেয় সিজিএস কর্তৃপক্ষ। সিজিএসের অধ্যক্ষ মাহিন খানসহ কর্মকর্তারা এসময় উপস্থিত ছিলেন।
সরকারি নীতিমালা অনুসারে ব্রিটিশ কারিকুলামে পরিচালিত বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এই ফি কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ সেটা মিলিয়ে দেখার পাশাপাশি পরবর্তীতে অভিভাবকদের কাছ থেকেও তথ্য নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিলুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তদারকি দলে ছিলেন জেলা শিক্ষা অফিসের সহকারী পরিদর্শক সাব্বির আহমেদ। তিনি জানান, জাতীয় শিক্ষাক্রমে পরিচালিত কোনো স্কুলে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা ভর্তি ফি নেওয়া যায়। ব্রিটিশ কারিকুলামের ক্ষেত্রে এই ফি কতটা হতে পারে, এ বিষয়ে সরকারি নীতিমালা কীÑ তা খোঁজ নিয়ে জানাতে পারব।
পর্যায়ক্রমে নগরীর প্রায় প্রতিটি স্কুলে গিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে কমিটি। যে স্কুলে অতিরিক্ত বেতন-ফি আদায় করা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এর আগে গত মঙ্গলবার বর্ধিত ফি আদায়ের অভিযোগের প্রেক্ষাপটে শতাধিক বেসরকারি স্কুলের প্রধানদের সঙ্গে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে এক বৈঠকের আয়োজন করে জেলা প্রশাসন।
ওই বৈঠকে বর্ধিত ফি নিয়ে ক্যাব অভিযোগ করলে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হোসনে আরা বলেন, ক্যাবের অভিযোগ আমি শুনব না। ক্যাব কারা? আমার কাছে কোনো অভিভাবক অভিযোগ নিয়ে আসেননি। ক্যাবের কোনো অভিযোগ আমি আমলে নেব না। আমার কাছে কোনো অভিভাবক অভিযোগ নিয়ে আসেনি।
এসময় ক্যাবের চট্টগ্রাম নগর সভাপতি এস এম নাজের হোসেইন সুনির্দিষ্ট স্কুলের বিরুদ্ধে বর্ধিত ফি নেয়ার একটি তালিকা প্রদান করেন। এস এম নাজের হোসেইন বলেন, স্কুলগুলোর ভর্তিতে বর্ধিত ফি নেয়া হচ্ছে কি না সেটা দেখার দায়িত্ব জেলা শিক্ষা অফিসের। তিনি সেটা তো করেনই না উল্টো গার্ডিয়ানদের যে অভিযোগ সেটাও তিনি স্বীকার করছেন না। জেলা শিক্ষা অফিসের মনিটরিংয়ের অভাবকেই তিনি ভর্তিবাণিজ্যের জন্য দায়ী করেন।
ওই সভায় চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান আগামী দশ দিনের মধ্যে স্কুলগুলোকে বর্ধিত ফি ফেরত দেয়ার নির্দেশনা দেন। ফেরত দিতে না পারলে বর্ধিত ফি, বেতন, পরীক্ষা ফির সাথে সমন্বয় করে নিতে বলেন তিনি। তবে জেলা প্রশাসনের ওই নির্দেশনার পর কোনো স্কুলে অতিরিক্ত বেতন-ফি ফেরত দেয়নি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন