প্রকাশ ঘোষ বিধান : ‘মাঘের শীত বাঘের গায়ে, শীতের জ্বালায় বাঘ কাঁপে’ আমাদের দেশের গ্রামবাংলার একটি প্রচলিত প্রবাদ। শক্তিশালী ভয়ঙ্কর দুর্ধর্ষ প্রাণীটি মাঘের শীতের প্রভাব থেকে রেহায়ই পায় না। তীব্র শীতে বাঘও কাবু হয়। কন কনে শীতে কাঁপছে প্রকৃতি, আর হাড় কাঁপানো শীতে জীবকুলের জুবথুব অবস্থা।
আমাদের বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ষড় ঋতুতে শীতের আগমন বৈচিত্র্যময়। ৬টি ঋতুতে ঋতুচক্র হয়েছে। প্রকৃতি, আবহাওয়া ও জলবায়ুর প্রভাবে বছরের ১২টি মাস ২ মাস করে ৬টি ঋতুতে ভাগ হয়েছে। এই ৬টি ঋতু হলো গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। তবে সব ঋতুর প্রাধান্য ও প্রভাব এক নয়। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত প্রত্যক্ষ আর শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত পরোক্ষভাবে প্রকৃতিতে প্রতিফলিত হয়। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত এ তিনটি ঋতু প্রকৃতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। জনজীবনে প্রচ- নাড়া দেয়। শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত জনজীবনে অনুভূত হয় তবে যেন তাদের আগমন নীরব-নিভৃতে। ঋতুচক্রে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ গ্রীষ্মকাল, আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল, ভাদ্র-আশ্বিন শরৎকাল, কার্তিক-অগ্রহায়ণ হেমন্তকাল, পৌষ-মাঘ শীতকাল ও ফাল্গুন-চৈত্র বসন্তকাল। গ্রীষ্ম, বর্ষার পর আসে শরৎ কিছুটা পরে তা মিশে যায় হেমন্তে। শীতের অবস্থান হেমন্তের পরে ও বসন্তের আগে। শীতকাল পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস হলেও এর শুরু কিছুটা আগে এবং শেষ হয় কিছুটা পরে। পৌষ-মাঘ এই ২ মাস নিয়েই শীতকাল। বাংলাদেশের ঋতুচক্রে অন্য ৫টি ঋতু থেকে শীতের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। শুষ্ক চেহারা আর হীমশীতল অনুভব নিয়ে আসে শীত। এ সময় গ্রামবাংলা যেন শীতের চাদর মুড়ি দেয়। ভোরবেলা ঘন কুয়াশার ধবল চাদরে ঢাকা থাকে। হীমেল হাওয়ায় হাড় কাঁপিয়ে শীত জেঁকে বসে। শীতের দাপটে প্রকৃতি নীরব হয়ে যায়। সবুজ প্রকৃতি রুক্ষ মূর্তি ধারণ করে। শীতের শুষ্কতায় অধিকাংশ গাছপালার পাতা ঝরে পড়তে থাকে। শীত তার চরম শুষ্কতার রূপ নিয়ে প্রকৃতির ওপর জেঁকে বসে। রুক্ষতা, তীক্ততা ও বিষদের প্রতিমূর্তি হয়ে শীত আসে। শীতে প্রকৃতি বিবর্ণ হয়ে পড়ে।
শীতের সকাল কনকনে ঠা-া আর ঘন কুয়াশায় ঢাকা থাকে। মনে হয় সব কিছু জড়োসড়ো হয়ে আসে, সামনের কোনো কিছু ঠিকমত দেখা যায় না, সব কিছুই অস্পষ্ট মনে হয়। কখনও কখনও কুয়াশার স্তর এত ঘন থাকে যে, দেখলে মনে হয় সামনে কুয়াশার পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। অনেক দেরিতে ওঠে সূর্য। প্রকৃতির ওপর সূর্যের নির্মল আলো ছড়িয়ে পড়ে। দেখে মনে হয়, সূর্যের আলোতে কোনো তেজ নেই। সকাল বেলায় পুকুরের পানি বরফ জমা ঠা-ার মতো মনে হয়। আর তার উপর থেকে হালকা ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। সকালে গোসল করতে গিয়ে পানিতে নামা নিয়ে শিশু-বৃদ্ধরা কাঁপাকাঁপি শুরু করে দেয়। পুকুরের পানিতে নামতেই লাগে অনেক সময়। কোনো রকম একটা ডুব দিয়ে উপরে উঠে কাপড় বদলানো, তারপর উষ্ণ গরম পেতে রৌদ্রে গিয়ে দাঁড়ানো। এ প্রতিদিনের গ্রামবাংলার শীতকালে গোসল করার চিত্র। গভীর রাত থেকে গাছের পাতায় শিশির বিন্দু জমতে থাকে। আর ভোর রাতে শিশির কণা বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টির মতো ঝরতে থাকে। টিনের চালে, ঘরের চালে, পাতার উপর টুপটাপ বৃষ্টির মতো পড়তে থাকে। সকালে মাঠে মাঠে ঘাসের ডোগায় বিন্দু বিন্দু জমে থাকা শিশিরে রোদের আলোয় ঝিকমিক করে। ধানের ক্ষেত, শাকসবজির উপর টলমল করা শিশির বিন্দু সূর্যের সোনালি রশ্মিতে মুক্তার মতো ঝলমল করে। এ সময় গ্রামের ক্ষেতে-ক্ষেতে ধান কাটা শুরু হয়। বাতাসে নতুন ধানের গন্ধ ভেসে বেড়ায়। শীতে এ সময় শহর-গ্রামের সবখানে চলে নবান্ন উৎসব। শীতের সকালে খেজুরের মিষ্টি রস সবার মন কাড়ে। গাছিরা কলস ভরে রস নিয়ে আসে। খেজুরের কাঁচা রস রৌদ্রে বসে খাওয়াটাই যেন একটা আলাদা স্বাদ। খেজুর রসের পায়েস আর নলেন গুড়ের কথা ভাবলে জিহ্বায় পানি এসে যায়। শীতকালে সর্বত্র নানা ধরনের পিঠা তৈরি হয়। গ্রামে গ্রামে রঙ-বেরঙের পিঠা, ক্ষীর, পায়েস খাওয়ার ধুম। বাড়ি বাড়ি পিঠা-পুলি তৈরি হয়। রসের পিঠা, তেলে পিঠা, পাটি শাপটা, ভাপা পিঠাসহ বিভিন্ন সাচে তৈরি নানা রকমের পিঠা যা দেখলে সকলের মন কাড়ে। এ সময় বিভিন্ন সংগঠন থেকে শুরু হয় রকমারি পিঠা উৎসব। তাছাড়া খেজুর রসের তৈরি পায়েস আর নানা ধরনের পিঠা নিয়ে পৌষ সংক্রান্তির উৎসব জমে ওঠে। বাড়ি বাড়ি ছাড়াও সন্ধ্যায় হাটবাজারের আতপ চালের গুড়ো, নলেন গুড় ও নারিকেল কোরা দিয়ে তৈরি গরম ভাপাপিঠা ও পাটিসাপটা খেতে ভারী মজা লাগে। অন্যকে খেতে দেখলে নিজের অজান্তেই জিহ্বায় পানি এসে যাবে।
শীতকালে পাকা ধানের সোনালি ক্ষেতের দৃশ্য দেখে চোখ ফেরানো যায় না। পাকা ধান কেটে ঘরে তোলার পর পরই কৃষকরা আবার বোরো আবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে কৃষক লাঙল, জোয়াল কাঁধে গরু নিয়ে মাঠে চলে। যদিও এ দৃশ্য আজকাল খুব একটা চোখে পড়ে না, তার পরও কিছু কিছু এলাকায় গরুর লাঙল দিয়ে চাষাবাদ হচ্ছে। সারা দিনই কৃষক চাষাবাদে ব্যস্ত সময় পার করে। কৃষকরা বোরো বীজতলা, সদ্যরোপা বোরো আবাদ রক্ষা করতে সকাল বিকাল পানি পরিবর্তন করে শীতের হাত থেকে ক্ষেত রক্ষা করতে পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকে। শীতকালের শাকসবজিতে ক্ষেত ভরে যায়। লালশাক, পালনশাক, শিম, বরবটি, লাউ, টমেটো, গাজর, শালগম, মুলাসহ বিভিন্ন প্রকার সবজি শোভাবর্ধন করে। যা আমাদের খাবার হিসেবে আকৃষ্ট করে। সরিষা ফুলের হলুদ ক্ষেত আর মৌমাছির গুঞ্জনের দৃশ্য না দেখলে এ দৃশ্য বোঝানো যাবে না। আর শীতকালের রঙ-বেরঙের ফুল গাদা, ডালিয়া, সূর্যমুখী, গোলাপ প্রভৃতি শোভাবর্ধন করে। ফুলের দোকানগুলো বাহারি ফুলে ভরে যায়। এ সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি বরণ করতে ফুলের দোকানগুলোতে বিভিন্ন রকম ফুলের ডালি, তোড়া ও মালাসহ সু-সজ্জিত বিভিন্ন ফুলের উপকরণ বিক্রির হিড়িক পড়ে যায়।
গ্রাম এলাকার শীতের সকাল ও বিকাল বড়ই চমৎকার। শীতের দীর্ঘ রজনি কম্বল, লেপ, কাথা মুড়ি দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে রাত কাটে। সকালে উঠে সূর্য উঠা অপেক্ষায় সবাই উশখুশ করতে থাকে। চায়ের দোকানগুলোতে চা পানের ধুম পড়ে যায়। সকালের মিষ্টি রোদে ছেলেমেয়েরা চিড়া-মুড়ি, খেজুরের পাটালি গুড় খেতে খেতে রোদ পোহাতে থাকে। শীতের দিনের বেলা ছোট হওয়ায় বেলা মাথার উপর আসতে আসতে যেন সন্ধ্যা হয়ে যায়। এ সময় শীতের দাপট থেকে বাঁচতে সবাই শীতবস্ত জ্যাকেট, জাম্পার, ছুয়েটার, মাফলার, কোটসহ রঙ-বেরঙের বাহারি পোশাক পরিধান করে। সাজ পোশাকে আসে নানা বৈচিত্র্য। বাহারি এসব পোশাক দেখে চোখ জুড়ায়। শীতের প্রকৃতি যেন ঝিমিয়ে পড়ে। হাড় কাঁপানো শীতের দাপটে অনেক অস্বস্তির অনুভূতির মধ্যে একটি হলো ঠোঁট ও পা ফেটে যাওয়া। শীত থেকে রক্ষা পেতে নানা প্রসাধনীর কদর বেড়ে যায়।
শীতকালে অতিথি পাখির আগমন এক অন্যরকম রোমাঞ্চকর আকর্ষণ। পরিযায়ী পাখিরা বিভিন্ন শীতপ্রধান দেশ থেকে এসে আমাদের দেশের হাওর-বাঁওড় ও জলাশয়ে আশ্রয় নেয়। নানা রঙ-বেরঙের পাখি দেখে মন ভরে যায় আর কলকাকুলিতে এলাকা মুখরিত হয়। তবে এরমধ্যে কিছু দুষ্টু ব্যক্তিরা চুরি করে পাখি শিকার করে। যা আমাদের জন্য খুবই কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শীতের অনুকূল আবহাওয়ায় দেশি-বিদেশি ভ্রমন বিলাসী পর্যটকের আগমন ঘটে। বিদেশি পর্যটকদের আগমনে আমাদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয় বেড়ে যায়। এতে অর্থনৈতিক খাত সমৃদ্ধ হয়। দেশের দর্শনীয় স্থান ও পিকনিক স্পটগুলোতে ভ্রমণকারীদের ঢল নামে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শিক্ষা সফর শুরু হয়। তাছাড়া গ্রামের হাটবাজার উন্মুক্ত স্থানসহ সর্বত্র পিকনিকের আয়োজন বেড়ে যায়।
গ্রামের শীতের সকাল কনকনে ঠা-া আর ঘন কুয়াশা নিত্য-নৈমত্তিক ঘটনা। শীতের মধ্যে মাঝে মাঝে শুরু হয় শৈত প্রবাহ। আর এ সময় তাপমাত্রা খুব নিচে নেমে যায়। হাড় কাঁপানো শীতে মানুষ, জীবজন্তুর সাথে সাথে প্রকৃতি যেন অসড় হয়ে পড়ে। শীতের হাত থেকে বাঁচতে মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। এ সময় শীতবস্ত্র কেনার ধুম পড়ে যায়। যে যার সাধ্যমত গরম কাপড় ক্রয় করে নিজেকে শীত থেকে সুরক্ষা করার চেষ্টা করে। শীতের সকাল ও রাতে ছিন্নমূল মানুষ আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারনের চেষ্টা করে। শীতের সকালে শহর-গ্রামে আগুনের কু-ল তৈরি করে উত্তাপ নিতে দেখা যায় শিশু-বৃদ্ধসহ সব বয়সী মানুষের। এ আগুন জ্বালিয়ে উত্তাপ নেয়ার মধ্যে রয়েছে এক আলাদা এক অনুভূতি। ভবঘুরেরা হাটবাজার, স্কুল-কলেজের বারান্দায় আশ্রয় খোঁজে। এ সময় সরকার, দানশীল ব্যক্তি ও বিভিন্ন সংগঠন দুস্থ-গরিবদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করে থাকে। শীতের কনকনে ঠা-ায় বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা শীতজনিত জ্বর, সর্দিকাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। এ সময় হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। শীতে নিবৃত্ত ও গরিব মানুষের জীবনে দুর্যোগ হয়ে দেখা দেয়। তারা এ সময় অনেকটা মানবেতর জীবনযাপন করে।
শীত আমাদের জীবনে যেমন সুখ-শান্তি বয়ে আনে, তেমনি দুঃখ-কষ্টও বয়ে আনে। শীত আমাদের জীবনকে করেছে বৈচিত্র্যময়। কবি সুকান্ত ভট্টচার্যের কাছে শীত দুঃখের বার্তা নিয়ে এসেছে। দরিদ্র মানুষের কাছে শীতের ভয়াবহতা কবিকে চিন্তিত করেছে। তাই নিম্নবর্গের মানুষের জন্য সূর্যের কাছে তার প্রত্যাশা, সূর্য যেন শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাদের উত্তাপ দেয়। কবি সুকান্তের ভাষায়-
সূর্য
তুমি আমাদের স্যাঁত স্যাঁতে ভিজে ঘরে
উত্তাপ আর আলো দিও,
আর উত্তাপ দিও
রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে।
লেখক : সাংবাদিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন