মোহাম্মদ আবদুল বাসেত : মানব সৃষ্টির পেছনে স্রষ্টার অন্যতম উদ্দেশ্যই হলো তারা পৃথিবীকে আবাদযোগ্য করবে। পারস্পরিক হিতাকাক্সক্ষী, শুভাকাক্সক্ষী এবং জগতের জন্যও তারা হবে কল্যাণকামী। কিন্তু ঘটছে তার ব্যতিক্রম। এর অন্যতম কারণ হলো মানব সৃষ্টির পেছনে ¯্রষ্টার উদ্দেশ্যের সাথে মানবের উদ্দেশ্য এক করতে না পারা। ফলে কল্যাণকামী না হয়ে এক মানব হচ্ছে অন্য মানবের শত্রু। হারিয়ে ফেলেছে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস। এক মানব অন্য মানবকে সম্পদরূপে না দেখে দেখতে শুরু করেছে অভিসম্পাতরূপে। পৃথিবীর অনেক দেশেই মানব সম্পদের অভাবে ভুগছে। আবার অধিক মানবের ভারে হিমশিমে খাচ্ছে অনেক দেশ। তাদের কাছে মানব এখন সম্পদ নয়, অভিসম্পাত। মানব আসলেই কি অভিসম্পাত? কত নিন্দনীয় ও সঙ্কীর্ণ চিন্তা। সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হওয়া সত্ত্বেও কিভাবে এক মানব অন্য মানবকে অভিসম্পাতরূপে দেখতে পারে।
ছোট্ট উদাহরণে বিষয়টি অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে। দক্ষ পরিচালনায় পরিবারের একাধিক সন্তানও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আবার অদক্ষ পরিচালনায় পরিবারের একটি সন্তানকেও প্রতিষ্ঠিত করা অসম্ভব হতে পারে। একটি দেশের মোট জনসংখ্যার অবস্থাও এরকমই। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে। দেশের মোট জনসংখ্যার কত অংশ দেশ গঠনে ভূমিকা রাখছে? দেশ গঠনে অবদান বলতে বুঝায়, দেশের উন্নয়নে ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সকল উন্নয়নশীল কাজে অংশগ্রহণ। বিশেষত আমাদের দেশের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায় অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিতরাই দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছে বেশি। কেননা আমাদের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ শিক্ষিত হলেও শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি। অথচ শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্যই হলো দেশ গঠন বা দেশের উন্নয়নে অংশগ্রহণ। সহজ অর্থে অনেকেই মনে করে থাকে- শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো ভালো চাকরি করা। এ সাধারণ অর্থটি ধরে নেওয়া হলেও বিষয়টা কতই না স্পষ্ট যে, শিক্ষিত লোকেরাও পারছে না দেশের উন্নয়নে অংশগ্রহণ করতে।
প্রযুক্তি ক্ষেত্রেও কাক্সিক্ষত কর্মসংস্থান না থাকায় হতাশাগ্রস্ত হচ্ছে কারিগরি শিক্ষার্থীরা। ফলে এটি এখন প্রমাণিত, শিক্ষা আমাদের মূল সমস্যা নয়, শিক্ষাপযোগী কর্মসংস্থান ও উদ্যোগের অভাবই প্রধান সমস্যা। আরো নেতিবাচক দিক হচ্ছে, এক বিভাগে পড়ুয়া শিক্ষার্থী কাজ করছে অন্য বিভাগে। এতে যেমনি হয় মেধার অপচয় তেমনি সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রও হয় দুর্বল। যে সমস্ত দেশ উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছে তাদের সফলতার পর্যালোচনায় প্রথমেই উঠে আসে, তরুণদের কাজে লাগানোর অনুপাত সেখানে বেশি।
শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকদের মাঝে শিক্ষা শেষ হলেই চাকরি খোঁজার প্রবণতা অত্যধিক। অথচ অনেক শিক্ষার্থীই বুঝতে রাজি নয় যে, যে প্রতিষ্ঠানের মালিকের কাছে সে চাকরিপ্রার্থী হচ্ছে- তিনিও যদি আজীবন চাকরির উপর নির্ভর করতেন তাহলে এ প্রতিষ্ঠান হতো না। এটিও সত্য, উদ্যোক্তা এক-দুই দিনে হয় না। দীর্ঘ চেষ্টা-সাধনা ও ক্ষুদ্র পরিসর থেকেই সফল উদ্যোক্তার সৃষ্টি হয়। আত্মনির্ভরশীল, পরিশ্রমী ও সাহসিরাই পারে উদ্যোক্তার ভূমিকা রাখতে। কেননা উদ্যোক্তা হয় একজন, তাঁর অধীনে কাজ করেন অগণিতজন।
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে কৃষিনির্ভর আমরা বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি কাজে পরিপক্ব হওয়ার জন্য গড়ে উঠেছে কৃষি ইনস্টিটিউট, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। অথচ আমাদের সাধারণ মানুষ থেকে কৃষি শিক্ষার্থীদেরও ধারণা এমন, কৃষি কাজ করবে তারা যারা অশিক্ষিত বা কৃষক। ফসলি ভূমিতে বীজ বোনা থেকে শুরু করে সকল কাজই কৃষকের। শিক্ষিত লোকেরা কিভাবে এসব কাজে পা বাড়াবে? বাস্তবতা এমনই হয়ে উঠেছে? কৃষি বিজ্ঞানে পড়–য়া শিক্ষার্থীও এখন শুধু গবেষণা, অফিসিয়াল কর্ম অথবা কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনায় সীমাবদ্ধ। আবার অনেকেই অন্য পেশাকে বেছে নিয়েছে জীবিকার উপায় হিসেবে। অথচ কৃষিতে যদি অন্তত কৃষি শিক্ষিতদের পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানো যেত, অর্থনৈতিকভাবে আরো অগ্রসর হওয়া যেত। ¯্রষ্টা সকল দেশকে একই প্রকারের সম্পদ দিয়ে তৈরি করেননি। একেকটা দেশ একেক ধরনের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। ¯্রষ্টা প্রদত্ত সম্পদের যথাযথ ব্যবহার করে অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরির মাধ্যমে অন্য বিভাগের প্রতি নজর আরোপ সঠিক সিদ্ধান্ত। উন্নত অনেক দেশ এখন প্রযুক্তি ও অন্যান্য বিভাগের সাথে কৃষির উপর গুরুত্বারোপ করে অর্থনৈতিকভাবে বেশ লাভবান হচ্ছে। এমনকি জাতীয় প্রয়োজন পূরণ করে বৈদেশিক মুদ্রাও উপার্জন করছে। বড় আফসোসের বিষয়, কৃষিনির্ভরশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও ব্রাজিল, চীনের মতো দেশগুলো থেকে আমাদের কৃষি পণ্য আমদানি করতে হয়। সেজন্য কৃষিতে সফল এমন দেশগুলোর আদলে আমাদের কৃষিক্ষেত্রকেও যুগোপযোগী ও পরিকল্পিত করা প্রয়োজন। কৃষির সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য বিভাগের উপরও নজর দেওয়া প্রয়োজন। স্বাভাবিকভাবে একা বা ক্ষুদ্র পুঁজিপতিদের পক্ষে সম্ভব নয় বৃহৎ শিল্প-প্রতিষ্ঠান করা। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র স্বল্প পুঁজিপতিদের একজোট করার ক্ষেত্রে সমন্বয়ের ভূমিকা রাখতে পারে। এভাবে বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব।
মানবকে সম্পদে রূপান্তর করার ক্ষেত্রে শিক্ষা অন্যতম একটি মাধ্যম। গতানুগতিক ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার বিপরীতে পরিকল্পিত ও কর্ম উপযোগী শিক্ষা বলতে শুধু কারিগরি শিক্ষাকেই বোঝায় না। সে শিক্ষা এমন হবে না যে, পাস করার পর মিলবে না কর্ম। আবার মেধাবীরা উচ্চশিক্ষার নামে যে হারে বিদেশে পাড়ি জমায় এবং তাদের মাঝে দেশে না ফেরার প্রবণতা। মানব সম্পদ পাচারই বটে। এমন যে, সেজন্য শিক্ষা জীবন শেষে দেশে ফেরার প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে হবে শিক্ষার্থীদের মাঝে।
পরিত্যক্ত ভূমি ও খাসজমি যেগুলো দীর্ঘদিন আবাদহীন, মীমাংসার মধ্য দিয়ে বিশাল জনশক্তিকে উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত করা যেতে পারে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দর্শনীয় স্থানসমূহকে পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তর করা যেতে পারে। সর্বস্তরে বাড়ানো উচিত দেশীয় পণ্যের ব্যবহার। প্রযুক্তি, বিনোদন ও চিকিৎসাসেবাসহ সকল ক্ষেত্রে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের প্রাধান্য দেওয়া উচিত। এতে উদ্যোক্তারাও উৎসাহ পাবে কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে। দেশের অর্থ দেশেই থাকবে; বাড়বে কর্মসংস্থান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন