শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

কয়েকটি বিলুপ্তপ্রায় জনগোষ্ঠী

| প্রকাশের সময় : ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী : পৃথিবীতে এমন অনেক জনগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের সম্পর্কে বিশ্ববাসীর জানতে পারার ঘটনা খুব বেশি দিন আগের নয়। এদের সিংহভাগই আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। প্রকৃতির এসব সন্তানের বসবাস মূলত দক্ষিণ আমেরিকার গহিন অরণ্যে, তবে অন্যান্য দেশেও রয়েছে। কিছু জনগোষ্ঠী নিয়ে খানিকটা আলোকপাত করা হলো।
পিরিপকুরা, মাতো গ্রসো (ব্রাজিল) : এখন পর্যন্ত এদের প্রকৃত নাম কেউ বের করতে পারেনি। তবে প্রতিবেশী গাভিয়া ও ইন্ডিয়ানরা এদেরকে ডাকে পিরিপকুরা, যার বাংলা অর্থ প্রজাপতি মানব। এদের ভাষার নাম টুপি-কাহাবি। পিরিপকুরাদের কথা প্রথম জানা যায় ১৯৮০ সালে। তখনই এরা বিলুপ্ত প্রায়, সংখ্যায় ছিল মাত্র ৩০ জন। ১৯৯৮ সালে এ গোত্রের দুজন মানুষ জঙ্গলের বাসস্থান ছেড়ে বেরিয়ে আসে। এদের একজন ছিল অসুস্থ। অবস্থা খারাপ দেখে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তার কাছ থেকে জানা যায়, আগে তাদের সংখ্যা আরো অনেক বেশি ছিল। এখন কম। এর প্রধান কারণ সাদা মানুষের আক্রমণ। এরপর পিরিপকুরাদের এলাকায় অনুমতি ছাড়া বাইরের লোকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। ধারণা করা হয়, এদের কেউই আর আজ বেঁচে নেই।
রিও পার্দোর কাবাহিবা, মাতো গ্রসো (ব্রাজিল) : এদের সম্পর্কেও খুব বেশি জানা যায়নি। কয়েক বছর আগে এরা সংখ্যায় ছিল মাত্র ৫০ জন। বর্তমানে আরো কম গেছে। জানা গেছে, শ্বেতাঙ্গ ব্যবসায়ীদের হামলার আতঙ্কে জঙ্গলের কোনো জায়গায় বর্তমানে এরা থিতু নয়, ঘুরে বেড়ায় এখান থেকে ওখানে। এক পর্যায়ে এরা সন্তান নিতে অনিচ্ছুক হয়ে পড়ে। ব্রাজিলের ব্যবসায়ীরা এদের আবাসভূমি প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে।
দ্য ম্যান অব দ্য হোর (ব্রাজিল) : আমাজনের তানারু নামক এলাকায় পশুপালকরা বন দখলের জন্য সেখানকার একটি আদিবাসী গোষ্ঠীর ওপর হামলা চালায়। তাতে বেঁচে থাকে তাদের একজন মাত্র সদস্য। খাবার জন্য প্রাণী শিকার করতে এই মানুষটি মাটিতে গর্ত করে বলে দ্য ম্যান অব দ্য হোল নামে পরিচিত। একাকী এই মানুষটির গোষ্ঠী সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না। গত প্রায় পনেরো বছর যাবৎ নৃ-তত্ত্ববিদরা তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছেন। তাকে বাঁচানোর জন্য সংলগ্ন ৩১ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়। ২০০৯ সালে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ভাড়া করা গানম্যানরা তাকে মারার জন্য গুলি চালায় কিন্তু জানা গেছে, একাকী সেই মানুষটি এখনো বেঁচে আছে।
কোরবা, জাভারি ভ্যালি (ব্রাজিল) : আধুনিক জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন সাতটি আদিবাসী গোষ্ঠী পেরু ও ব্রাজিলের সীমান্তে অবস্থিত জাভারি উপত্যকায় বসবাস করে। এদের মধ্যে এক হলো কোরুবা। এরা ‘গাদাম’ নামেও পরিচিত। কোরুবাদের এরকম একটি দলের সঙ্গে ১৯৯৬ সালে দেখা হয়েছিল কয়েকজন পর্যবেক্ষকের।
জো (ব্রাজিল) : ব্রাজিলে বসবাস করে ২৫৬ সদস্যের জো গোষ্ঠীটি। এরা প্রথম আধুনিক জগতের সংস্পর্শে আসে ১৯৮৭ সালে। জোরা জীবন ধারণ করে শিকার ও বিভিন্ন লতা-পাতা খেয়ে। এদের সমাজে শ্রেণিভেদ চোখে পড়ে না; সবাই সমান। সাদা মানুষরা এদের দেখার পর থেকেই সংখ্যা কমতে শুরু করে। বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে জোরা।
নুকাক-মাকু (কলম্বিয়া) : ১৯৯৮ সালে আধুনিক বিশ্বের লোকজন খুঁজে পাওয়া নুকাক-মাকু গোষ্ঠীর লোকেরা কলম্বিয়ার জঙ্গলে বসবাস করে। তখন তাদের সংখ্যা ছিল ৪২০ জন। এরপর আরো কমতে থাকে। বর্তমানে এদের সংখ্যা মাত্র ৩০ জন। এরা শিকারি ও যাযাবর।
দ্য অ্যায়োরিও-টোটোবিগোসেড (প্যারাগুয়ে) : দ্য অ্যায়োরিও-টোটোবিগোসেড নামের অর্থ বন্য শূকরের দেশের মানুষ। এদের বাসস্থান প্যারাগুয়ের চাকো নামক দুর্গম স্থানে। ১৯৪০ সালে এরা প্রথম আধুনিক মানুষের সংস্পর্শে আসে। এরপর শ্বেতাঙ্গদের রোষে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বর্তমানে এদের সঠিক সংখ্যাটা কেউ জানে না।
বাটাক (ফিলিপাইন) : বাটাকরা ফিলিপাইনের আদি বাসিন্দা হলেও এরা বর্তমানে অতি ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী। প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে ফিলিপাইনে বসবাস শুরু করে এরা। ক্রমান্বয়ে এদের বাসভূমি কেড়ে নেওয়া হয়। বাটাকরা কমে যাওয়ার জন্য প্রধানত দায়ী আধুনিক মানুষরা। মাত্র ৩০০ জনের এ গোষ্ঠীটি খুব শীঘ্রই দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
রক (ভিয়েতনামে) : শিকারে দক্ষ রক গোষ্ঠীর লোকেরা ভিয়েতনামের কুয়াংবিন প্রদেশের। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় উত্তর ভিয়েতনামের সৈনিকরা এদের প্রথম খুঁজে পেয়েছিল।
সেন্টিনেল ও জারওয়া, আন্দামান দ্বীপ (ভারত) : দুনিয়া সম্পর্কে পুরোপুরি উদাসীন, এমন দুটি গোষ্ঠী রয়েছে আন্দামান দ্বীপে। এর একটি হলো সেন্টিনেল গোষ্ঠী। এদের বাসস্থান আন্দামনের উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপে। ছোটো ও দুর্গম এ দ্বীপটি আন্দামানের পশ্চিমে অবস্থিত। এদের সংখ্যা মাত্র ২৫০ জন। হেলিকপ্টার দিয়ে ঘুরে দেখা গেছে, ২০০৪ সালের সুনামি এদের তেমন ক্ষতি করতে পারেনি। ধারণা অনুযায়ী প্রায় ৬০ হাজার বছর ধরে এরা উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপে বাসবাস করছে এবং ভাষা আন্দামানের অন্যান্য ভাষা থেকে ভিন্ন। আন্দামানের এরকম আরেকটি গোষ্ঠী হলো জারওয়া। ১৯৯৭ সালে ওদের এলাকায় পাশ দিয়ে সড়ক নির্মিত হওয়ার পর থেকে আধুনিক মানুষের সংস্পর্শে আসতে শুরু করে। কমতে কমতে এদের ৩০০ জন অবশিষ্ট রয়েছে এখন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট, বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কার (১ম স্বর্ণপদক) প্রাপ্ত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন