শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

পুলিশকে জনবান্ধব হতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু নোমান : স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে পুলিশের কল্যাণসভায় শুধু ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন’ বাতিলের আবদার করেনি বরং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা মানতেও অপারগতা প্রকাশ করেছে পুলিশ। পুলিশের আবদার শুনে মনে হয়, তারা আইনের ঊর্ধ্বে। স্পষ্টতই যে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি আজ পুলিশের পক্ষ থেকেই চাওয়া হচ্ছে। আপগ্রেড বেতন, ড্রেস, জুতা, রেশন, আবাসন, পরিবহন ইত্যাদিতে পরিপুষ্ট করতে গিয়ে যখন জনগণ ভ্যাট, ট্যাক্সের বোঝায় নুয়ে পড়ছে এর বাইরেও বেহিসাবী টু-পাইস কামাই যখন ওপেন সিক্রেট তখন এহেন আবদার উদ্বেগজনক। সাধারণ জনগণ  তো দূরের কথা সম্প্রতি সাংবাদিকদের পিটিয়ে আবারো পুলিশ দেখিয়ে দিয়েছে ‘মাছের রাজা ইলিশ, দেশের রাজা পুলিশ’।
নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন সংশোধনের প্রস্তাবে উদ্বেগ জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এ প্রস্তাব অবিলম্বে প্রত্যাখ্যান করতে বলেছে সংগঠনটি। হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। বর্তমানে যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে হেফাজতে ‘বিচারবহির্ভূতভাবে’ হত্যার অভিযোগ উঠছে তখন তাদের তরফ থেকে এ আইনের সংশোধনী এনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জবাবদিহির ঊর্ধ্বে রাখার প্রস্তাব নজিরবিহীন।
মানুষকে মারপিট করে, ভয় দেখিয়ে সত্য যদি উদ্ঘাটন করা যায়, তবে মিথ্যা স্বীকারোক্তিও আদায় করা যায়। বিচারের দায়িত্ব পুলিশের হলে আর বিচারক, কোর্ট-কাচারির দরকার হবে না। যদি আসামীকে নির্যাতনের মাধ্যমে শর্টকাট ম্যাথডেই সব কাজ চলে তাহলে কষ্ট করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করারই বা দরকার কি ! এ জন্য পুলিশকে প্রশিক্ষণও নিতে হবে না।
সম্প্রতি তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির হরতাল চলাকালে শাহবাগে পিকেটারদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় দুই সংবাদকর্মীকে থানার ভেতরে নিয়ে বেদম মারধর করে পুলিশ। পুলিশ সদস্যরা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে দুজনের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। এখানে ধাক্কাধাক্কির কোনও সুযোগ নেই। ওই ঘটনার পরদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘পুলিশ সাংবাদিকদের মারধর করে না, মাঝে-মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হয়, বৃহস্পতিবারও তাই হয়েছে’। আরেকজন মন্ত্রী বলেন, এই ঘটনা নাকি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। যদি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হয়েই থাকে তাহলে আন্তর্জাতিকমানের তদন্ত কমিটি গঠন করা হোক। তারপর তদন্ত অনুযায়ী যারা শাস্তি পাবে তাদের শাস্তি দেয়া হোক।
পুলিশের মারধরে আহত এটিএন নিউজের রিপোর্টার ঈশান দিদার ও ক্যামেরাম্যান আব্দুল আলিমকে হাসপাতালের ভর্তি হতে হয়েছে। দুজনেরই শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর আঘাত রয়েছে। ধাক্কাধাক্কিতেই যদি এই অবস্থা, তাহলে মারপিট করলে কি হতো কে জানে। অবশ্য পুলিশের সাংবাদিক পেটানোর ঘটনাকে ‘ধাক্কাধাক্কি’ বলার পর দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার মুখে ওই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘শাহবাগ চত্বরে যে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাটি ঘটেছে, আমরা সেজন্য দুঃখিত।’
বাংলাদেশের অনেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের বক্তব্যের জন্য নানাভাবে চিহ্নিত হয়ে আছেন। বিগত দিনেও এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রীরা এমনটাই বলেছেন। রানাপ্লাজা ধ্বংসের পর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ভবনটি ধরে বিরোধীদলীয়রা ঝাকাঝাকি করায় ধসে পড়েছে’। গুলিবিদ্ধ হয়ে এক শিশু নিহত হওয়ার পর সাবেক একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ডায়ালগ ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছেন’। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন ‘সাংবাদিকদের সাথে মাঝেমধ্যে পুলিশের ধাক্কাধাক্কি হয়’। আরো সেরা ডায়ালগ আছে,We looking for shuttrus। এছাড়াও ‘সব সাংবাদিক রাবিশ’, All are Rubbish, ননসেন্স। দেশ ছেড়ে সুদূর আমেরিকায়ও বাংলাদেশের হাওয়া উড়ছে। নতুন বছরের ট্রাম্পের সেরা ডায়ালগ ছিল সাংবাদিকরা সবচেয়ে বেশি অসৎ। অর্থাৎ ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি, রাবিশ, ননসেন্স, অসৎ ইত্যাদি। তাহলে আমরা কি বলতে পারি না, পৃথিবীর সৎ/অসৎ, সুবিধা/অসুবিধাভোগী, সু/দুর্নীতিবাজ, নিরপরাধী/অপরাধী, অত্যাচারী/স্বৈরচার ইত্যাদি সবপক্ষের সবচেয়ে বড় শত্রু সাংবাদিক। এটা ঠিক যে, সাংবাদিক, সংবাদপত্র বা মিডিয়া না থাকলে মহান, মেহেরবান, মাওলাপাকের সৃষ্টি এ সুন্দর পৃথিবীটা লুটেরা ও শোষকরা অনেক আগেই ইবলিশের কাছে লিজ দিয়ে দিত।
সাংবাদিকদের নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য দিনদিন বেড়েই চলেছে। সাংবাদিক হত্যার বিচারও উপেক্ষিত হওয়ার নজির আমাদের দেশে রয়েছে। সাগর-রুনির হত্যাকারীদের গ্রেফতারে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়ার প্রতিশ্রুতি আজ প্রহসন বৈকি! তাছাড়া নানা ছলছুতায় পুলিশ কর্তৃক সাংবাদিকদের হেনস্থা হওয়ার দৃষ্টান্ত হরহামেশাই চোখে পড়ে। এই দু:খজনক পরিস্থিতির কোনো সন্তোষজনক সুরাহা না হলে সংবাদ পরিবেশনে সাংবাদিকদের মধ্যে যে অনাস্থার সৃষ্টি হবে তা দেশের এবং দশের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনবে। সাংবাদিকরা শুধু তাদের দায়িত্বই পালন করে থাকে। পুলিশের প্রতি তারা কখনই আঘাত করে না। অথচ বিনা কারণে, পুলিশ তাদের অপকর্ম ঢাকার জন্য, বিভিন্ন টেলিমিডিয়া ও সংবাদপত্রের সাংবাদিক, রিপোর্টার, ক্যামেরাম্যানদের ওপর আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে মারধর করে।
অতীতে দেখা গেছে, সাংবাদিকদের পিটিয়ে সাময়িক বরখাস্তের নামে জামাই আদরে থেকে তারপর পদোন্নতি পেয়েছে পুলিশ। যে পুলিশ যত ক্রেজি, তত তার প্রমোশন এবং ভাল জায়গায় পোস্টিং! তাহলে আমরা বলবো, সাংবাদিকরা কলম, কাগজ, ক্যামেরা, মাইক্রোফোন ছাড়াই রাস্তায় আসবে। পুলিশ যদি মনে করে সাংবাদিক পিটিয়ে পদোন্নতি নেবে, নিক। সম্প্রতি পুলিশ সপ্তাহ উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, পুলিশকে জনবান্ধব হতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বানে পুলিশ কতটুকু সাড়া দিয়েছে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো ঘোষণার পরপরই রাজপথে কোনও কারণ ছাড়াই সাংবাদিকদের বেধড়ক প্রহার। এটা যদি হয় জনবান্ধব হওয়ার নমুনা তাহলে সাংবাদিকদের দুঃখ প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
এর বাইরে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের পুলিশ কীভাবে নির্যাতন করে তা বর্তমান ক্ষমতাসীনদের অতীতের বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়। ২০১৩ সালের অক্টোবরে সাবের হোসেন চৌধুরী জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, ‘আমি পুলিশি হেফাজতে অন্তরীণ ছিলাম। আমাদের নেতাদের ওপর কীভাবে নির্যাতন চলেছে, সেই বিবরণ আমি সভানেত্রীকে (শেখ হাসিনা) দিয়েছিলাম’। পুলিশ মতিয়া চৌধুরী ও মো. নাসিমকে রাস্তায় ফেলে পিটিয়েছে। সাদেক হোসেন খোকার মাথা পিটিয়ে ফাঁটিয়ে দিয়েছে। সেই পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ অনেক মিছিল-মিটিং-হরতাল করেছে। তখন বলা হতো বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুলিশের বুটের তলায়।
তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির হরতাল চলাকালে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি শাহবাগ থানার এক সহকারী উপপরিদর্শককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। আমাদের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যিনি কম কথা বলেন, মার্জিত কথা বলেন, যার নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী জঙ্গিবাদ দমনে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছে, সুতরাং আমাদের আশা, উক্ত ঘটনার সাথে জড়িতদের যথোপযুক্ত শাস্তি দেয়া হবে।
abunoman72@ymail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন