শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা

| প্রকাশের সময় : ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আবদুল্লাহ্ আল মেহেদী : প্রতি বছর আমরা গাই “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো ২১শে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি”। পৃথিবীতে শুধু বাংলাদেশীরাই ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। এটা আমাদের চরম গর্বের। এই গর্ব নিয়েই যেন আমরা মাতোয়ারা। বাংলা শেখার প্রতি আমাদের আগ্রহ দিন দিনই কমে আসছে। ভাবটা এরকমঃ বাংলা শিখে কী হবে আর? কালে কালে বেশ বুঝলাম, বেশিরভাগ বাঙালিই বাংলার চৌহদ্দি পেরোলেই বাংলা ভাষাটাকে পুরনো ঘরে ফেলে আসা আসবাবের ঝুলধরা তাকের কোণে ঝং ধরা টিনের বাক্সে বন্দি করে আসে।  কথায় কথায় ইংরেজি ছাড়ে। আসলে বাংলা ভাষা যেন কেবলই ফাঁকা আওয়াজ! তোতার বুলি! মুখস্থ বিদ্যা! ভাষা প্রয়োগে কোথায় যেন এক ধরনের অবহেলা। কোথায় যেন এক ধরনের হীনমন্যতা। কেন এমন করা হয়? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। দেশে কী বাংলা অভিধান ছাপা বন্ধ হয়ে গেছে? নাকি সময় এল অভিধানে নতুন নতুন কথার মানে লেখার? এবার কি ইংরেজির মত বাংলাও মেলবে মুক্তির ডানা? শক্ত বানান, যুক্তাক্ষর ভুলে সব হবে সোজা, সরল, অতীতে বাংলাভাষায় বহু বিদেশী ভাষার শব্দ প্রবেশ করেছে। এবার কি ঢুকে পড়বে হিন্দি, ইংরেজির ‘জানেমন’, ‘চিপকলি’, ‘মজাক’, ‘নউটাঙ্কি’, ‘ড্রামাবাজি’র মত শব্দ? স্বদেশে, পরদেশে, প্রবাসে বাঙালিদের মুহূর্তে বদলে যাওয়া মতিগতির সঙ্গে, পলে-পলে পালটে ফেলা টিভি চ্যানেলের মত ‘মেড ইজি’ করতে কি বাংলা ভাষা এবার দোর খুলে দেবে অভিধানের? হবে নাকি, নতুন ভাষার নতুন কথার, নতুন নতুন মানে? ভোলা বাঙালি কি বাংলা ভাষাকে নব কলবরে ফিরিয়ে আনবে জগৎ সভায়?  সংস্কৃতের অপভ্রংশ মাগধী-প্রাকৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি কালে কালে এই বাংলাভাষা এতটাই উন্নত এবং সমৃদ্ধ যে সাংস্কৃতিক বৈষম্যের ঊর্ধ্বে গিয়ে একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অগণিত মানুষকে এক সূত্রে গেঁথে দিয়েছে।
মায়ের ভাষাকে বাঁচানোর তাগিদ আসে বছরে এই একটি মাসেই। কেবল ফেব্রুয়ারি এলেই ভাষা নিয়ে হৈচৈ হয়। টিভিতে সারা মাস পর্দার কোণায় শহীদ বেদীর স্তম্ভ দেখা যায়। তারপর শেষ। টিভিতে আসছে নানান নতুন নতুন আগুন্তুক তাদের একটি বাক্যে চারটি ইংরেজি থাকেই, ভাবসাব দেখলে মনে হয় বিশাল প-িত। তার পর মার্চ থেকে চলে ভিনদেশী ভাষা চর্চা। গত তিন দশকে কত কিছুই তো পালটাল আমার সামনে এত কিছুর পরেও কী করে বলি যে বাঙালি বদলায়নি? কে বলে যে বাঙালি পরিবর্তন চায় না? দলে দলে শহর, গ্রাম উজাড় করে এই যে আমরা দেশে, বিদেশে ছড়াছড়ি পড়েছি, কেন? মাত্র বছর কুড়ি আগেও যে ঠোকাঠুকি, চুলোচুলি, ঝগড়াঝাঁটির এক্কান্নবর্তী সংসার ছিল, তা আজ ‘ছোট পরিবার, সুখী পরিবার’ হয়েছে, কেন? বড় দোমহলা বাড়ির বিলাসিতা ছেড়ে আজ সবার কাম্য ‘টু বেডরুম, ডাইনিং, হল, কিচেন’ কেন? পুরনো, প্রাসাদোপম বাড়ি, বাজার ভেঙে চাই অত্যাধুনিক ‘মল’, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর।  আমরা কি চেয়েছিলম মায়ের ভাষটাকে বিকৃত করে দিতে; বদলে নিতে?
বলবার আর অপেক্ষা রাখে না যে দেশে বাংলার অবমাননা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ভুলে ভরা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড, ব্যানার, পোস্টারেও বানানরীতি মানা হচ্ছে না। স্বয়ং শহীদ বেদীমূলের সাইনবোর্ডে প্রায় ৩০টি ভুল এখনো আছে। ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পরও ভুল বানানের ছড়াছড়ি সর্বত্র। বিভিন্ন পত্রিকা ইচ্ছেমত তাদের নিজস্ব বানান নীতি ব্যবহার করছে। যুগের পর যুগ নানাভাবে এ বিষয়ে কথা উঠলেও বাংলার অবমাননা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এমনকি এ সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের নির্দেশেরও তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। পাঠ্যপুস্তকও হাজারো ভুলে ভরা। শুধু রাজধানীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সড়ক-ফুটপাতে বা ভবনের দেয়ালে সাঁটানো সাইনবোর্ড কিংবা বিলবোর্ডগুলোতে চোখ বুলালেই বাস্তব দৃশ্যটি ফুটে উঠবে। রাজধানীর অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেরই নামকরণ করা হয়েছে বিদেশি ভাষায় বিশেষ করে থাই ও চাইনিজ ভাষায়। কোথাও বিদেশি শব্দ লেখা হয়েছে বাংলায়। আবার কোথাও অহেতুক বাংলা শব্দকে ইংরেজিতে লেখা হয়েছে। আবার কোথাওবা বাংলা-ইংরেজির মিশেল আর ভুল বানানের ছড়াছড়ি। ঢাকা ও ঢাকার বাইে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামফলক লেখা হয়েছে ইংরেজিতে। ইংরেজি নাম লেখা হয়েছে বাংলা হরফে। সেঞ্চুরি, টপ ফ্যাশন, ক্যাটস আই, মনসুন, চাংপাই, ইয়ামী-ইয়ামী পোশাকের দোকানের এমন অজস্র সাইনবোর্ড লেখা হয়েছে ইংরেজিতে। শহরজুড়ে মোবাইল ফোন কোম্পানির ডিজিটাল বিলবোর্ডগুলোয় ব্যবহার করা হয়েছে ইংরেজি ভাষা। জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট (নিমকো) পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীর কাঁটাবন থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার ৫শ’ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র অর্ধশতাধিক নামফলক বা সাইনবোর্ড লেখা হয়েছে বাংলা হরফে। ইংরেজি ভাষায় নামফলকের সংখ্যা আড়াই শতাধিক এবং অবশিষ্টগুলো লেখা হয়েছে বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে। এয়ারপোর্ট রোড থেকে শুরু হয়ে প্রগতি সরণির দুই দিকে গড়ে ওঠা প্রায় সব দোকানের সাইনবোর্ডে সরণি বানান ভুল। কোনোটিতে লেখা হয়েছে ‘স্মরনি’, কোনোটিতে ‘স্বরনী’।  খাবারের দোকানগুলোতে দেশি খাবারের নামের বানানেও করা হয়েছে ভুল। যেমন- মালিবাগ মোড়ের একটি খাবারের দোকানে বিরিয়ানি না লিখে লেখা হয়েছে ‘বিরানী’, কোথাও লেখা হয়েছে ভর্তার পরিবর্তে ‘ভরতা’ এরকম অসংখ্য ভুল গোডাউনের পরিবর্তে লেখা হয়েছে ঘোডাওন কুমিল্লায় প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড় বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের ও প্রাইভেট টিউটরদের লিফলেট ও পোস্টারে ভুলে ভরা যেমন-স্টুডেন্ট এর পরিবর্তে স্টুডেন্ট, কোচিং-এর পরিবর্তে কোচিন, আরো আছে এখানে খাটি গাভীর চা পাওয়া যায়।

বাংলা ভাষা নিয়ে তর্ক বহুদিনের পুরনো। অনেকের আবার এ ধরনের জন্মগত সম্পর্ক মেনে নিতে রয়েছে প্রবল আপত্তি। এ তর্ক নতুন করে শুরু করার আগে আসুন আমরা আলোচনা করে ঠিক করি, ‘বাংলা ভাষা’ বা ‘সংস্কৃত ভাষা’ বলতে আমরা কি বুঝবো? ‘বাংলা ভাষা’র দু’টি সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ রাষ্ট্র, ভারতের বিহার, আসাম ও বার্মার আরাকান অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে সর্বজনবোধ্য যে মান উপভাষাটি আছে যাকে সাধারণভাবে ‘মান চলিত বাংলা’ বলা হয়। সেটাকে ‘বাংলা’ বলা যেতে পারে। এ ছাড়াও এ অঞ্চলে প্রচলিত বিশেষ কিছু ইন্দো-আর্য্য উপভাষার (যেমন চট্টগ্রাম, সিলেট, মেদিনীপুর, বীরভূম অঞ্চলে প্রচলিত উপভাষা) সমষ্টিকেও ‘বাংলা ভাষা’ বলা যেতে পারে। ইংরেজি, ফরাসি ইত্যাদি সব ভাষার ক্ষেত্রেই এই ব্যাপারটা আছে। তবে ঐতিহাসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে ইংরেজি বা ফরাসির মতো ভাষার ক্ষেত্রে একাধিক মান ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে (যেমন, যুক্তরাজ্য আর যুক্তরাষ্ট্রে আলাদা আলাদা মান ইংরেজি রয়েছে, ফ্রান্স আর কানাডার কুইবেকে রয়েছে আলাদা আলাদা মান ফরাসি)। সুতরাং ‘ইংরেজি’ বা ‘ফরাসি’ বলতে বোঝাবে সেই মান ভাষাগুলোর যে কোন একটিকে বা একসঙ্গে ইংরেজি বা ফরাসির সবগুলো উপভাষাকে মোটকথা, বর্তমান পৃথিবীতে ‘ভাষা’ কথাটির অন্ততপক্ষে দু’টি আলাদা অর্থ রয়েছে: ১. সর্বজনবোধ্য মান উপভাষা, এবং ২. সবগুলো উপভাষার সমষ্টি, সুতরাং ১. ‘বাংলা’ বলতে সর্বজনবোধ্য মান বাংলাকে বোঝাতে পারে আবার ২. সবগুলো আঞ্চলিক বাংলা সমষ্টিকেও ‘বাংলা’ বলা যেতে পারে। কিন্তু তার বালাই রাখছে কোথায় বাঙ্গালী?
২১শে ফেব্রুয়ারি বা ভাষা আন্দোলন স্কুলের পাঠ্যবইয়েই সীমাবদ্ধ থাকে বর্তমানে। একুশের ভোরেই কেবল বাংলাদেশের মানুষের গন্তব্য হয় শহীদ মিনার। এই বিশেষ দিনটিতে মানুষের ঢল নামে পথে। বাংলা ভাষাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা রূপে শুধু নয় অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবীতে বিসর্জিত প্রাণগুলোর জন্য অন্তর থেকে বর্ষিত হয় শ্রদ্ধা। ফুলের স্তবকে, গানে প্রকাশ পায় আবেগ। হৃদয় উদ্বেলিত হয় বাঙালি হওয়ার গৌরবে। কিন্তু সত্যিই কি আজ সেই রক্তে রাঙানো প্রেক্ষাপট আত্মস্থ করা সম্ভব হচ্ছে? এখন তো ইংরেজি শিক্ষার যুগ! যদিও আমি এই শিক্ষার বিপক্ষে নই।
আজ বাঙালি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা শীর্ষস্থানও লাভ করেছে এবং করছে। কিন্তু যে ভাষার নামে তাদের পরিচয় সেই ভাষা তাদের রোজকার জীবনে কোন স্থানে রয়েছে? বিশ্বের দরবারে সে কতটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে? ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ বা তাদের স্বপ্ন আজ কতটা সফল? একুশের চেতনা আজ আমাদের মন কতটা ধরে রাখতে পেরেছে? এই প্রশ্নগুলো আজও এই দিনটিতে সামনে এসে পড়ে! আধুনিক প্রজন্ম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আজ ইংরেজি ছাড়া কথা বলে না, তাদের পড়াশুনোর মাধ্যম ইংরেজি হলে নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করে। বাংলা ভাষার এ অবহেলার অবসান ঘটুক, এটাই আমাদের আকাক্সক্ষা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন