লায়ন অধ্যক্ষ ডা. বরুণ কুমার আচার্য্য (বলাই) : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৫৬তম সম্মেলনে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্য একটি কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। ওই কনভেনশনের বিধানবলী বাংলাদেশে কার্যকর করার লক্ষ্যে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন, ব্যবহার, ক্রয়-বিক্রয় ও বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ করা সমীচীন ও প্রয়োজন উল্লেখ করে ২০০৫ সালের ১১নং আইন বলে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন তৈরি হয়। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে এ আইন তৈরি হলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। অনেক ক্ষেত্রে সরকার বা সরকারি দফতরগুলো এ আইন মানছে না। ফলে নিষিদ্ধ স্থানেও ধূমপান থেকে বিরত থাকছে না ধূমপায়ীরা।
আইনে যা আছে : ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের ৪(১) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কোনো পাবলিক পরিবহনে ধূমপান করতে পারবে না। ‘পাবলিক প্লেস অর্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত অফিস, গ্রন্থাগার, লিফট, হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভবন, আদালত ভবন, বিমানবন্দর ভবন, সমুদ্রবন্দর ভবন, নৌবন্দর ভবন, রেলওয়ে স্টেশন ভবন, বাস টার্মিনাল ভবন, ফেরি, প্রেক্ষাগৃহ, আচ্ছাদিত প্রদর্শনী কেন্দ্র, থিয়েটার হল, বিপণি ভবন, পাবলিক টয়লেট, সরকারি বা বেসরকারিভাবে পরিচালনাধীন শিশুপার্ক এবং সরকার কর্তৃক, সরকারি প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারিত অন্য যে কোনো বা সকল স্থান।’
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী পাবলিক পরিবহন অর্থ মোটরগাড়ি, বাস, রেলগাড়ি, ট্রাম, জাহাজ, লঞ্চ, যান্ত্রিক সব ধরনের জন-যানবাহন এবং সরকার কর্তৃক বা সরকারি প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারিত, নির্দিষ্ট করা বা ঘোষিত অন্য যে কোনো যান।
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের ৪(১) ধারায় বলা হয়েছে, এসব স্থানে ধূমপান করলে ধূমপায়ীর ৫০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হবে।
জরিমানা করার ক্ষমতা : ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনে অপরাধ করলে যে কোনো শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট এর বিচার করবেন। তবে কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার লিখিত বক্তব্য ব্যতিরেকে কোনো আদালত বা কোনো ম্যাজিস্ট্রেট এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ বিচারের জন্য গ্রহণ করবেন না।
কে হবেন কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা : এই আইনে কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বা তার সমমানের বা তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোনো কর্মকর্তা এবং এ সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনের জন্য বিভিন্ন আইনের অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত যে কোনো কর্মকর্তাকে বোঝাবে। অর্থাৎ যেখানে-সেখানে যারা ধূমপান করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত, তাদের নাগাল পাওয়া কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আর এ কারণেই ধূমপান আইনের প্রয়োগ খুব একটা চোখে পড়ে না। ধূমপান নিরুৎসাহিত করতে সরকারের নিয়মিত কোনো পদক্ষেপ নেই।
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের ৮ ধারায় বলা হয়েছে, যেসব এলাকায় ধূমপান করা অপরাধ সেসব এলাকার মালিক, তত্ত্বাবধায়ক, নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি বা ব্যবস্থাপক ওই স্থানের এক বা একাধিক জায়গায় বা পাবলিক পরিবহনের মালিক, তত্ত্বাবধায়ক, নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি বা ব্যবস্থাপক সংশিষ্ট যানবাহনে ‘ধূমপান হইতে বিরত থাকুন, ইহা শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ সংবলিত নোটিশ বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে।
কোনো পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে এ ধরনের কোনো নোটিশ এখন আর চোখে পড়ে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-আধা সরকারি অফিস, আদালত, হাসপাতাল, বিমানবন্দরে অবাধে চলছে ধূমপান। আর যানবাহনে ধূমপান করা যেন অবশ্য পালনীয় কাজের একটি। পাবলিক প্লেস বা পাবলিক পরিবহন কর্তৃপক্ষের আইন ভঙ্গের এ বিষয়টি নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। সরকারি অফিস-আদালতের কোথাও ধূমপানবিরোধী নোটিশ আর চোখে পড়ে না। সরকার নিজেই আইন ভঙ্গ করছে।
এ আইনের ৬(১) ধারা অনুযায়ী জনসাধারণের চলাচলের রাস্তায় তামাকজাত দ্রব্য বিক্রির জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধূমপান করার কোনো যন্ত্র স্থাপন নিষিদ্ধ হলেও লোক চলাচলের রাস্তায় অহরহ অস্থায়ী দোকানে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি হচ্ছে। এ বিধান লংঘন করলে এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান থাকলেও কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের উপস্থিতি বা পদক্ষেপ একেবারেই নেই।
আরও কিছু নিয়মকানুন মেনে চলার বাধ্যবাধকতা : ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনে তামাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বা বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের আরও কিছু নিয়মকানুন মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যেমন : মোড়কে সতর্কবাণী মুদ্রণ : আইনের ১০(১) ধারায় বলা হয়েছে, তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদনকারী প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেটে বা মোড়কে বড় অক্ষরে স্পষ্ট করে বড় মাপে সরকার নির্ধারিত ছয়টি সতর্কবাণীর যে কোনো একটি মুদ্রণ করবে। এসব সতর্কবাণী হচ্ছে, ধূমপান মৃত্যু ঘটায়, ধূমপানের কারণে স্ট্রোক (মস্তিষ্কে) রক্তক্ষরণ হয়, ধূমপান হৃদরোগের কারণ, ধূমপান ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ, ধূমপানের কারণে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হয় ও ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এই একটি সতর্কবাণী তামাকজাত দ্রব্যে মোড়কে সাধারণত লেখা হয়। কিন্তু সেটি মোড়কের মোট জায়গার ৩০ শতাংশ জুড়ে লেখা থাকে না। ৩০ শতাংশ জায়গা জুড়ে সতর্কবাণী লেখা আইনে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ আইন অমান্য করলে তিন মাস পর্যন্ত কারাদ- বা এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় প্রকার দ-ের বিধান করা হয়েছে।
আইন করে বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছে : ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের ৫(১) ধারায় বলা হয়েছে, এক. কোনো প্রেক্ষাগৃহ (সিনেমা হল) বা সরকারি ও বেসরকারি রেডিও এবং টেলিভিশন চ্যানেলে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার, আলোচিত্র প্রদর্শন বা শোনানো যাবে না। দুই. তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন রয়েছে এমন কোনো ফিল্ম বা ভিডিও টেপ বা অনুরূপ অন্য কিছু বিক্রয় করা যাবে না। তিন. বাংলাদেশে প্রকাশিত কোনো বই, ম্যাগাজিন, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, বিলবোর্ড, খবরের কাগজ বা ছাপানো কাগজে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ছাপানো যাবে না। চার. জনগণের কাছে এমন কোনো লিফলেট, হ্যান্ডবিল, বিলবোর্ড বা দলিল বিতরণ বা সরবরাহ করা যাবে না যাতে তামাকজাত দ্রব্যের রং, লোগো, ট্রেডমার্ক, চিহ্ন, প্রতীক রয়েছে।
তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার উৎসাহিত করার জন্য কোনো দান, পুরস্কার, বৃত্তি প্রদান বা কোনো খেলাধুলার টুর্নামেন্টের আয়োজনও করা যাবে না। এই ধারার বিধান লংঘনের ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে তিন মাস পর্যন্ত কারাদ- বা এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে।
আসুন, কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী হয়ে নির্দিষ্ট আইনগুলোকে কার্যকর করি। আগামী প্রজন্মের শিশুদের জন্য দেশকে বাসযোগ্য করে তুলি। ধূমপানকে নিরুৎসাহিত করি।
লেখক : সভাপতি-চট্টগ্রাম সাহিত্য সমাজ অনুশীলন কেন্দ্র, চট্টগ্রাম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন