শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

দর্শকের মন জয় করুন

| প্রকাশের সময় : ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

শিকদার আবু নছর মঈনুদ্দিন : বেশ কিছু নাট্যকর্মী-সংস্কৃতিসেবী এবং কতিপয় টিভি চ্যানেলের কর্তাব্যক্তি বিদেশী চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেয়া আর দেশী চ্যানেলে বিদেশী নাটক-সিনেমার ‘বাংলা ডাবিং’ প্রদর্শন বন্ধের দাবি জানিয়ে আন্দোলন করছেন। কারণ হিসাবে তাদের রুটি-রুজির পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে দাবি করছেন তারা। তাদের এসব দাবি যে মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে হাস্যকর তা বলাই বাহুল্য। কোন ব্যবসায়ী (গণমাধ্যম বা অন্য কোন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যুক্ত) যে কোন বৈধ পণ্য আমদানী বা রপ্তানী করতে বাজার সম্প্রসারণ বিজ্ঞাপন দিতে পারেন। এটা তার মৌলিক এবং আইনী অধিকার। এ ক্ষেত্রে ইসরাইল ছাড়া কোন সীমানা বন্ধ থাকার কথা নয়। তথাপিও সরকার এদেশীয় সংস্কৃতিসেবী ও চ্যানেলগুলোর স্বার্থ রক্ষার্থে বিদেশী মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয়া নিষিদ্ধ করেছে। এতেও ঐ সব আন্দোলনকারীরা থেমে নেই। তাদের দাবি, বাংলা ডাবিংকৃত বিদেশী নাটক-সিনেমা প্রচার বন্ধ করতে হবে। যুক্তি, অবশ্যই মোক্ষম, তাদের সৃষ্ট নাটক-অনুষ্ঠান দর্শক দেখছে না। কারণ বড় বড় বাজেটে নির্মিত ঐ সব বিদেশী নাটক-সিনেমার কাছে দেশী স্বল্প ব্যয়ে নির্মিত নাটক ইত্যাদি মার খাচ্ছে, ম্লান হয়ে যাচ্ছে। কথাটা যে সত্য তা তারা লুকাননি। কিন্তু আসলে বাজেটের থেকেও বড় সমস্যা যে অন্যত্র সেটা তারা হয় বলছেন না অথবা আদৌ তারা দর্শক চাহিদা উপলব্ধি করছেন না। তাদের দৈন্য যে তারা অজান্তে হলেও স্বীকার করে ফেলেছেন তা অস্বীকার করা উপায় নাই। যখন দেশে কেবলমাত্র বিটিভি ছিল তখনও বিভিন্ন  দেশের ডাবিং করা নাটক-সিনেমা ঐ একটি মাত্র চ্যানেলে নিয়মিত দেখানো হতো। কিন্তু দেশী নাটক-সিনেমা দেখার জন্য সেই আমরাই চাতক পাখির মত অপেক্ষা করতাম। সেগুলো কি স্বল্প বাজেটে নির্মিত হতো না?
এই সংস্কৃতিসেবীরা যদি মনে করেন, বিদেশী ডাবিং করা নাটক-সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ হলেই তারা দর্শক পাবেন তবে তারা বাস্তবতা থেকে যে অনেক দূরে তা বলতেই হবে। অবশ্য মনে হয় না তারা ভুল করছেন বা ভুলপথে আন্দোলন করছেন। কারণ যে বিষয়টা তাদের দর্শকপ্রিয়তার বড় অন্তরায় সে ব্যাপারে আজ পর্যন্ত তারা টুঁ-শব্দ করেননি। কেন তারা দর্শকের চাহিদার মূল্য না দিয়ে জোর করে সুস্থ মানুষকে ‘কুইনাইন’ গেলাতে চাচ্ছেন। তাদের তো প্রথম এবং প্রধান আন্দোলন হওয়ার কথা ভারতীয় অসুস্থ সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে, যেখানে প্রতিনিয়ত প্যাগান-ভালগারনির্ভর খুনোখুনি আর মদকসক্তিময় নাটক-সিনেমা-সঙ্গীত-নৃত্য অহরহ পরিবেশনার মাধ্যমে নরক গুলজার করে তোলা হয়েছে। ঐ সব অপসংস্কৃতি যে কোন ধ্বংসাত্মক অস্ত্র এবং মাদক অপেক্ষাও অধিক বিধ্বংসী যার শিকার হচ্ছে আমাদের কিশোর-কিশোরী। অন্যরাও কিন্তু রেহাই পাচ্ছে না। একটা প্রজন্মকে এভাবে নিঃশেষ হতে দেয়া যায় না। জাতির ভবিষ্যৎ কা-ারী তো তারাই। স্পষ্টভাবে বলতে গেলে ঐ চ্যানেলগুলোয় যা দেখানো হয় তাতে আছে কী, যাকে আমরা অপসংস্কৃতি বলছি। সেখানে আছে উলঙ্গপনা, পরকীয়া প্রেম, অবৈধ সম্পর্ক, যৌনতা, পারিবারিক উস্কানি-অশান্তি, আছে শিরক-বেদাতির উপকরণ আর সন্ত্রাসের নতুন নতুন কলাকৌশল। এসবই ভারতীয় সংস্কৃতি যা আর্য ধর্ম বিশ্বাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। প্রমাণস্বরূপ ছোট্ট একটা নমুনা পেতে পারেন, ডঃ অতুল সূর লিখিত  ‘দেবলোকে যৌন জীবন’ প্রকাশক জে, সূর, কলকাতা-৩। এই বিশ্বাস সংস্কৃতি দ্বারা শুধু আমরাই নই, বিশ্ব সমাজও শালীনতা-নৈতিকতা হারিয়ে ফেলতে পারে। বিশেষ করে ভারতীয় বঙ্গ এসব ক্ষেত্রে যেন বেশী অগ্রগামী। তারা আজো মনে করে বাঙ্গালী বলতে হিন্দু সত্তার বাইরে কেউ হতেই পারে না। এ ধারণা তাদের পুষ্ট হয় বৃটিশ আমলে যা থেকে আজো তারা বের হতে পারেনি। তাই বাংলা ভাষী মুসলমান তিন কোটির ঊর্ধ্বে থাকা সত্ত্বেও তাদের কোথাও কোন ছাপ বা প্রতিনিধিত্ব নাই, কেবল ভোটের  চাল ছাড়া। আওয়ামী ঘরনার বুদ্ধিজীবী মরহুম এম আর আখতার মুকুল তার কোলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীতে স্বাধীনতা পূর্ব ভারতে ‘বাঙ্গালীর রেনেসাঁ’কে হিন্দুদের রেনেসাঁ বলেই অবিহিত করেছেন। ভারতীয় বঙ্গের হিন্দুরা বাঙ্গালীত্বকে তাদের একচেটিয়া অধিকার মনে করেন, যদিও কার্যত, তারা ‘মহাভারতে’র বাইরে তাদের স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান, যেমনটি প্রকাশ করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। এখানে একটি উদাহরণ খুব যুক্তিযুক্ত মনে হবে। বসন্ত চ্যাটার্জি ১৯৭৩-এ বাংলাদেশে এসেছিলেন অহ বুব An eye witness  account-এর জন্য। তিনি দিল্লী ফিরে Inside Bangladesh today নামক এক বই লিখলেন। তার বইয়ের ১৪৭ পৃষ্ঠায় যা লিখলেন তাতে আমরা অবাক হই না কারণ এর পূর্বের আরো দুই চ্যাটার্জি শত বর্ষের ব্যবধানে হলেও আমাদের বাঙ্গালী বলে মনে করেননি। বসন্তবাবু লিখলেন it is clear that shaikh mujib’s Bengali and our Bengali are two entirely different things. His Bengali is a political entity and by religion is muslim where as our bengali is a cultural entity and by religion is Hindu.  অতএব কেউ যদি বিভ্রান্তির কারণে বা ছেলেভোলানোর জন্য এপার বাংলা ওপার বাংলা, আমরা একই ভাষা সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী বলে, তবে তাকে বলব সাবধান, পিছলে আবর্জনায় অবগাহন করবেন না। ভাত আর মাছ দিয়েই কেবল খাদ্যাভ্যাস বা জীবনাচারের মানদ- দাঁড় করানো যাবে না। হাজারো লাখো বৈপরীত্য আছে আমাদের ভাষা জীবনাচারে আর ধর্মীয় বিশ্বাসে যা নিজ নিজ সংস্কৃতিতে আবহমানকাল ধরে উপাদান জুগিয়ে আসছে। আর তার সর্বক্ষণ প্রচ- প্রকাশ দেখতে পাই ওপার বঙ্গের টিভি চ্যানেলগুলোয় এখানেই তারা আমাদের (ঋজু-ভঙ্গুর হলেও) চ্যানেলগুলোকে ভয় পায়। আজো তাদের দুঃস্বপ্নের মধ্যে হাঠাৎই আবির্ভূত হন, হযরত শাহ্ জালাল, বখতিয়ার খিলজী, তিতুমীর, শেরেবাংলা, ভাসানী, সোহরাওরার্দী আর বঙ্গবন্ধু, মুখে তারা যাই বলুক না কেন? যাই হোক এর বিপরীতে ডাবিং করা কিছু বিদেশী ধারাবাহিক নাটকে আমরা কি পাচ্ছি? সত্য-ন্যায়-আদর্শ আর তৌহিদী চেতনাভিত্তিক মানতাবাদ। হ্যাঁ ‘ইউসুফ-জুলেখা’ ইরানী বিশ্বখ্যাত নাটক যা এসএ টিভিতে হচ্ছে। ২১-এ টিভিতে হচ্ছে ‘হাতীম’ যা একজন দানশীল মানবতাবাদীর জীবনালেখ্য। দীপ্ত চ্যানেলে চলছে বিশ্বখ্যাত তুরস্কের স¤্রাট ‘সুলতান-সুলেমান’ ধারাবাহিক নাটক। হ্যাঁ, নাটকে কিছু ইতিহাস বিকৃত, অতিরক্তিত ভালগার কাহিনী শোনানো হয় যা অবশ্যই আপত্তিকর। এছাড়া সুলেমান যিনি একজন বিরাট বীর, ন্যায়পরায়ুন শাসক ছিলেন যার কারণে ইউরোপের খ্রিস্টান শাসকগণ তার নেকনজরের প্রার্থী ছিলেন সেটা আপত্তি করা যাবে না যা মুসলিম হিসাবে আমাদের উজ্জীবিত করে। আন্দোলনকারীরা বলেছেন না বাংলদেশের চ্যানেল যদি ভারতে ঢুকতে না দেয় তবে ভারতীয় চ্যানেল ও বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করতে হবে। যদিও মাঝে মধ্যেই ভারতীয় চ্যানেলের নোংরামি থেকে প্রজন্মকে বাঁচাতে আদালতে মামলা হচ্ছে যাতে ঐ সব চ্যানেল এ দেশে বন্ধ হয়। গণইচ্ছা ও গণদাবি যথাযথ কর্তৃপক্ষসহ দর্শকদের বিবেচনায় নিতে হবে।
আমাদের ভাবার সময় এসেছে ধর্ম-নিরপেক্ষতা দেখাতে গিয়ে কি আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে আহত করবো, বাদ দেব? আশপাশে তাকালে তো তা আমাদের শেখায় না। পশ্চিমবঙ্গের কথাই ধরুন, ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বাদ দিন, ৩০ বছর ধর্মত্যাগী কমিউনিস্ট শাসনের পরেও তাদের প্রিন্ট বলুন বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া বলুন সর্বত্র কেবলমাত্র একটি ধর্মের প্রভাব দেখতে পাই। রামকৃষ্ণ পরম হংসদেব, নিমাই, বাবা লোকনাথ, সাঁইবাবা ছাড়াও নানান দেবদেবীর জীবন কাহিনীর মাহাত্ম্য প্রচার করা হয়। অন্য কোন ধর্ম-বিশেষত, ইসলাম সেখানে অনুপস্থিত। তাদের নিজ ধর্মের প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা প্রশংসনীয়। আর এগুলো তাদের (তিন কোটি মুসলিম বাদে) আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু, তারা উজ্জীবিত হন। স্বাধীনতার ইতিহাসেও সেখানে হাজী শরীয়তুল্লাহ, তিতুমীর, শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবের কোন স্থান দেননি। পূর্বের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বাদ দিয়ে এক লাফে খুদিরাম, সুভাষ বোসসহ সব হিন্দু নেতার লাড়াই আর ত্যাগের কাহিনী দেখতে পাই।
“হিন্দুরা এটা স্বীকার করতে চান না কিন্তু বাংলার ও পাটনার ওয়াহবীরাই ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের দিশারী ছিলেন।...” ব্যারিস্টার বিমলানন্দ শাসমল, ‘ভারত কী করে ভাগ হলো’ বইয়ে লিখেছেন, “ইংরেজদের  সঙ্গে লড়াই করে যত ওয়াহবী প্রাণ দিয়েছেন বা প্রাণ দ-ে দ-িত হয়েছিলেন, যে কোন পরাধীন জাতির পক্ষেই তা গৌরবের বিষয়। কিন্তু ভারতের ইতিহাস এদের সেভাবে স্বীকৃতি দেয়নি।”
আন্দোলনকারীরা বিদেশী নাটকের বড় বাজেটের কথা বলেছেন। এটা যে কথার কথা মাত্র, তাতে সন্দেহ নেই। একটি সময় এমন ছিল যখন বিটিভির নাটক ও অনুষ্ঠান দেখার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষ উন্মুখ থাকতো। এখন উল্টোটিই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাই আন্দোলনকারীদের বলি, আপনারা ওপার বাংলার ময়ূরপুচ্ছ না লাগিয়ে বাংলাদেশী হয়ে চিন্তা করুন, এদেশের দর্শকদের কিভাবে মনজয় করা যায় সেটা চিন্তা করুন। ভাবুন হজরত শাহ্জালাল, শাহ্মখদুম, শাহপরাণ, বখতিয়ার খিলজী, সিরাজউদ্দৌল্লা, হাজী শরীয়তুল্লাহ, তিতুমীর, নবাব সলিমুল্লাহ্, শেরেবাংলা, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু ও জিয়ার জীবনী নিয়ে কিভাবে অনবদ্য সাহিত্য, নাটক, সিনেমা তৈরী করা যায়।
অন্যরা নিজ ধর্মের গুণকীর্তন করেও প্রগতিশীল থাকবে আর আপনি নিজ ধর্মকে অবজ্ঞা করে অন্যের চোখে অধিক প্রগতিশীল হবেন, এটা হয়না। মনে রাখতে হবে, এদেশের মানুষ ধর্মানুরাগী, তিনি যে দলের বা যে স্তরেরই হোন না কেন। অতএব তাকে আহত করে বা সস্তা সুড়সুড়ি দিয়ে অনুষ্ঠান করলে যে তিনি দেখবেন, তা ভাবা ঠিক নয়।
লেখক : নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন