শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

বেশী দামেই গ্রাহকদের বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে

| প্রকাশের সময় : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

এ.বি. সিদ্দিক : বিদ্যুৎ খাতে বর্তমান সরকারের আমলে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে বলা হয়েছে (উল্লেখ্য : বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, অর্থমন্ত্রণালয় আর বর্তমান সরকারের ২০১০ সালের বিদ্যুৎ নিয়ে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, তাতে এক এক রকমের তথ্য দেয়া হয়েছে বিদায় পাঠক কিছুটা বিব্রত হতে পারেন। আর এই লেখায় তথ্য এসব থেকেই, অর্থাৎ সরকারিভাবে পাওয়া। ২০০৯ সালের ৯ মার্চ থেকে মার্চ ২০১৬ পর্যন্ত সর্বোচ্চ স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা ৪ হাজার ৯৪২ থেকে ১৪ হাজার ৪২৯ মেগাওয়াটে উন্নীত করা, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের সংখ্যা ২৭ থেকে ১০১ উন্নীত, সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩ হাজার ২৬৮ থেকে ৮ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত, ভারত থেকে আমদানি ৬০০ মেগাওয়াট, নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি ১ দশমিক ৬ থেকে ২০ মেগাওয়াটে উন্নীত করা, মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ২২০ কিলোআওয়ার ঘণ্টা থেকে ৩৭১ কিলোআওয়ারে উন্নীত করা, গ্রাহক সংখ্যা ১ কোটি ৮ লাখ থেকে ২ কোটি ৪ লাখে উন্নীত করা হয়েছে। একই সময়ে সরকারিভাবে বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধি করা হয় ৬ হাজার ৪৪০ মেগাওয়াট আর বেসরকারিভাবে ৫ হাজার ১৮৯ মেগাওয়াট। সরকারিভাবে ৪৪ শতাংশ, বেসরকারিভাবে ৩৫ শতাংশ, আমদানি ৪ শতাংশ, ক্যাপটিভ ১৬ শতাংশ আর নবায়নযোগ্য ১ শতাংশ। একই সময়ে সরকারি খাত থেকে ২ হাজার ৮৭৭ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ২৫টি আর ৩ হাজার ৬৭৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৪৯টি নতুন উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। একই সময়ে ১২ হাজার ৮৮১ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ৮২টি কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি হয়েছে যার মধ্যে ৫৩টি কাজ শুরু হয়েছে। এরমধ্যে ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র ২০টি, যেগুলোর স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার ৬৫৩ মেগাওয়াট। ২৯টি উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণাধীন আছে যার মধ্যে সরকারি ১৪টি আর বেসরকারি ১৫টি। টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন ২০টি, যার মধ্যে সরকারি ১০ আর বেসরকারি ১০টি। পরিকল্পনায় আছে ৬টি, যার সবক’টি সরকারি। এছাড়া উল্লেখিত সময়ের মধ্যে মোট সঞ্চালন লাইন ৮ হাজার সার্কিট কিলোমিটার থেকে ৯ হাজার ৭৮৯, গ্রীড সাব-স্টেশন ক্ষমতা ১৫ হাজার ৮৭০ থেকে ২৬ হাজার ২২৬ এমভিএ উন্নীত করা হয়েছে। মোট বিতরণ লাইন ২ লাখ ৬০ হাজার থেকে ৩ লাখ ৭২ হাজার কিলোমিটারে উন্নীত করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের গ্রাহক সংখ্যা ৩৩ লাখ ৭২ হাজার, পল্লী বিদ্যুৎ গ্রাহক ১ কোটি ৫৬ লাখ ৬০ হাজার, ডিপিডিসি’র ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৯২৯, ডেসকোর ৭ লাখ ৪৯ হাজার ৮৭৫ এবং ওজোপাডিকা’র গ্রাহক সংখ্যা ৯ লাখ ১৮ হাজার ৪২৮ জন। এই হলো উন্নয়নের ফিরিস্তি। অর্থমন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় সরকার বিদ্যুৎ উন্নয়নে ব্যয় করেছে ৪৪ হাজার ২১১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। আর সরকারিভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে ২ হাজার ৯২১ মেগাওয়াট। আরেকটি সরকারি সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতে মোট বিনিয়োগ করা হয়েছে ৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটা বিশাল বিনিয়োগ বটে। বর্তমান সরকার ২০১০ সালে গৃহীত পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২১ সালে বিদ্যুতের স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা ২৪ হাজার মেগাওয়াটে নিয়ে যাবে বলেছে। এরমধ্যে ১২ হাজার মেগাওয়াট করবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ। বেসরকারিভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার লক্ষ্যমাত্রা ৭ হাজার ৩৮২ মেগাওয়াট এবং আরো ৪০০ মেগাওয়াট আমদানি করা হবে। আবার একই কর্মপরিকল্পপনায় বলা হয়েছে  ২০২১ সালের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ ৫০ শতাংশ, তেল ২০ শতাংশ, গ্যাস ২৫ শতাংশ আর অন্যান্য ৫ শতাংশ করা হবে।
সরকার বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন করছে, তবে এর খেসারতটা জনগণকেই দিতে হচ্ছে বা হবে। গত ৫ বছরে ৬ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। দফায় দফায় দাম বাড়ালেও লোকসান কমছে না, বরং বাড়ছে। লোকসান আর ভর্তুকি কমাতে দাম বাড়ানো হচ্ছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত লোকসান দিয়েছে ৩৭ হাজার ৮৩৯ কোটি ১১ লাখ টাকা। দিন যাচ্ছে আর লোকসান বাড়ছে। সরকার বেসরকারি খাতকে অধিক প্রাধান্য দিয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়নের দিকে এগুচ্ছে। পাশাপাশি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনকেও প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো হবে। ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচও বাড়বে। গ্যাস সংকটের কারণে সরকার জ্বালানি তেল ও কয়লাকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করায় উৎপাদন খরচ বেশি পড়বে যার ফলে গ্রাহককে বেশি দামেই বিদ্যুৎ কিনতে হবে। আরেক সমস্যা হলো, সরকার বেসরকারি খাতকে প্রাধান্য দেয়ায় বেসরকারি উৎপাদনকারীদের হাতেই নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে। তাদের উৎপাদন খরচ কম হলেও সরকারের কাছে বেশি দামেই বিদ্যুৎ বিক্রি করছে। যেমন বিশ^ বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও বেসরকারি খাতের যেসব বিদ্যুৎ কোম্পানি সরকারের অনুমোদন নিয়ে নিজেরাই জ্বালানি (ফার্নেস) তেল আমদানি করছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ পাচ্ছে অনেক কম দামে। সরকার এখন পর্যন্ত ১১টি ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কোম্পানিকে নিজেদের ব্যবহারের জন্য ফার্নেস তেল আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। এরমধ্যে ছয়-সাতটি কোম্পানি তেল আমদানি শুরু করেছে। তাদের আমদানি করা তেলে বর্তমানে প্রায় ৭৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। কম দামে তারা জ্বালানি তেল আমদানি করায় তাদের উৎপাদন খরচ কম পড়লেও বিদ্যুতের দাম তারা কমাচ্ছে না। আর সরকার ফার্নেস অয়েলের দাম কমিয়ে দিয়েছে তাদেরই সুবিধার্থে। তারপরও বিদ্যুৎ কমানো তো দূরের কথা বাড়িয়ে যাচ্ছে। মন্ত্রণালয় এবং ওই কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জ্বালানি তেলের দাম কমায় ওই কোম্পানিগুলোর ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র থেকে পিডিবি প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ পাচ্ছে গড়ে ১০ টাকা করে। এসব কোম্পানির বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি লিটার ফার্নেস তেলের দাম পড়ছে ৩০ থেকে ৩২ টাকার মধ্যে। অপরদিকে সরকার নির্ধারিত বিপিসির দামে তেল নিয়ে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আছে, তাদের ক্ষেত্রে প্রতি লিটার তেলের দাম পড়ছে ৬২ টাকা। ফলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ছে ১৬-১৭ টাকা। ফার্নেস তেলের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হলে ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে গড়ে ১০ টাকায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব, যা কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের দামের প্রায় সমান। সব কথার শেষ কথা হলো যে, সরকার বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াচ্ছে ঠিকই তবে জনগণকে বেশি দাম দিয়ে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে এবং হবে। কষ্টটা জনগণের জন্যই থেকে যাচ্ছে।
লেখক : সাংবাদিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন