শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল : আমাদের চোখের সামনে মাঝে মধ্যে এমন সব ঘটনা ঘটে যা দেখলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, আমরা একটা সভ্য সমাজে বসবাস করছি। আমাদের সমাজের একশ্রেণির লোকেরা এমন সব কাজকর্ম করেন যা দেখলে মনে প্রশ্ন জাগে আমাদের দেশের জনগোষ্ঠীর একটা ক্ষুদ্রতম অংশ লেখাপড়া করেও মানুষের মতো মানুষ হতে পারেনি। তার মধ্যে শিক্ষিত ব্যক্তিটি যদি কোন আমলা কিংবা রাষ্ট্রের বড় কোন পদে বসা থাকেন তাহলেতো কোন কথাই নেই। তিনিতো ধরাকে সরা জ্ঞান করে যা কিছু করতে দ্বিধাবোধ করবেন না। এই শ্রেণীর শিক্ষিত লোকেরা ভাবেন তারাই সমাজ এবং রাষ্ট্রের মালিক। তাদের মতো লোকেরা যা কিছু করেন, তা-ই সুন্দর। তারা যা করবেন কিংবা যা বলবেন আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে তা মেনে চলতে হবেই। এদেশের সাধারণ জনগোষ্ঠী সহজ এবং সরল প্রকৃতির। তারা যা বিশ্বাস করে তা-ই করে থাকে এবং বলে থাকে। তাদের মধ্যে দ্বীচারিতা নেই। দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্বীচারিতা নেই বলেই তারা এক কথার মধ্যে সকল সময় থাকে। তারা সত্যকে সত্য বলেই জানে। তাদের টাকা-পয়সা দিয়ে সত্য থেকে হটানো যায় না। তাই আমরা প্রায়ই দেখে থাকি আমাদের দেশের একশ্রেণীর মানুষ দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে ইঁদুর-বিড়াল খেলা খেলে থাকেন। দেশের অতি দরিদ্র মানুষকে তাদের অধিকার কিংবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করে একশ্রেণীর ভদ্রলোকেরা আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হচ্ছে।
একজন শিক্ষিত মানুষ যদি তার শিক্ষা ও জ্ঞানটুকু মানুষের কাজে কিংবা রাষ্ট্র এবং সমাজের কাজে লাগাতে না পারেন, তাহলে আর লেখাপড়া করে কি লাভ। আমরা জানি মানুষ লেখাপড়া করে বিনয়ী হয়। পরের ভালমন্দ দেখার জন্য তৎপর থাকে। সমাজের অশিক্ষা, কুশিক্ষা দূর করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠে। শিক্ষিত মানুষের দল সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল অন্ধকার দূর করতে উদ্যোগী হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। শিক্ষিত মানুষের কাছে দেশের মানুষ এমন কোন কর্মকা- আশা করে না যা দেখলে মানুষের মনে হবে শিক্ষিত লোকের অনৈতিক কাজটিতো চোর ও ডাকাত প্রকৃতির লোকেরাও করে থাকে। কিন্তু আমরা আজ কি দেখছি। আমরা কি একশ্রেণীর শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কাজ দেখে হতবাক হয়ে যাচ্ছি না। এখন আমাদের চারপাশে এবং অফিস পাড়ায় ঘুরে ফিরে কি দেখতে হচ্ছে। সেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের সমাজের বড় বড় পদে অধিষ্টিত ব্যক্তিরা এমন সব কাজ কর্ম করছেন যা দেখলে আমাদের অবচেতন মন থেকে আপনা আপনি বেরিয়ে আসে, এসব কাজতো ভদ্র লোকের কাজ নয়। কিন্তু যেসব কর্তাব্যক্তিরা কুকর্ম করে থাকেন তারা একটিবারও ভাবেন না, তারা কি করছেন। তারা অর্থাৎ কর্তাব্যক্তিরা মনে করেন তারা যেসব কাজ করেন, তাদের সেই সব কাজেই সমাজ সংসারের মঙ্গল সাধন করে থাকে। কি চমৎকার তাদের চিন্তাভাবনা!
এবার আসি মূল কথায়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয় যে, দরিদ্র খামারির ১১৫টি হাঁস জবাই করে খেয়েছেন এক ইউএনও। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় যে, দেশের একটি উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বিলের জলে হাঁস নামার অপরাধে নিরীহ দরিদ্র তিন হাঁস খামারির ১১৫টি হাঁস ধরে এনে রাতে জবাই করে খেয়ে ফেলেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। অতীতের মতো এবারও হাঁস খামারিদের হাঁস উপজেলার বিল এলাকায় ঘুরে বেড়ালে বিলের মৎস্য প্রকল্পের লোকজন হঠাৎ মাইকিং করে বিলের জলে হাঁস চড়ানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই নিষেধাজ্ঞার কারণে হাঁস খামারিরা বিলের জল থেকে কয়েকশ গজ দূরে হাঁস লালন-পালন করতে থাকে। হঠাৎ করে খামারিদের কিছু হাঁস পানিতে নামলে পাহারাদার নিজে খামারিদের প্রায় ১১৫টি হাঁস ধরে ইএনওর বাস ভবনের কাছে রাখে। সন্ধ্যায় দরিদ্র খামারি হাঁসগুলো ছাড়াতে ইউএনও কাছে গেলে ইউএনও খামারিকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেন। পুলিশের ভয়ে অসহায় খামারি সেখান থেকে বাড়ি ফিরে যায়। অন্যদিকে ইউএনও খামারিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করে রাতে অফিসের লোকজন দিয়ে হাঁসগুলো জবাই করে, উপজেলার কয়েকজন অফিসারকে কিছু জবাই করা হাঁসের মাংস দিয়ে অবশিষ্ট হাঁসের মাংস ইউএনও ফ্রিজজাত করে রাখেন। উপরের উল্লেখিত সংবাদটির যদি বিচার-বিশ্লেষণ করতে যাই, তাহলে আমরা একটি বিষয়ে সবাই একমতে উপনীত হবো যে, আর তা হল আমাদের দেশে আমলারা নিজেদের যেমন অনেক কিছু মনে করেন, তেমনি দেশের মানুষকেও মানুষ বলে মনে করেন না। তারা নিজেদের মনে করেন দেশের সব কিছুর কর্তা। তাদের বিরুদ্ধে কেউ সত্য কথাও বলতে পারবে না। দেশের গরিব মানুষকে আমাদের দেশের একশ্রেণীর আমলা মানুষ বলে গণ্য করেন না। প্রতিদিন ডিমপাড়া হাঁসের ডিম বিক্রি করে দরিদ্র খামারিরা তাদের বউ-বাঁচ্চা নিয়ে জীবনযাপন করে। অনেক সময় এসব খামারিরা বিভিন্ন এনজিও কিংবা সুদের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা এনে তাদের খামারের ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে। সময়মত এনজিও কিংবা সুদের ব্যবসায়ীদের টাকা কিংবা কিস্তি পরিশোধ করতে না পারলে, খামারিদের চরম দুর্দশার মধ্যে পড়তে হয়। তখন দেখা যায় ঘরের সবকিছু, এমনকি খামারিদের ঘটিবাটি বিক্রি করতে হয়। তখন কৃষক কিংবা খামারিদের দুঃখের সীমা থাকে না। অনেক সময় ঘটিবাটি বিক্রি করেও নিজেদের রক্ষা করতে পারে না। প্রশ্ন হলো, যেসব দরিদ্র খামারির হাঁস বিলের জলে চড়ে বেড়ানোর অপরাধে জবাই করে খাওয়া হলো সেই দরিদ্র ব্যক্তিরা এখন কোথায় যাবে। তাদের তো মাথায় হাত দিয়ে বসে থেকে বিলাপ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। খামারিরা যদি কোন অপরাধ করে থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেত এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে শাস্তি দেয়া যেত। কিন্তু ইউএনও রাষ্ট্রের কোন আইনে দরিদ্র খামারিদের ১১৫টি হাঁস জবাই করে অফিসের অন্যান্য লোকদের নিয়ে খেয়ে ফেললেন তার কোন ব্যাখ্যা কি আছে। সবাই বলবেন ব্যাপারটা বোধগম্য হচ্ছে না। একটি উপজেলার একজন ইউএনও একটি উপজেলার মানুষের রক্ষাকর্তা। উপজেলার ভালমন্দ দেখার দায়িত্ব ইউএনওর উপরই থাকে। কিন্তু তিনি নিজে একটি উপজেলার মানুষের রক্ষাকর্তা হয়ে কিভাবে ভক্ষকে পরিণত হলেন? আমরা একটি সভ্য সমাজে বাস করি। সভ্য সমাজের একজন ইউএনও এমন কাজ অর্থাৎ দরিদ্র খামারিদের ডিমপাড়া হাঁস অন্যায়ভাবে খেয়ে ফেলতে পারেন না। আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় একজন বিসিএস ক্যাডারের অফিসার গরিব খামারিদের খামারের হাঁস ক্ষমতার অপব্যবহার করে খেয়ে ফেলতে পারেন। আমাদের রাষ্ট্রের সকল স্তরেই যেন এ ধরনের মানুষরা জায়গা করে নিয়েছে। সরকারের একেবারে উচ্চ পর্যায়ে থেকে দেশের মানুষকে হাঁস মোরগের খামার গড়ে তোলার জন্য বলা হয়ে থাকে। সরকারও হাঁস মোরগের খামার গড়ে তোলতে যারা চায় তাদের উৎসাহিত করে থাকে। কিন্তু মানুষ যখন দেখবে, নিজেদের পরিশ্রমে এবং এনজিও এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে টাকা পয়সা ধার দেনা করে গড়ে তোলা, হাঁস মোরগের খামারের হাঁস মোরগ দেশের একশ্রেণীর কর্তাব্যক্তিরা খেয়ে ফেলেন, তখন কি কারো ইচ্ছে হবে নিজের পয়সা খরচ করে এবং ধারদেনা করে একটি হাঁস মোরগের খামার গড়ে তুলতে। সংবাদপত্রের প্রকাশিত সংবাদটি পড়ে, যে কোন ব্যক্তির মনে আমাদের দেশের একশ্রেণীর আমলাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা অবশ্যই জন্ম নেবে। একবার শুনেছিলাম কোন এক আমলা নাকি কোন এক গ্রাম্য লোকের খাসি গাড়িতে করে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। এসব সংবাদ যদি সত্য হয় তাহলে আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে, আমরা এ কোন সমাজে বাস করছি। যে ব্যক্তি রাষ্ট্রের বড় পদে থেকে গরিব খামারির হাঁস পুলিশের ভয় দেখিয়ে জবাই করে খেয়ে ফেলতে পারে কিংবা যে ব্যক্তি চলার পথে একজন লোকের খাসি তুলে আনতে পারে, তাদের মতো ব্যক্তিদের কোন দায়িত্বশীল পদে থাকার অধিকার আছে কি না, সেই প্রশ্নটা মনে ঘুরেফিরে আসতেই পারে। দেশের মানুষকে কেউ যদি মনে করেন তাদের পুতুল নাচের পুতুল তাহলে ভুল করবেন। এখন সময়ের যেমন পরিবর্তন হয়েছে তেমনি করে মানুষের চিন্তার জগতেও পরিবর্তন এসেছে। মানুষ এখন কোন কিছুর স্থবিরতা মেনে নিতে চায় না। মানুষ এখন অন্যায়কেও মেনে নিতে চায় না। কর্তাব্যক্তিরা যদি মনে করেন মানুষ আগের মতো স্থবির হয়ে আছে তাহলে তারা বিরাট ভুল করবেন।
আসল কথা হচ্ছে, আমাদের সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে একশ্রেণীর নষ্ট মানুষ তাদের কালো থাবার পরিধি দিন দিন বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। নষ্ট মানুষের দল আমাদের পাওয়ার জায়গাটুকু গ্রাস করে নিতে চায় বলেই, আমাদের সমাজ জীবনে এতটা দাপট দেখতে পাচ্ছি। একজন ইউএনও কি বুঝেন না উনার কি করা উচিত কিংবা কি করা উচিত নয়। তিনি ভাল করে বুঝেন এবং জানেন যে, বিলের জলে খামারিদের হাঁস চড়ে বেড়ানো হাঁসকে পাহারাদার দিয়ে ধরে এনে জবাই করে অফিসের লোকদের নিয়ে খাওয়া যায় না। হাঁসের খামারিরা যদি আইন অমান্য করে বিলের জলে হাঁসের দল চড়িয়ে থাকে তাহলে খামারিদের শাস্তি দেওয়া যেত। একথা একজন ইউএনও ভাল করে জানেন যে, তিনি যখন একটা উপজেলার রক্ষক হয়ে আসেন তখন তার দায়িত্ব হলো যারা হাঁস মোরগের খামার করে থাকে তাদের উৎসাহিত করা। কিন্তু আমারা দেখছি একজন ইউএনও সবকিছু জেনেও নিজেকে অপরাধীর সারিতে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন। এখন আমরা যে সময়টায় বাস করছি সেই সময়টা হলো একজন শিক্ষিত লোকের নিজের সবকিছু মানুষের মাঝে উদার মনে বিলিয়ে দেওয়ার সময়। মানুষের জন্য কাজ করাটাই সময়ের দাবি। অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের মধ্যে একশ্রেণীর মানুষ বসবাস করছে, যারা নিজেরাই অনুধাবন করতে পারছেন না, তাদের কুকর্ম মানুষকে কতটা ক্ষতির সম্মুখীন করছে। তাই বলি, যারা ক্ষমতা পেয়ে কিংবা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানুষের বেঁচে থাকার শেষ সম্বল কেড়ে নিতে চান তাদের চিহ্নিত করতে হবে। তাদের চিহ্নিত করে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে, রাষ্ট্র সৎ মানুষের, সেখানে কোন দুর্বৃত্ত কিংবা অসৎ প্রকৃতির মানুষের স্থান নেই।
লেখক : কবি, গল্পকার, আইনজীবী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন