শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

সংবাদপত্রসেবীদের নিরাপত্তা

| প্রকাশের সময় : ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী : সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হালিমুল হক মীরুর গুলিতে দৈনিক সমকাল পত্রিকার সাংবাদিক আবদুল হাকিম শিমুল কর্তব্যরত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। ২ ফেব্রæয়ারি শাহজাদপুর স্থানীয় আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষের সময় পৌর মেয়র হালিমুল হক মীরুর ব্যক্তিগত শর্টগানের গুলিতে মারাত্মক আহত হন সাংবাদিক শিমুল। চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় পরদিন মারা যান। শাহজাদপুর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত বলেন, বারবার বারণ করা সত্তে¡ও মেয়র তার কথা না শুনে গুলি ছোড়েন। তার গুলিতেই শিমুলের মৃত্যু হয়েছে।
বিখ্যাত দার্শনিক হোরেস গ্রেলী সংবাদপত্র সম্পর্কে বলেছিলেন, সংবাদপত্র হচ্ছে স্বাধীনতার পছন্দসই অভিভাবক। সুবিচারের শক্তিশালী তলোয়ার এবং সত্যের উজ্জ্বল সূর্যরশ্মি । আমরা জানি, দীর্ঘদিন থেকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রসেবীদের নিরাপত্তা বিধানের উদ্যোগ ও দাবিতে দেশে সংবাদপত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল স্তরের সবাই সম্মিলিতভাবে সমাবেশ ও মিছিল করে চলেছেন। দেশব্যাপী সমাবেশগুলোতে অভিন্ন যে বক্তব্য উচ্চারিত হয়েছে তার সারসংক্ষেপ হল বর্তমানে বিভিন্ন কারণে সাংবাদিকতা পেশা সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। সাংবাদিকদের প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। সমাবেশসমূহে বক্তাদের বক্তব্যে অভিযোগ করা হয়েছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, প্রশাসনের কোন কোন অংশের এক শ্রেণীর লোক, সন্ত্রাসীচক্র, কালো টাকার মালিক, চোরাচালানী, বিভিন্ন সামাজিক অপশক্তি সাংবাদিক ও সংবাদপত্রকে তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে।
সাংবাদিক ও সংবাদপত্রকে তাদের কারো স্বার্থসিদ্ধির পথে বিন্দুমাত্র প্রতিবন্ধক হিসেবে অনুভূত হলে বিভিন্নরূপে তার ওপর আপতিত হচ্ছে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিকদের হুমকি-ধমকি-হামলা-মামলার শিকার হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শুধু তাই নয়, নিরস্ত্র নিরীহ সাংবাদিকদের বুলেটের আঘাতে বেঘোরে প্রাণ দিতে হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত। পার্বত্য চট্টগ্রামের পার্বত্য বার্তার সম্পাদক আবদুর রশীদ, যশোরের রানার সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল, দৈনিক জনকণ্ঠের যশোরের ব্যুরো প্রধান শামছুর রহমান সিলেটের ফতেহ ওসমানীসহ বেশ কয়েকজন পেশাদার সাংবাদিক গত কয়েক বছরে প্রাণ হারিয়েছেন সন্ত্রাসীদের আক্রমণে এবং বুলেটের আঘাতে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত বহু রিপোর্টার ও ফটো সাংবাদিককে একশ্রেণীর পুলিশসহ বিভিন্ন মহলের নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। সাংবাদিকদের রকমারী হামলা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে দেশব্যাপী বিক্ষোভ ও সমাবেশ ও মিছিলের উপর সন্ত্রাসী ও পুলিশী হামলা সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়টাকে প্রকট করে তুলেছে। সংবাদপত্রসেবীদের বিভিন্ন সমাবেশ ও প্রতিবাদ বক্তব্যে বলা হয় যে, ইদানীং সংবাদপত্রে দেশে অব্যাহত সন্ত্রাসীদের বিবরণ প্রকাশিত হতে থাকায় সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হতে হচ্ছে। এসব কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। প্রশাসনের দুর্বল ভূমিকার কারণেই আজ সন্ত্রাসীদের ধৃষ্টতা বেড়ে চলেছে বলে এর আশু প্রতিকার কামনা করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমরা জানি, সাগর-রুনিকে হত্যার পর ২৪ ঘণ্টার ভিতর হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও শাস্তির অঙ্গীকার তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক প্রদান করা হলেও আজ পর্যন্ত প্রকৃত খুনীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
দেশের সাংবাদিকদের কেন্দ্রীয় সংগঠনসমূহের সমাবেশ থেকে প্রচারিত যৌথ ঘোষণায় সাংবাদিকদের অনিরাপত্তা ও সংবাদপত্রের বর্তমান পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ছয়টা দাবি পেশ করা হয়েছে। এসব দাবির মধ্যে রয়েছে ক) শামছুর রহমানের হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচার। খ) দৈনিক রানার সম্পাদকের হত্যাকান্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্ত অনুষ্ঠান ও ঘাতকদের বিচার, গ) সাগর-রুনি হত্যাকারীদের প্রেপ্তার ও শাস্তি নিশ্চিত করা। ঘ) প্রশাসন ও পুলিশ কর্তৃক সাংবাদিক হয়রানি ও নির্যাতন বন্ধ করা, ঙ) সকল প্রকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরের সকল রাজনৈতিক দলের অঙ্গীকার ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের নাম ঠিকানা উল্লেখপূর্বক তাদের সাথে সম্পর্কহীনতার ঘোষণা প্রদান, চ) হরতাল ও রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনকালে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে সহায়তা প্রদান, ছ) প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করা এবং অপরাধীদের বিচারের আইনে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার ও বিচারের বিধান রহিত করা। এসব দাবি আজ সাংবাদিকদের দাবিই শুধু নয়, দেশ ও সমাজের সময়ের দাবি বললে অত্যুক্তি হবে না। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও সাংবাদিকদের স্টেনোগ্রাফার এবং সংবাদপত্রকে প্রেস রিলিজ হিসাবে ব্যবহার করার সঙ্কীর্ণ প্রবণতা কম-বেশি সকল দলের মধ্যে লক্ষণীয়। এক শ্রেণীর রাজনৈতিক দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়পুষ্ট সন্ত্রাসীদের তান্ডবে আজ দেশের শিক্ষার পরিবেশ দারুণভাবে কলুষিত। এ ব্যাপারে দেশ ও জাতি আজ উৎকণ্ঠিত। শিক্ষাঙ্গনের ব্যাপারে মহামান্য প্রেসিডেন্ট-শিক্ষামন্ত্রীসহ নেতাদের বারংবার উদাত্ত আহ্বান সত্তে¡ও সংশ্লিষ্ট মহলের শুভবুদ্ধির উদ্রেকের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এর উপর বর্তমানে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের উপর সন্ত্রাসী তান্ডব দেশ ও জাতির উৎকণ্ঠার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সমগ্র সমাজ এক অন্ধকার অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে চলেছে বলে প্রতিনিয়ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা সতর্ক বাণী উচ্চারণ করে চলেছেন। আশা করি, সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দানকারীরা এসব সতর্কবাণী আমল করতে যত্মবান হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীদের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।
দেশে রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রের কথা বলেন। সংবাদপত্র ও সাংবাদপত্রসেবীদের নিরাপত্তা ও সংবাদপত্রের অবাধ স্বাধীনতা গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। ক্ষমতার অন্যান্য কেন্দ্রীভবন ও ব্যক্তিকে দেবতায়নের প্রবণতা কালে কালে দেশে দেশে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বিবেকের রাজত্বই এ অঘটন থেকে জাতিকে মুক্ত রাখতে পারে। জেমস ব্রাইজ যেমন বলেন, ‘সংবাদপত্রই গণতন্ত্রকে সম্ভব করেছে।’ হ্যারল্ড ল্যাস্কি বলেন, নির্ভরযোগ্য সংবাদ থেকে বঞ্চিত কোন জাতি শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা ভিত্তিই হারিয়ে বসে।’ এক সংকটজনক মুহূর্তে দেশের সাংবাদিক সমাজ আজ শুধু সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা নয়, গণতন্ত্রের চেতনা রক্ষার জন্য অতীতের মতো রাস্তায় নেমেছে। কিছু সুনির্দিষ্ট দাবি পেশ করেছে। সেসব দাবির বাস্তবায়ন গণতন্ত্রের স্বার্থেই কাম্য।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন