এবং খৃষ্টানগণ বলে মসীহ আল্লাহর পুত্র। (সূরা তাওবা, আয়াত : ৩০)।
আয়াতটির তফসীর করতে গিয়ে ইমাম কালবী বর্ণিত পোলিসের কাহিনীটি উল্লেখ করা হয়ে থাকে। ইমাম কালবী কে ছিলেন প্রথমে তা জানা দরকার।
ইসলামের ইতিহাসে কালবী নামের দুই জন বিখ্যাত মনীষীর নাম পাওয়া যায়, যারা ছিলেন পরস্পর পিতা-পুত্র। প্রথম জনের নাম মোহাম্মদ ইবনে সায়েব (ওফাত : ৭৬৩) এবং দ্বিতীয়জন হেশাম ইবনে মোহাম্মদ (ওয়াত : ৮১৯ খৃ.) দু’জনই বাগদাদ-কুফার অধিবাসী বিভিন্ন শাস্ত্রে পারদর্শী এবং নানা শাস্ত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাদি রয়েছে। দ্বিতীয় জনের প্রায় ১৪০টি পুস্তক রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কিতাবুল আছনাম বা দেবতা সমূহ এবং আরেকটি জাহেলী ও ইসলাম যুগে ‘ঘোড়ার অভিজাত বংশ’। ইমাম কালবী বর্ণিত কাহিনীর নায়ক একজন ইহুদী। হজরত ঈসা (আ.)-এর হাওয়ারীগণকে হত্যা করে তিনি খৃস্টান ধর্মের বিরুদ্ধে যে জঘন্য ষড়যন্ত্র লিপ্ত হয়েছিলেন ঘটনা হতে তাই প্রমাণিত। তার নামের উচ্চারণ বিভিন্ন রকমের দেখা গেলেও পোলিস বা পোলুস অধিক প্রচলিত বলে মনে হয়। হজরত ঈসা (আ.)-এর হাওয়ারী বা মদদগারদের তিনি যে ঘৃণ্য ও অসৎ উদ্দেশ্যে শহীদ করেছিলেন তার পরবর্তী সাধনা তৎপরতা হতে তা সহজে অনুমান করা যায় এবং তাতে তিনি সফলও হয়েছিলেন। অধিকাংশ লেখকের মতে ঈসা (আ.)-এর হাওয়ারীগণের সংখ্যা ছিল ১২ জন। তাদের নামের পূর্ণ তালিকা (১২ জনের) বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। তাদের মধ্যে দু’জনের ভূমিকা হজরত ঈসা (আ.)-এর বর্তমানেই বিতর্কিত হয়েছিল, বাকিদের আনুগত্য সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন দেখা দেয়নি বলে অনুমিত হয়।
হজরত ঈসা (আ.)-এর যে বারো জন হাওয়ারীর ছিলেন তাদের দ্বাদশ হাওয়ারী নাম ইহুদা ইস ক্রিয়োতী। সে কয়েকটি দেরহাম ঘুষ হিসেবে গ্রহণ করে হজরত ঈসা (আ.) কে ধরিয়ে দিয়েছিল। তার সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তাকে গ্রেফতার করার জন্য তার বারো হাওয়ারীর মধ্যে গাদ্দার হাওয়ারী ইহুদাকে হাত করে। সে রোমীয় সৈন্যদের বলে, আমি যে ব্যক্তিকে চুম্বন করবো, বুঝতে হবে সেই মসীহ তাকে গ্রেফতার করে ফেলবে। সৈন্যরা একটি বাগানে মসীহকে গ্রেফতার করে বলা হয়। মাত্র তিরিশ টাকা উৎকোচের বিনিময় হাওয়ারী ইহুদা এই কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটায়। আরো একজন বিশিষ্ট হাওয়ারী পিট্রসও বিদ্রোহের অভিযোগ হতে আত্মরক্ষার জন্য শাসকদের সামনে জবানবন্দিতে ঈসা (আ.)-এর সাথে তার সম্পর্কের কথা অস্বীকার করে ছিল বলে বর্ণিত হয়ে থাকে।
মূল ঘটনাটি নি¤œরূপ
ইমাম কালবী আয়াতটির তফসীর করতে গিয়ে বলেন, হজরত ঈসাকে (আ.) আসমানে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর খৃস্টানরা একাশি (৮১) বছর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মের ওপর কায়েম ছিল এবং নামাজ রোজা আদায় করতে থাকে, এমন কি ইহুদী ও খৃস্টানদের মধ্যে বড় বড় যুদ্ধবিগ্রহও হতে থাকে। ইহুদিদের মধ্যে পোলিস নামক এক ব্যক্তি ছিলেন অসীম সাহসী বীর বাহাদুর। তিনি হজরত ঈসা (আ.)-এর সকল হাওয়ারী (মদদগার)-কে শহীদ করেন। অতঃপর তিনি স্বীয় জাতি (ইহুদীদের)-কে বলেন যে, সত্য যদি ঈসা (আ.)-এর সাথে হয় তাহলে আমরা তার সাথে কোফরের কাজ করেছি তাই আমাদের জাহান্নামে যেতে হবে। আর যদি এমন হয়, আমাদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে, কিন্তু আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন অতি সত্বর আমি এমন একটি উপায় বের করবো যার মাধ্যমে তিনিও আমাদের ন্যায় জাহান্নামী হবেন।
ওকাব নামক পোলিসের একটি ঘোড়া ছিল। তিনি তাতে আরোহন লড়াই করতেন। এক সময় তিনি তার ঘোড়াটির কোচঁ কেটে নিজের মস্তকে ঢোল রেখে লজ্জা প্রকাশ করতে থাকেন। খৃস্টানরা তাকে এ অবস্থায় দেখে জিজ্ঞাসা করে, আপনি কে? পোলিস জবাবে বলেন যে, আমি আপনাদের শত্রু কিন্তু এখনই। কেননা আসমান হতে আমার কাছে আওয়াজ এসেছে, তোমার তওবা ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল হবে না যতক্ষণ না তুমি খৃস্টান হয়ে যাও। তাই এখন আমি খৃস্টান হয়ে গেছি। অতএব খৃস্টানরা তাকে তাদের গির্জা ঘরে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়। এভাবে পোলিস খৃস্টানদের গির্জায় এক বছর পর্যন্ত আবদ্ধ থাকেন। এসময় কারো সাথে কোনো কথাও বলেননি, গির্জা হতে বেরও হননি। এ পূর্ণ এক বছর মুদ্দতের মধ্যে অবিরতভাবে ইনজিল (বাইবেল) অধ্যয়ন করতে থাকেন। এমনকি যখন গির্জায় তার এক বছর পূর্ণ হয় তখন তিনি গির্জাঘর হতে বের হন এবং খৃস্টানদের উদ্দেশে বলেন : ‘আমাকে গায়বী আওয়াজের মাধ্যমে বলা হয় যে, তোমার দোআ আল্লাহ তালা কবুল করেছেন।’ তার এ কাহিনী খৃস্টানরা বিশ্বাস করে এবং তার প্রতি স্বীকৃতি দেয় যার ফলে খৃস্টানদের প্রত্যেক ব্যক্তি পোলিসকে ভালোবাসতে থাকে। অতঃপর পোলিস বায়তুল মোকাদ্দাস (জেরুজালেম) গমন করেন। এবং সেখানে নাসতুরা নামক এক ব্যক্তিকে তার খলিফা (প্রতিনিধি) মনোনীত করেন এবং তাকে শিক্ষা দেন যে, ঈসা (আ.) মরিয়াম এবং আল্লাহ তিনজন ছিলেন।
অতঃপর তিনি জেরুজালেম হতে রোমে চলে যান এবং সেখানে তিনি লোকদের আল্লাহর গুণাবলী ও মানবতার শিক্ষা দেন এবং বলেন যে, ঈসা (আ.) মানুষ ছিলেন না, জিনদের মধ্যেও ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন আল্লাহর পুত্র। তিনি রোমবাসীদের মধ্যে হতে ইয়াকুব নামক এক ব্যক্তিকে তার খলিফা মনোনীত করেন। এরপর মালকান নামক দ্বিতীয় ব্যক্তিকে ডেকে তাকে বলেন যে, ঈসা (আ.) সর্বদা মাবুদ হিসেবে থাকবেন।
এরপর তার তিন জন মুরীদকে আলাদা আলাদা ভাবে তার কাছে ডাকেন এবং তাদের প্রত্যেককে বলেন, তোমরা আমার বিশেষ মুরীদ (খলিফা) এবং রাতে আমি ঈসা (আ.)কে স্বপ্নে দেখেছি যে, তিনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং কাল আমি নিজের পক্ষ হতে কোরবানী করবো। তাই তোমাদের একথা বলে কোরবানী স্থানে ডেকেছি যাতে সাবই আমার উপহার নিয়ে যায়। এজন্য পোলুস এভাবে তার তিনজন খলিফার সাথে আলাদাভাবে নির্জনে উপরোক্ত কথাগুলো বলেন এবং প্রত্যেককে আশ্বস্ত করেন যে, তিনিই তার নির্ভরযোগ্য ও সঠিক স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি।
অতঃপর দ্বিতীয় দিন পোলুস কোরবানীর স্থানে গিয়ে কোরবানী করেন এবং এই কথা প্রকাশ করেন যে, এ কোরবানী ঈসা (আ.)-এর সন্তুষ্টটি লাভের জন্য করছি। সুতরাং উক্ত তিনজন (নাস্তরা, ইয়াকুব এবং মালাকান) তাদের অনুসারীদের একত্রিত করেন এবং তাদের উপস্থিতিতে পোলুসের কাছ থেকে উপহার গ্রহণ করেন। সুতরাং সেই দিন হতেই খৃস্টানগণ উক্ত তিন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরপর তাদের তিন দলের মতভেদ চরম আকার ধারণ করে। পরিণতিতে তারা পরস্পর শত্রু হয়ে যায়। তাই আল্লাহ তালা সূরা তওবার ৩০ নম্বর আয়াতে তাদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। আল্লামা কামাল উদ্দীন দামিরী তার বিখ্যাত গ্রন্থ হায়াতুল হায়য়ানে ফারসুন শব্দের আলোচনায় ইমাম কালবী বর্ণিত ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। ঈসা (আ.)-এর হাওয়ারীদের হত্যাকারী হিসেবে পোলুসের অবিস্মরণীয় ভূমিকার বিবরণ তথা কাহিনীটি আমরা ওপরে তুলে ধরে ছিলাম। বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী ইবনুল্লাহ বা আল্লাহর পুত্র ধারণা বলতে হজরত ঈসা (আ.)-কে বুঝানোর দীর্ঘকাল পরের ঘটনায় বলা হয়, পোলুস সেন্টপল ছিল একজন কট্টরপন্থী ইহুদী, সে যখন তার জুলুম হতে বিরত হয়ে খৃস্টান হয়ে যায়, তখন তাদের প্রতি কেবল শান্তি ও নিরাপত্তার ব্যবস্থাই করেনি, আরো নানা উপকার করতে থাকে। রোমবাসীদের নামে সে একখানা পত্র প্রেরণ করে তাতে লিখেছিলেন যে, দৈহিক দিক থেকে মসীহ দাউদের বংশ কিন্তু আত্মিক পবিত্রতার দিক দিয়ে এবং মৃতদের মধ্য হতে জীবিত হয়ে উঠে আমার দরুন প্রকৃতির সাথে তিনি খোদার পুত্র হিসেবে গণ্য হয়েছেন। ঐতিহাসিকদের মতে, সেন্টপলই প্রথম খবিশ যে, ঈসা (আ.)-এর নামের সাথে পুত্রত্ব, ঈশ্বরত্ব পাপের কাফ্ফারা এবং তত্ত্ববাদের বিশ্বাসগুলোকে সম্পৃক্ত করে খৃস্টধর্মের সর্বনাশ করেছে। নিঃসন্দেহে এটি ইহুদীদের গভীর চক্রান্ত ছিল। যদি তারা ঈসা (আ.)কে শূলবিদ্ধ করতে ব্যর্থ হয় তথাপি তার শিক্ষা ও দ্বীনকে বিকৃত করতে শত ভাগ সফল হয়েছে।
সেন্টপলের উদ্ভাবিত আকায়েদ বা বিশ্বাসগুলো বাইবেলের আলোকে নির্ণয়রূপ; যেগুলোর ওপর খৃস্টধর্মের ভিত্তি-
১. ঈসা (আ.) আল্লাহর পুত্র।
২. কেবল আল্লাহর পুত্রই নন একেবারে স্বয়ং খোদা।
৩. আকালিসে মালাসা বা তিন অংশ একই সত্তা।
৪. মরিয়াম (আ.) উপাস্য হওয়ার যোগ্য।
৫. ঈসা (আ.)-এর শূলবিদ্ধ হওয়া মানুষের পাপাচারের কাফফারা স্বরূপ।
৬. ঈসা (আ.)-কে জীবিত আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে।
৭. অদৃশ্য অবস্থার পর ঈসা (আ.)-এর ওফাত হয়নি বরং আসমানে জীবিত উঠিয়ে নেয়া হয়েছে, আবার তিনি জগতে খোদার রাজত্ব কায়েমের জন্য আসবেন।
ইমাম কালবীর ব্যাখ্যা অনুযায়ী হজরত ঈসা (আ.)-কে আসমানে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর একাশি বছর পর্যন্ত খৃস্টানদের মধ্যে ইসলাম ধর্ম কায়েম ছিল। একাশি বছর কম সময় নয় শতাব্দীর কাছাকাছি। এ দীর্ঘকাল পর্যন্ত খৃস্টানদের মধ্যে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠিত থাকার পর তাদের মধ্য হতে কিভাবে ইসলামের বিলুপ্তি সাধিত হলো কিংবা একে বিকৃত করা হলো, তার বিবরণ ইমাম কালবী প্রদান করেছেন। এখানে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন হতে পারে। ঈসা (আ.)-কে আসমানের উঠিয়ে নেওয়ার ৮১ বছর পর কী হাওয়ারীদের হত্যা করা হয়? তারা কতদিন বেঁচে ছিলেন এবং হত্যাকারীর বয়স তখন কত ছিল? এজাতীয় প্রশ্নের জবাবে বলা যায় যে, এটা অসম্ভব কিছু নয়। কেননা তখনকার লোকেরা দীর্ঘায়ু লাভ করতো, এমন কি পূর্বেকার বহু নবী বহু বছর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। পরবর্তীকালেও বিভিন্ন দেশে অনেক লোকের একশ-দেড়শ’ বছর জীবিত থাকার দৃষ্টান্তের অভাব নেই।
তাছাড়া, ঈসা (আ.)-এর হাওয়ারীগণের মধ্যে সবাই জীবিত না থাকলেও কেউ কেউ হলেও তখন পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারেন। আরো একটি বিষয় হলো, লেখক যে তারিখটি (সন) উল্লেখ করেছেন তা ছাপার সময় ভুলও হতে পারে এবং এরূপ ভুল ভ্রান্তি, দুনিয়াময় সর্বকালেই সর্বস্থানেই হয়ে আসছে। বর্তমান বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগেও মারাত্মক ভুল হয়ে আসছে নানা ক্ষেত্রে। সুতরাং একাশি বছর ছাপাতে বা নকল করতে ভুল হয়ে থাকলে তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এরূপ ভুলে ভরা ইহুদী-খৃস্টানদের রচনা সম্ভার। সকল নবী-রাসূলের প্রধান বাণী ছিল তওহীদ বা আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস স্থাপন এবং তার সাথে কাউকে শরিক না করা। হজরত ঈসা (আ.)-এরও প্রধান পয়গাম ছিল তাই যা ইসলাম ধর্মেরও মৌলিক প্রধান শিক্ষা। ঈসা (আ.) দুনিয়াতে প্রথম শিশু যিনি দোলনা জীবনেই উচ্চারণ করেছিলেন তিনি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর প্রেরিত রাসূল। তওহীদের স্বীকৃতি এখানেই। কিন্তু পোলুস সেন্টপলের বদলৌতে তিনি হয়ে যান স্বয়ং খোদা এবং তৃতত্ত্বাবাদ হয়ে যায় এ ভ-ের মূল আদর্শ নীতি এবং কল্পিত দর্শন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন